রহীম শাহ
স্বপ্নবান মানুষের খোঁজে
আমাদের দেশে স্বপ্ন দেখার মানুষের অভাব আছে। স্বপ্ন কি আর সবাই দেখতে পারে? যারা দেশকে, দেশের মানুষকে, পরিবেশ-প্রকৃতিকে ভালোবাসে তাদের মধ্যে স্বপ্নের বীজ থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ, দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে হলে প্রয়োজন স্বপ্নবান মানুষ। দেশের মানুষের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন স্বপ্নবান মানুষ। দেশের পরিবেশকে দেশের উপযোগী করে রাখার জন্য প্রয়োজন স্বপ্নবান মানুষ। দেশের প্রকৃতিকে দেশের ও দেশের মানুষের উপযোগী করে রাখার জন্য প্রয়োজন স্বপ্নবান মানুষ। সর্বোপরি দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস–ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার জন্য প্রয়োজন স্বপ্নবান মানুষ। কিন্তু এই স্বপ্নবান মানুষ কোথায়?
আমরা এখন সবসময় সবকিছুর বিচার-বিবেচনা করি রাজনীতি দিয়ে। আর রাজনীতিকরা ইতিহাসনির্ভর হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যান। তাদের কাছে ‘স্বপ্ন’ শব্দটি একান্তই ব্যক্তিগত। নিজেই নিজের সিঁড়ি নির্মাণ করার দুরারোগ্য ব্যাধির নাম রাজনীতি । রাজনীতিকদের ‘তথাকথিত স্বপ্ন’ মানুষের স্বপ্নকে নিষ্পেষণ করে। তারা তাদের উপযোগী করে একটা কাল্পনিক স্বপ্ন বানিয়ে নেন। আর সেই কাল্পনিক স্বপ্ন এখন রাষ্ট্রীয় ক্যান্সারের মতো চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। যে আকাঙ্ক্ষা থেকে দেশ স্বাধীন হয়েছিল সে আকাঙ্ক্ষার বিনাশ ঘটেছে পুরোপুরি।
এখন একটি শিশু সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন দেখে না, স্বপ্ন দেখে নির্বিচারী অভিভাবকের আকাঙ্ক্ষা পূরণের-যেভাবেই হোক পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার। একজন তরুণ যার স্বপ্ন দেখার কথা ছিল রৌদ্রকরোজ্জ্বল ভবিষ্যত নির্মাণের, সে এখন নেশাগ্রস্ত হয়ে ছুটছে স্বপ্নহীন মিছিলের দিকে।
এসবের প্রধান কারণ হচ্ছে সুশিক্ষার অভাব। সন্তানদের মা-বাবা অবিরাম এগিয়ে যাচ্ছে অর্থ নামক অনর্থের পথে। তাদের পিছু পিছু ছুটছে সন্তানরাও। ফলে কী পাচ্ছে সমাজ? এই প্রশ্নটি সবচেয়ে বড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটি শিশুর হাতে বিনোদন হিসেবে যখন থাকার কথা ছিল একটি বই। তখন মা-বাবা তার হাতে তুলে দেন একটি খেলনা পিস্তল কিংবা মরা মুরগি দিয়ে তৈরি ফাস্টফুড। আমাদের দেশের শিশুরা তাদের মা-বাবার প্ররোচণায় এখন কবিতা-বিমুখ, গল্প-বিমুখ, পরিবেশ-বিমুখ, প্রকৃতি-বিমুখ। কেননা মা-বাবারা খুব সহজে নিজেদের বড়ো হওয়ার জন্য এবং সন্তানদের বড়ো করার জন্য ‘রাজার আদেশপ্রাপ্ত ইতিহাস’-এর প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন।
মা-বাবা গর্ব করে ইতিহাসের কথা বলেন, যে ইতিহাস তৈরি করেছেন রাজারা। ফলে রাজার ভাষায় (রাজার তৈরি করা ইতিহাস) কথা বলছেন প্রজারা। কারণ এখন প্রজারা সব রাজার লোক।
সবার একটি কথা মাথায় রাখা উচিৎ-ইতিহাসবিদরা সব সময় সত্যদ্রষ্টা হন না, হতে পারেন না স্বপ্নদ্রষ্টাও। এদিকে ব্যতিক্রম কবিরা। তারা যেমন সত্যদ্রষ্টা, তেমনি স্বপ্নদ্রষ্টাও। কাজেই কবিতা যারা পড়েন না, তারা ‘স্বপ্ন’ শব্দটাকে অলীক ভাবেন। এর ফলে কী হচ্ছে? এ সময়ের তরুণ সমাজ বেপথু হচ্ছে। বুঝে না বুঝে তারা ধর্ম নয়, ধর্মীয় গোড়ামিকে আঁকড়ে ধরছে কথিত জান্নাতুল ফেরদৌস নামক সোনার হরিণ পাওয়ার লোভে। এই লোভ সম্বরণ করার সাধ্যি কারও নেই। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে, হলি আর্টিজান নামক দুঃস্বপ্ন, ক্যাসিনো নামক মরণব্যাধি।
ইতিহাসবিদরা কখনও সত্যদ্রষ্টা হন না, হন না স্বপ্নদ্রষ্টাও। তারা যে রাজার আমলে কাজ করেন সে রাজার মনতুষ্টির জন্য রাজার গুণবন্দনা করেন। এসব লেজুড় ইতিহাসবিদদের পেয়ে রাজারাও খুশি হন। শুধু তাই নয়, ইতিহাসবিদদের হাতে যে সত্য রচনার কথা তা অনেক সময় চাপা পড়ে যায়। সে চাপা পড়া সত্যটি কোনোকালে আর প্রকাশ পায় না। ফলে আমরা দেখতে পাই, পৃথিবীর কোনো ইতিহাস-ই সম্পূর্ণ নয়। কতটুকু সত্য আছে তাও প্রমাণের জন্য কোনো সুযোগ নেই। এদিক দিয়ে অধিকাংশ কবি ইতিহাসবিদদের চেয়ে অনেক বেশি সৎ। তারা ক্ষমতার ধারে-কাছে যান না, ধারও ধারেন না, (অবশ্য রাজ কবিদের কথা এখানে বলা হচ্ছে না)। যেসব কবি ক্ষমতাসীনদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন তারা অতীতেও জনগণের কাছে টিকতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না।
সত্যিকার কবি-সাহিত্যিক যারা, তারা কোনোদিন কারও কাছে মাথা নত করেননি। আপোস করেননি কোনো মিথ্যের সঙ্গে। তারা অন্ধকারকে অন্ধকার বলে, আলোকে আলো। তারা যখন যে সমাজকে যেভাবে দেখেছেন, তাই তারা খাতার ভাঁজে লিখে রেখেছেন। যুগে যুগে আমরা দেখেছি ইতিহাসবিদরা হন আপোসকামী আর কবিরা হন সত্যদ্রষ্টা। স্বপ্নদ্রষ্টা তো বটেই।
১ Comment
congratulations.