১৩২ বার পড়া হয়েছে
ছোটবেলায় আমার বোন রিমি ছিল দস্যি টাইপের। সে আবার বান্ধবী প্রিয় মানুষ। আমরা যখন ঢাকা মুগদার বাসায় থাকি তখন সে মাত্র ক্লাস টুতে পড়ে।
সারাক্ষণ আম্মার বালিশের নিচ থেকে পয়সা নিয়ে ( এটাকে ঠিক চুরি বলে না। ভদ্র ভাষায় সম্ভবত পয়সা সরানো বলে )
চালতার আচার আর হজমি কিনে খেতো।
যেদিন আম্মা দুপুরে একটু ঘুমাতেন বা শাজহানপুর নানার বাসায় যেতেন, সেদিন ছিল তার ঈদ। রাজ্যের বান্ধবীদের নিয়ে সেদিন সে ছাদে নয়তো বাসার সামনে বরফ পানি খেলতো। অথবা দুই তিনজন মিলে চলে যেতো কমলাপুর। তার প্রিয় বান্ধবীর বাসায়।
একবার ঈদের সময় আমি আব্বা আর রিমি গেলাম মৌচাক মার্কেটে। স্কার্ট কিনলাম দুজনে। এরপর সে বায়না ধরলো ডিসকো হিল কিনবে। এই দোকান ওই দোকান ঘুরে আব্বা তাকে ডিসকো হিল কিনে দিলেন এবার আমার পালা। এদিকে আমি লজ্জায় বলতেও পারছি না আমারও ডিসকো হিল চাই। আব্বা আমাকে কিনে দিলেন বাটার কালো সু আর সাদা মোজা।
আমি চুপচাপ বাটার এক সাইজ বড় সু আর দুই সাইজ বড় মোজা নিয়ে মরণ চাঁদের মিষ্টির দোকানে মিষ্টি খেতে গেলাম। চোখে পানি এসে যায়, এসে যায় অবস্থা। কিন্তু কাঁদলে রিমি নির্ঘাত ক্ষেপাবে। তাই মিষ্টি কোনমতে মুখে দিলাম, মাছের কাঁটার মতো মিষ্টি গলায় আঁটকে থাকলো। আমরা বাসায় ফিরে আসার পরে শুরু হলো আসল কাহিনী।
পরদিন ঈদ, আব্বা গেছেন ভালো গরুর মাংস আর দেশী মোরগ কিনতে।
আম্মা সেমাই ভাজাভুজি, পর্দা ইস্ত্রি করা, এসব নিয়ে ব্যস্ত। সে আম্মার কাছে বায়না ধরলো সে চুরি আর মালা কিনবে। বাসার সামনেই একটা বড় স্টোর আছে সুতরাং ভাবনা নেই। আম্মা তার জামা পালটে মুখ মুছিয়ে দিলেন ( অনবরত চকলেট নয়তো কৎবেল মাখানো খাওয়ার ফলে তার মুখ সবসময় আঠা আঠা হয়ে থাকতো )
তারপর আমাদের দুই বোনকে দশ, দশ বিশ টাকা দিয়ে বললেন যাও মালা কিনে আনো। আমরা নানান রঙের পুঁতির মালা কিনে হাসতে হাসতে বাসায় এলাম। আম্মার কাজ তখনো শেষ হয়নি। আম্মা মশলা বাটাচ্ছেন বুয়াকে দিয়ে। সব কাজ শেষে সন্ধ্যায় আব্বু ফিরলেন। এসেই আমাদের দুজনকে দুটো প্রজাপতি চুলের ক্লিপ দিলেন। আমি আমার ক্লিপটা নিয়ে দৌঁড়ে আয়নায় নিজেকে দেখছি। এদিকে রিমি কোত্থাও নেই। আব্বা আশেপাশে খুঁজে দেখলেন। আমি পাশের বাসায় গিয়ে দেখলাম নেই নেই কোত্থাও নেই। এদিকে সন্ধ্যা শেষে রাত নামছে।
আম্মা কাঁদতে লাগলেন। প্রতিবেশী আন্টিরা ছুটে এলো আম্মাকে স্বান্তনা দিতে। তাদের সাথে এলো একদল কচিকাঁচা। আমাদের ছোট্ট বাসাটায় হাট লেগে গেল। আব্বা ছোটাছুটি করছেন মাইকে ঘোষনা দেয়ার জন্য। এমন সময়ে রিমি ফিরে এলো। তেমন কিছু না, উনি ঈদের আগের রাতে বান্ধবীর ম্যাচিং চুড়ি কিনতে কমলাপুর চলে গিয়েছিলেন।
এর এক বছর পরে আমরা পাবনা চলে আসি। রিমি ম্যাডাম তখন ক্লাস থ্রিতে উঠেছেন তার ভাবই আলাদা। বান্ধবী বেড়ে প্রায় গোটা দশেক হয়েছে। উনি দারুল আমান একাডেমীতে ভর্তি হয়েছেন।
সবুজ ফ্রক আর সবুজ স্কার্ফে তাকে লাগে সবুজ পরীর মত। ( আমি বলিনি আব্বা বলেছিলেন।) উনি সারাদিন বড়ই কুড়ান।
মোহন চাচার বাড়ি থেকে জামার কোঁচর ভর্তি করে ‘বকফুল’ নিয়ে আসেন বড়া খাওয়ার জন্য। বন্দনাদের পুকুরে গোসল সেরে যখন ফেরেন দুই চোখ রক্ত জবার মত লাল থাকে। উনি একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলেন না। আব্বার অফিসে খবর পাঠানো হলো। আম্মা, মামা, আঁখি ফুপু খুঁজে খুঁজে হয়রান। আব্বা এসেই স্কুলে গিয়ে খোঁজ নিলেন। দারোয়ান ছাড়া কেউ ছিল না, তাই তেমন কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। আম্মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন ঠিক পুকুরে ডুবে গেছে। তার ছিল চারটা বড়শী এবং সে বড়শী দিয়ে মাছ মারাতেও ছিল ওস্তাদ টাইপ।
মাইকে ঘোষনা হচ্ছে ‘ একটি বিশেষ ঘোষনা…….।
মাইক শুরু হওয়ার আধঘণ্টার মধ্যে রিমি বাসায় এসে হাজির। সে ছুটতে ছুটতে আসছে আর বলছে ‘ আম্মা দেখো, ঠিক আমার নামের আমার মত সবুজ ড্রেস পরা একটা মেয়ে হারিয়ে গেছে। ‘ আম্মা ওকে জড়িয়ে ধরে বললেন ‘ আর তুমি কই ছিলা মা?
