বিভার কালো টিপ
রেখা আক্তার
পড়ন্ত বিকেল। সন্ধ্যা নামার তখনো খানিক বাকি। অস্তগামী সূর্যটা চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে আলো আর রঙের ফোয়ারা। ভর দুপুরের মতো সে আলো তাতিয়ে তোলার মতো নয়।আবার নয় ক্লান্ত পথিকের মতো ম্রিয়মান। ভ্রমণ ক্লান্ত সূর্য ততক্ষণে শরীর থেকে খসিয়ে ফেলেছে সবটুকু তেজোদীপ্ত প্রলেপ। তেজটুকুন এখন পোড়ানোর পরিবর্তে স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে। পাহাড়ি পত্রপল্লবে পড়েছে তার স্নিগ্ধ আবির। চারপাশে সদ্য গজিয়ে ওঠা কলাপাতা সবুজ পত্র পল্লবের ঘন বৃক্ষরাজি যেন নববধূর সরিয়ে ফেলা অবগুণ্ঠনের আড়াল থেকে উন্মোচন করেছে পেলব দেহশ্বর্য। বহুদিন পর এমন বিকেলের রূপ ঐশ্বর্যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না বিহানের। হবেই বা না কেন? এমন একটা স্নিগ্ধ বিকেল ভাগ্যক্রমে জুটল আজ । এক তলা সুরম্য হোটেলটার লাগোয়া ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠল,
এখন যদি সন্ধ্যা নামে পথে, ক্ষতি কী বলো তুমি তো
রয়েছো আমার সাথে…
চারদিকে সবুজের অপূর্ব সমারোহ। নিসর্গ প্রসাধন চর্চিত হয়ে অষ্টাদশী নারী মূর্তি রূপে দাঁড়িয়ে আছে বিহানের সম্মুখে। ছুঁয়ে দিতে মন চায় গভীর তৃষ্ণায় যেমন নদী ছোঁয় সাগর মোহনাকে।
কী রহস্য লুকায়িত আছে আজকের বিকেলে? পুলক বোধ করল বিহান। কৃষ্ণচূড়ার সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়া। হালকা বাতাসের দোলার ফাঁকে ফুলেরা উঁকি দিচ্ছে পাতাদের আড়াল ভেদ করে। যেমন পালকির ভেতর থেকে উঁকি দেয় অবগুণ্ঠনের আড়াল থেকে নববধূ।
চিরচেনা মলচত্বরের কথা মনে পড়ল বিহানের। সোনালি সেই দিনগুলোতে মলচত্বরের নৈসর্গিক চাতুর্যে বিহান বিভা হারিয়ে যেতো রঙের দুনিয়ায়। নিসর্গের সে ছাতার নিচে বসে কত দিন কেটেছিল কথার পর কথামালা গেঁথে।
একেবারে সাদা মাটা ঘাস ফুলের জীবন ছিল তার। সাধারণ সে জীবনে প্রাচুর্য নিয়ে এসেছিল বিভা নামের মেয়েটি। বিভার বাসা ছিল উত্তরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে যাওয়া আসা করতো সে । বিহান থাকতো সূর্যসেন হলে। রোজ বিভাকে বাসে তুলে দিয়ে নিজের হলে ঢুকতো । আজ এতো বছর স্মৃতির পৃষ্ঠা উল্টে দিচ্ছে যেন কোনো অদৃশ্য হাত।
কদম গাছের ডালে ডালে কদমের কুড়ি ফুটতে শুরু করেছে । কিছুদিন পরই বর্ষা কাল। তার আগমনী বার্তা প্রকৃতিতে। তারই আয়োজন কদমের ডালে। আষাঢ় মাসে অবিরাম বৃষ্টিতে কদমের সাথে পাতার বৃষ্টিস্নাত দৃশ্য দেখার মতো হয় নিশ্চয়ই ।কর্তব্যের ঘেরাটোপ আর নাগরিক ব্যস্ততার মাঝে হারিয়ে গেছে মহুয়া মাতাল ভালো লাগা গুলো। সে জন্যই ইচ্ছের পালে হাওয়া লাগিয়ে আজকের এই বেরিয়া পড়া। পুরনো স্মৃতির এ্যালবাম উল্টাতেই চোখে ভেসে আসে রঙিন সব অতীত চিত্রকল্পেরা।
সবুজ চত্বর ঘেরা সেই চির নবীন মলচত্বরে হাতে হাত রেখেছিল কেউ। বিকেলের শেষ আলোকে সাক্ষী রেখে এক জীবন কাটিয়ে দেয়ার শপথ নিয়েছিল দুজন। সে কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটায় বুনো এক কাঠঠোকরা যেন ঠোকরাতে শুরু করলো।
