কবি হেলাল হাফিজ
সাঈদা আজিজ চৌধুরী
‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’—অমর এ পঙ্ক্তির রচয়িতা কবি হেলাল হাফিজ আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
সংবাদসূত্রে জানা যায়, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে বাথরুমে পড়ে যান। তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন।
কবি হেলাল হাফিজের মতো এত বড় মাপের একজন কবি সম্পর্কে লেখার ধৃষ্ঠতা বা যোগ্যতা কোনোটাই আমার নেই। তবুও ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর একজন ভীষণ ভক্ত হিসেবে কিছু লেখার তাগিদ মন থেকে অনুভব করছি।
প্রেম ও দ্রোহের কবি শ্রদ্ধেয় হেলাল হাফিজ ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোণায় জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ দিয়েই মানুষের হৃদয়ে আসন করে নেন হেলাল হাফিজ। এই গ্রন্থের একটি কবিতা “নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়”র অন্যতম পঙক্তি…
“এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় ।”
যৌবনকে উদ্দীপ্ত করার এই কাব্যিক উচ্চারণ কবিকে অমর উচ্চতায় আসন করে দেয়। কবি হেলাল হাফিজ ঊনসত্তরের উত্তাল দিনে লিখেছিলেন এই কবিতা। ছাত্র-জনতার প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠেছিল নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় শিরোনামের কবিতার উল্লেখিত লাইনগুলি। পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে পোস্টার ও দেয়ালে দেয়ালে অসীম সাহসী কথামালা ঠাঁই করে নেয়।
কালজয়ী এই কবিতা মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকে।
এক সাক্ষাৎকারে কবি বলেছেন, ‘উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান যে কতটা সর্বগ্রাসী ও সর্বপ্লাবী ছিল, সেটা যাঁরা না দেখেছেন, তাঁদের বোঝানো দুষ্কর।গণ–অভ্যুত্থান চলাকালে একদিন সন্ধ্যায় আমি পুরান ঢাকা থেকে ইকবাল হলে (এখন সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ফিরছিলাম। তখন আমি বাংলা অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়ায় আমার রিকশাটি থামল। সেখানে তখন সমানে মিছিল চলছে। ইপিআর (এখন বিজিবি) ও পুলিশ মিছিলকারীদের পেটাচ্ছে, ধাওয়া দিচ্ছে। মিছিল থেকেও ছোড়া হচ্ছে ইটপাটকেল। এর মধ্যে বয়স্ক এক রিকশাচালক বয়স্ক বলে উঠলেন, “মার, মার শালাদের। প্রেমের জন্য কোনো কোনো সময় মার্ডারও করা যায়।” রিকশাওয়ালারা মাঝেমধ্যে টুকটাক ইংরেজি শব্দও বলে। কথাটা আমার মগজে ও মনে গেঁথে গেল। আসলেই তো তাই! দেশপ্রেমের জন্যও তো মার্ডার করা যেতে পারে। ওই ঘটনা থেকেই কবিতাটির জন্ম।’
কেবল কবিতার নিরিখে নয়,যাঁরা সাহিত্যের খোঁজখবর রাখেন না, এমন অনেকের হৃদয়েও এই লাইনগুলি স্পর্শ করে যায়। “যে জলে আগুন জ্বলে” — কাব্যগ্রন্থভুক্ত সব কয়টি কবিতা ১৯৬৯–১৯৮৫ সালের মে লেখা হয়েছে। “নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়” কাব্যগ্রন্থের মতোই “অগ্ন্যুৎসব”কাব্যের কবিতা হৃদয়ের তন্ত্রীতে তারুণ্যের আগুন জ্বালাতে সক্ষম হয়। কয়েকটি লাইন উল্লেখ করছি—
“ ছিল তা এক অগ্ন্যুৎসব সেদিন/আমি সবটুকু বুক রেখেছিলাম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে/জীবনবাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে/রক্তঋণে দেশ হলো, তোমার দিকে চোখ ছিল না/ জন্মভূমি সেদিন তোমার সতীন ছিল।
কেবল মুক্তিযুদ্ধ বা গণ-অভ্যুত্থান নয়,যে কোনো প্রেক্ষাপটে কবি হেলাল হাফিজের এ উচ্চারণ সার্বজনীন হয়ে ওঠে।
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ “যে জলে আগুন জ্বলে” তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয়।কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “কবিতা একাত্তর” ২০১২ সালে এবং তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ “বেদনাকে বলেছি কেঁদো না”। এত কম কবিতা লিখে এমন জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি শুধুমাত্র কবি হেলাল হাফিজের ভাগ্যেই জুটেছে।
কবির একান্ত নিজের কিছু কথা এখানে উল্লেখ করছি—
“জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। এখন কেবলই মনে হয়,জীবনের সময়গুলো বৃথাই অপচয় করেছি। কত সুন্দর সুন্দর কবিতার পঙক্তি মাথায় এসেছে,টেবিলে বসিনি,লিখিনি। জীবনটা অপচয়ই করেছি বলা যায়। এজন্য আমি এখন ভীষণভাবে লজ্জিত,অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী। এই দীর্ঘজীবনে যাঁরা আমাকে ভালোবেসেছেন,তাঁদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। আর যাঁরা ভালোবাসেননি,তাঁদের প্রতি আরও বেশি কৃতজ্ঞতা। কারণ তাদের অবহেলা,অনাদর ও প্রত্যাখ্যান আমাকে কবি বানিয়েছে।”
কবির জন্য প্রার্থনা—তিনি যেন শেষ ঠিকানায় আর ব্যথিত না হন। আর যেন বলতে না হয়—“বেদনাকে বলেছি কেঁদো না”। শান্তিতে থাকুন প্রিয় কবি হেলাল হাফিজ।
স্বত্ব সংরক্ষিত
১৩/১২/২০২৪