– আমি তো বিন্দুদের বাসায় ভিসিআর দেখছিলাম আম্মু।
– আম্মু আর কী করেন এই দস্যিকে নিয়ে যেখানেই যায় যন্ত্রণা করবেই। আমরা যে বাসাটায় থাকতাম মস্ত একটা বাড়ি পিছনে ছিল বড়ই আর আম গাছ। সেখানে একটা বড় শিউলিগাছ ছিল। গাছটি ছিল রিমির দখলে সে প্রতি সকালে ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথতো।
– শ্রদ্ধেয় ‘বয়েন স্যারের ‘ বাসায় যখন আমরা থাকি তখন দোতালায় আমাদের বারান্দা দিয়ে গ্যারেজের ছাদে যাওয়া যেতো। সেই গ্যারেজের ছাদ আর বারান্দা ছিল ‘রিমির প্রিয় জায়গা ‘। ও কোথা থেকে একটা টব যোগাড় করে একটা গাঁদা ফুলের চাড়া এনে লাগালো। কী তার যত্ন আত্তি !
– আব্বা খুশি হয়ে ওকে দশটি টব কিনে দিলেন। সাথে বেশ কয়েক রকম ফুলের চাড়া। ও টাকা জমিয়ে আম্মার কাছে কান্নাকাটি করে আরো দশটি টব কিনলো। সাথে কয়েক জাতের গোলাপ জবা, গাঁদা, বেলি ফুলের চাড়া কিনে যত্ন শুরু করলো। দেখতে দেখতে একদিন সকালে হেসে উঠলো ওর ক্ষুদে ছাদবাগান। কালিদাস স্যার খুব প্রশংসা করতেন রিমির এই বাগানকে।
– আম্মা হেসে হেসে সবাইকে বলতেন – আমার এই দস্যি মেয়ের হাতে যাদু আছে যেখানেই কিছু লাগায় সোনা ফলে।
– এরপরে আমরা একসময় একটু বড় হয়ে উঠলাম। ফ্রক ছেড়ে কামিজ ধরেছি। কোন এক অজানা কারণে কোন দুষ্টু কিশোরের দুষ্টু দুষ্টু কর্মকাণ্ড দেখলে রঙ ছাড়াই গালে ছোপ ধরে।
– একদিন আমাদের বাসায় আমার চার বান্ধবী বেড়াতে এলো। ওরা এসে আমাকেও ওদের সাথে বেড়াতে নিয়ে গেল। আমরা পাঁচজন একই রঙের জামা পরে বাসার নিচ দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছি। আম্মা তখন বললেন – ঠিক যেন রিমির টবের গাছের পাঁচটি গাঁদা ফুল। ইশ কী সুন্দর। মা শা আল্লাহ্।
বহু বছর পরে আবার রিমির হাতে লাগানো বাগান দেখলাম। ওদের মস্ত সুবিধা বিশাল বাড়ি। ইচ্ছেমত গাছ লাগায়। আলাদা বাগান করে। অবাক হয়ে দেখি একটা গাছে। ঠিক ঠিক পাঁচটি গাঁদা ফুঁটে আছে।
হঠাৎ আম্মার সেই কথাটিই মনে পড়লো। সময় অনেক গড়িয়ে গেছে। আমরা সবাই এখন অন্যের ঘরণী, সন্তানের জননী।
তবুও ইচ্ছে করে আগের মত আবার এক হই। আবার একসাথে হাত ধরাধরি করে প্রিয় কোন রাস্তায় হেঁটে যাই। একদিন ভুল সুরে হারিয়ে যাওয়া কোন গান গাই। একদিন বৃষ্টিতে ভিজি । শীতে কাঁপতে কাঁপতে টঙ দোকানের চা খাই। আমি জানি না আমার এই সাধ পূরণ হবে কী না। তবুও মনে মনে ডাকি ওদের – আয় আরেকটিবার আয় রে সখা প্রাণের মাঝে আয়। মোরা সুখের দুঃখের কথা কবো প্রাণ জুড়াবে তায়।
বন্ধু কেমন আছিস বল
নিতু ইসলাম।
২ Comments
ছেলে বেলায় চলে গেলাম, আবারও যেতে চাই।শুভকামনা রইল।
congratulations