সে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো একটি হলদে রঙের পাতার ভূ-পাতিত হওয়ার দিকে।বোঁটা থেকে যে পাতাটি এইমাত্র খসে পড়লো ওই ঝরা পাতার মতোই কেউ তাকে জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলেছে। অজান্তেই বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। অপূর্ণ সে দীর্ঘশ্বাসটা ঝুলিয়ে দিলো বিদায়ী বসন্তের বৈকালিক বাতাসের কার্নিসে। যে মানবী একদিন চোখের আড়াল হলে পাগল হয়ে যেতো সে নিজেই বিহানকে মনের আড়াল করে বসে আছে।
কী ভাবে পারে মানুষ? এ প্রশ্নটি পাঁচ বছর ধরে ঘুরছে। কতদিন দেখেনি তাকে। অথচ,তার সাথে মানসিক সংসার। সেখানে চাওয়া পাওয়ার হিসেব শূন্য। তবুও কেউ কেউ অদ্ভুতভাবে ভালোবাসা গুলো বাঁচিয় রাখে। বিহান তেমনি একজন।
কী ই বা করতো পারতো বিভা? কোন উপায় ছিল না তার। বড়লোক বাবার একমাত্র আদরের মেয়ে ছিল সে। বাবা মা ভাল পাত্র পেয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। বিহান তখন মাত্র থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে ফোর্থ ইয়ারে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে । গ্রাম থেকে এই নগর প্রকোষ্ঠে এসেছিল ভাগ্যের অন্বেষণে। নীড়হারা বিচলিত পাখির মতো গহীন অরণ্যের অন্বেষণ করে গেছে। বেকার ছেলের সাথে প্রেম কোন বাবা মা মেনে নেয় এই দেশে ? হয়তো বিহানও ধরে রাখার শেষ চেষ্টা টুকু করেনি।আজ কর্ম কোলাহল থেকে একটু অবসর তাকে অতীতচারী করে তুলল। সবাই বের হলেও সে যায়নি।
দীর্ঘ ভ্রমণ ক্লান্তি থেকে রেহাই পেতে সে ঘুমকেই সঙ্গী করেছিল । কিন্তু আধুনিক বাংলোর সুরম্য বারান্দায় তাকে স্মৃতির আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল । পাহাড়ের বুক চিরে বেরিয়ে পড়া ঝরণা ধারায় ভিজতে ভীষণ ভালো লাগতো বিভার ।
“চলতে চলতে খাড়া পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে হারিয়ে যাবো ডানপিটে দস্যিপনায় ।স্মৃতি আর বিস্মৃতি ব্যথা আর কথার দ্বৈত মিশেলে বেশ জমিয়ে রাখতো বিকেল গুলো। স্পর্শহীন কিছু অনুভূতি থাকে যাকে স্পর্শের বাইরে চিন্তা করলে এক চিন্তাতীত জগতের সৃষ্টি হয়।তেমনটাই হলো বিহানের। বর্ষিয়ান চাম্বুল গাছটা ডালপালা মেলে ছড়িয়ে দিচ্ছে সভ্যতার শেষ ছায়া। এমন আত্মান্তিক আবহে সে আকণ্ঠ ডুবিয়ে রাখে নিজেকে। কেমন একটা চেনা চেনা ঘ্রান এসে তার নাকে লাগে। পাশেই হাস্নাহেনা গাছ। সেখান থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে মাঝারি গোছের পাপর গাছ । তার শরীর জড়িয়ে তরতর করে উপরে উঠেছে কিছু লতাগুল্ম। গাছটাও তাদের উদ্যত আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে মাতৃআবেগে। বিহান একবার আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ জুড়ে থোকা থোকা ইতস্তত মেঘ। কিছু দিন ধরে মেঘেদের আনাগোণা চলছে। এমন মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়েনা। এ মেঘ চঞ্চলতা ছড়ায়। অদ্ভুত চপলতার হারিয়ে যায় দূর থেকে দূর অজানায়। মেঘ দেখলে বিভার কথা বেশি করে মনে পড়ে। ও বৃষ্টি দেখলেই হয়ে যেতো চঞ্চলা ডাহুক পক্ষী। বৃষ্টিতে ভেজা ওর কাছে রোমাঞ্চের মতো ছিল।
“এখনো তুমি বৃষ্টি স্নাত হও রোজ
বৃষ্টি বেলায় আমার মনের একটু রাখো খোঁজ”?
