বই আলোচনা: তসলিমা হাসান:
বাংলা গদ্য সাহিত্যে এক অমর নাম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। ১৯০৭ সালে তিনি চট্রগ্রামের সন্দ্বীপে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি মূলত গল্পকার হলেও তার হাতেই সৃষ্টি হয়েছে বাংলা সাহিত্যের কিছু অমর উপন্যাসও তাছাড়া নাটকের মতো বৃহৎ পরিসরেও তার অবদান অনস্বীকার্য। আজকে আলোচনা করব সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র “নয়নচারা” গল্পগ্রন্থ নিয়ে। “নয়নচারা” গল্পগ্রন্থে মোট আটটি গল্প রয়েছে। প্রতিটি গল্পই জীবন স্পর্শী যেন জীবনের এক অজানা তীর হয়ে বুকের মধ্যে বিদ্ধ হয়েছে।
যে গল্পগুলো আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে এবং জীবন থাকতে হয়তো কোনদিন এ-ই গল্পগুলোর রেশ আমার কাটবে না। সে গল্পগুলো হলো।
১. নয়নচারা ২.জাহাজী ৩. পরাজয় ৪. মৃত্যু-যাত্রা ৫.খুনী ৬.রক্ত
১. নয়নচারা
নয়নচারা মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার এক গল্প। গল্পটি ভেতর ও বাহিরের বাস্তবতার চিত্র লক্ষণীয়। কাব্যিক বর্ণনা ও স্নিগ্ধ অন্তবাস্তবী এ-ই গল্পে রোমান্টিকতার কোন পরিসর দেখা যায়নি। ক্ষুধা ও হাহাকারে পূর্ণ এ-ই গল্পটি জীবন হয়ে ঢুকে গেছে জীবনের আরেক বাস্তব চিত্রে। এ-ই গল্পে উঠে এসেছে ময়ূরাক্ষী নদীর তীরবর্তী মানুষের দুঃখ দুর্দশা। ক্ষুধার্ত মানুষের, অভাবের জীবনে শান্ত ময়ূরাক্ষী নদী তাদের দূর্যোগের প্রকাশ করেছেন তার কুয়াশা দিয়ে।
গল্পটির সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে ১৩৫০ এর দুর্ভিক্ষে পেটে ক্ষুধা নিয়ে কলকাতার শহরের পথে ঘূর্ণায়মান কিছু মানুষ যাদের একজনের নাম আমু। তাদের মধ্যে অনাহারে মরে যাচ্ছে কেউ কেউ। কেউ কেউ একটু খাবারের আশায় দোকানে যায় এবং তাড়া খায়। কিন্তু এ-ই দুর্ভিক্ষে কেউ তাদের সাহায্য করে না। এতো বিতাড়িত হওয়ার পরে যখন একটি অচেনা মেয়ে তাকে ভিক্ষে দেয়, আমু তখন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন “নয়নচারা” গাঁয়ে কী মায়ের বাড়ি?
এ-ই একটি কথাই নয়নচারা গল্পের নির্ণীত তাৎপর্যকে বহন করে। আমুর কাছে তার গ্রাম ছিলো তার স্বর্গ সেখানে তারা সবাই সুখে শান্তিতে ছিলো। তার গ্রামের মানুষ মানেই স্নেহশীল ও দরদী। যদিও যে মেয়েটি ভিক্ষে দিয়েছে তার বাড়ি নয়নচারা গ্রামে নয় কিন্তু আমু তাই মনে করেছে তার গ্রামের মেয়ে। তা না হলে ভিক্ষে দিবে কেন! শুধু তার নিজের গ্রামেই তার মা মায়ের মতো মমতাময়ী। নয়নচারা গ্রামের মানুষেরাই কেবল ভালোবাসায় অনেক বড়ো হয় তারা যেখানেই থাকুক যে জায়গাতেই থাকুক কেবল তারাই সাহায্য করতে এগিয়ে আসে।
নিজেদের শেকড়ের প্রতি টান। নিজের পল্লীর মমতা জড়ানো ময়ূরাক্ষী নদী। আমু চরিত্রটি শহরে এসেও বিভিন্নভাবে নিজের গ্রামকে খুঁজেছেন কখনো শহুরে মেয়ের ঘনকালো চুলে দেখেছেন নিজের গাঁয়ের মেয়ের মুখ আবার কখনো দেখেছেন মাথার চুলে হাওয়ায়
দোলানো ধানক্ষেত।
গল্পের চরিত্রগুলো ছেয়ে আছে নিরাশার ঘনমেঘে। একটা চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে তারা গ্রাম নদী ও স্নেহময়ী প্রকৃতিরকে দেখতে পেয়েও যেন কিছুতেই এই চোরাবালি থেকে বের হতে পারছে না তারা। গল্পটিতে শহুরের হৃদয়হীনতা ও বাস্তবতার পাশাপাশি গ্রামীণ মানুষের সাধারণ সুখ হাসি কান্নার চিত্র দারুণভাবে উঠে এসেছে।
✑ কলমে- তসলিমা হাসান
কানাডা: ১০-১০-২০২১