একটি ভ্রমণ ও কিছু উপলব্ধি
নাসরিন সুলতানা
সাল ২০১৪। ফেব্রুয়ারী মাসের ১৪। সেদিন বাসা পাল্টালাম।বরাবরই বাসা পাল্টানোর সময় আমার হাজবেন্ড বাসায় থাকে না।তার বাসা পাল্টানোতে খুব ভয়।তো সে ঢাকায় যেয়ে বসে আছে।আমরা নতুন বাসায় উঠে কোন রকম একখান খাট খাটিয়ে মা আর মেয়ের শোয়ার ব্যবস্হা করে নিলাম।আর রান্না করার সরাঞ্জাম গুলো ঠিক করে নিলাম।পরের দিন ফোন এলো তোমরা চলে এসো সাদি আর দোলন কক্সবাজার। আমাদের যেতে বলছে।কালই রওনা দাও।এলোমেলো ঘর বাড়ি রেখে চলে গেলাম।ঢাকায় যেয়ে এক আত্মীয়র বাসায় রাত কাটিয়ে ভোর সাতটার গাড়িতে রওনা দিলাম কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। পথে মা মেয়ে বমি করতে করতে হয়রান।আমার হাজবেন্ডের সাথে কোথাও গেলে আমাদের বমি হয়।আমরা মা মেয়ে ঢাকা পর্যন্ত গেলাম কোন বমি না আর ঢাকা কক্সবাজার রোডে উঠলেই বমি।কারণটা হলো ও আমাদের খাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।এটা খেয়ো না ওটা খেয়ো না।আর টেনশন দিয়ে মাথাটা ভর্তি করে দেয়। অগত্যা বমি হয়।সাথে গালি খেতে খেতে পেট ভরতে হয় সারা পথ।কুমিল্লা ঢুকতেই বলতে শুরু করলো তোমরা বাড়ি ফিরে যাও।আমি বললাম এখান থেকে বাড়ি ফিরতে গেলেও তো একই অবস্থা হবে।
প্রায় আধমরা হয়ে কুমিল্লায় নেমে একটু হাত মুখ ধুয়ে হালকা খাবার খেয়ে আবার গাড়িতে উঠলাম। কক্সবাজার যখন পৌঁছেছি তখন রাত সাড়ে আট।সাদি দোলন আমাদের নিয়ে নির্দিষ্ট রুমে পৌঁছে দিলো।তারপর গরম পানিতে গোসল সেরে একটু রেস্ট নিয়ে সমুদ্র পাড়ের হোটেলে গেলাম খেতে।সামুদ্রিক মাছ আর ভাত খেয়ে হোটেলে এসে শুয়ে পড়লাম।দুই সীটের রুম নিয়েছি আমরা। কারণ আমরা তিন জন।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমরা সবাই সমুদ্র স্নানে বের হলাম।আমার আবার শীতের ভয়।গোসল করলে শীত লাগবে বলে নামেনি।তাছাড়া স্টুডেন্ট লাইফে একবার সমুদ্র স্নান করেছি। তখন গায়ের তেজ ছিলো বেশি।সাদি বললো সবাই সমুদ্রে আসে সমুদ্র স্নান করতে আপনি নামলেন না তো।আমি বললাম ইচ্ছে করছে না।মেয়ে আর বাবা খুব মজা করে স্নান সারলো।কারণ ওদের জীবনে এটা প্রথম।তবে সেখানে অনেকে প্যারাসুটে উড়ছিলো।সেটাতে উঠতে আমার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিলো।তবে উঠার উপায় কই।কর্তার দাঁত ঝাড়াতে সব স্বপ্ন কালো মেঘে ঢেকে যায়।মনের ইচ্ছা মনে চেপেই থাকলাম।তারপর রুমে ফিরে কাপড় পাল্টিয়ে আবার খেতে বের হলাম।সকালের নাস্তা সেরে আমরা সেন্টমার্টিনের টিকিটের খোঁজ করে রুমে এসে রেস্ট নিয়ে বিকেলে বের হলাম সমুদ্র সৈকতে।তারপর ঘোরাঘুরি। ঝাউবনে হাঁটলাম কিছুক্ষণ।ওরা খুব আনন্দ পাচ্ছে কারণ ওরা এখানে প্রথম।