আপনা আপনি বেরিয়ে পড়ে কবিতার দুটো চরণ।যে চলে গেছে চোখের আড়ালে তাকে মনের মাঝে গভীর আলিঙ্গনে বেঁধে রাখতে হয় । বিভার কপালের কালো টিপটা এখনো আছে বিহানের ডায়রীর পাতার ভাঁজে । মাঝে মাঝে ডায়রীর পাতা উল্টে টিপটা স্পর্শ করে । তাতে সে বিভার ছোঁয়া পায়। কোন এক বসন্তে উষ্ণ ঠোঁটে কপাল ছুঁয়েছিল বিভার।তখন টিপটা বিহানের ঠোঁটে লেগে গিয়েছিল। লুকিয়ে রেখেছিল নিজের কাছে। আজও বিভা জানলো না সে কথা।
বিদায়ী সূর্যটা যাই যাই করছে । পাখিরা ডানা মেলে উড়ে ফিরছে নীড়ে। কখনো ঝাঁক বেঁধে। আবার কোন পাখি দলছুট একাকী। বিহান যেন নিজের সাথে দলছুট ভাত শালিকটার সাদৃশ্য খুঁজে পায়। তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে দলছুট হতে হয়। এতো অনিবার্য। এমন ভাবতে ভাবতেই বিহানের চোখ আটকে গেল বট গাছটায় । তার তলে একটা মেয়ে পায়চারি করছে। লাল সালোয়ার কামিজের মেয়েটি ঘন সবুজ চত্ত্বর মিলে মনে হচ্ছে এক টুকরো বাংলাদেশ। কিছুটা এগিয়ে কৃষ্ণচূড়ার তলায় দাঁড়ালো মেয়েটি। তার শরীরী ভাষা বলছে সে কারো জন্য অপেক্ষারত। বিহানের বুকের বা পাশটা কেঁপে উঠলো।তাকে এমন চেনা চেনা লাগছে কেন? মেয়েটির এলো চুল উড়ছে বাতাসে। উড়ছে ওড়নার প্রান্তদেশ।
বিহান গুটিগুটি পায়ে কখন যে মেয়েটির পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটি টের পায়নি।
ইক্সকিউজ মি!।বিহানের কণ্ঠ শুনে পিছন ফিরে তাকালো মেয়েটি। দু’জনই বাকরুদ্ধ, বজ্রাহত।
প্রথমে বিভা কিছু বলতে যাচ্ছিল। পিছন থেকে কেউ ডাকলো “মা”।
বিভার চার বছরের মেয়ে বিভার দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটি বাবার হাত ধরে হাঁটছে। কিছু দিন আগে বান্দরবান জেলার ডিসি হিসেবে জয়েন করেছে বিভার স্বামী। ছুটির দিন তারা বেরিয়েছে শহর দেখতে।
বিভা এগিয়ে গেল স্বামী সন্তানের দিকে। বিহান পাথরের মতো দাঁড়িয়ে বিভাব চলার ছন্দ নির্ণয় করতে লাগল।
মনে মনে বলল,
যতটুকু আলোড়নে কেঁপে ওঠে বুক
কেঁপে ওঠে বুকের ঠিক বাম
যত টুকু আঘাতে জল গড়ায় চোখে
অশ্রু দিয়েছি তার ডাকনাম।
ততক্ষণে গোধূলির ধূসরতা প্রকৃতির ছেড়ে বিহানের বুকে নেমেছে। প্রদোষ কাল যাপন করছে নির্ঘুম চোখ। তোমার কপালের কালো টিপ আমার আঁধারকে আরও গাঢ় করুক। কপালের কালো টিপ আমার একমাত্র বিত্তহীন বৈভব।এক জীবনে সাধের শৈল্পিক বেসাতী।
________________________________
রেখা আক্তার
সহকারী অধ্যাপক, বাংলা
কুমুদিনী সরকারি কলেজ, টাঙ্গাইল।