আমার সব আনন্দ এখন সেন্টমার্টিনের দিকে।তারপর কাউন্টারে এসে টিকেট কেটে নিশ্চিত হওয়া গেলো আমরা কোন জাহাজে যাচ্ছি।আমাদের জাহাজ ছিলো ভি আই পি।নামটা মনে নেই।ওখান থেকে রাতের খাবার শেষ করে রুমে ফিরলাম।পরদিন ভোরে সাতটায় গাড়ি করে টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।গাড়িতে যেতে যেতে রাস্তার দুপাশে লবণ তৈরীর মাঠ দেখলাম।কি সুন্দর করে সমুদ্রের পানি আটকে রেখে রোদে শুকিয়ে লবণ তৈরী করছে। তাছাড়া নৈসর্গিক অপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতে আমাদের গাড়িটি নাফ নদীর দিকে এগুতে লাগলো। গাড়ি কতৃপক্ষই নাস্তা দিয়েছিলো।গাড়ির ভিতর খাওয়া দাওয়া সেরে জাহাজ ঘাটে নামলাম।নাফ নদী দেখে খুব ভালো লাগলো। অনেক গুলো জাহাজ আছে ঘাটে যাদের যেটা তারা সেই নির্দিষ্ট জাহাজে উঠে গেলো।নাফ নদীর ওপারে উঁচু উঁচু পাহাড়।পাহাড়ের গা ঘেঁষে মায়ানমার।দেখতে অতি মনোরম। দু চোখ ভরে দেখেই যাচ্ছি নেশা মিটছে না।আমরা এবার আমাদের জাহাজে উঠলাম।পানির জাহাজে ওঠা এই প্রথম।জাহাজে উঠে দেখি সবাই ভদ্রজন।কেউ শুধু দম্পতি। কেউ বউ বাচ্চা সহ।সবার ভিতর একটা আনন্দ আমেজে ভরপুর। আমার আবার সবার মুখের দিকে তাকিয়ে অবজার্ভ করার দোষ।কে কেমন আনন্দ করছে।কে কেমন করে হাজবেন্ডের সাথে ঢলাঢলি করছে।তাদের কথোপকথন এসব দেখতে আমার ভালো লাগে।তো জাহাজের হরেক দম্পতির ভিতর এক ভদ্রলোকের পাশে তার মেয়ে বসে আছে মনে হলো।লোকটা শুধু বলছে আমার সাথে আমার ফ্যামিলি আছে।আর আমি দেখছি শুধু একটা মেয়ে।মেয়েটা ভদ্রলোকের পাশে নিরানন্দ মুখ নিয়ে যেন জোর করে বসে আছে।আমি শুধু ভাবছি লোকটার বউ কই।মেয়েটা একবার উঠলো পুরুষ টা পিছন পিছন গেলো।মনে হলো টয়লেট সমস্যা।
যাই হোক আমরা যে জাহাজে গেছি বিকালে আবার ঐজাহাজে কক্সবাজার ফিরবো।জাহাজ চলছে। পানির বুক চিরে। আমরা ভিতর থেকে জাহাজের ছাদে উঠলাম।জাহাজের সামনে সমুদ্র পায়রা উড়ে উড়ে আসছে।সবাই মজা করার জন্য তাদের খাবার দিচ্ছে।পায়রা গুলো খাবার খাওয়ার জন্য পানিতে একটি অপূর্ব দৃশ্য তৈরী করছে।পাহাড় পানি সবুজ গাছ আর আকাশ দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম সেন্টমার্টিনে।জাহাজ থেকে নেমেই সেন্ট মার্টিনের বাজার সেখানে দোকান পাট খাওয়ার হোটেল গুলো পরখ করলাম।মেয়ে বললো আমার একটা ড্রেস কিনে দাও।ওর জন্য সেন্টমার্টিনের বাজার থেকে মারমাদের তৈরী ড্রেস অর্থাৎ থামি আর ব্লাউজ কিনে দিলাম।আমরা তখন ভাত খাওয়ার ক্ষুধায় জর্জরিত। আমরা খাব সাদি বললো খাব না।ওরা আগে ঘুরবে।আমরা ওদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম।একটা হোটেলে ঢুকে বেলে মাছ ভাজি ডাল আর ভাত খেয়ে আস্তে আস্তে রওনা দিলাম হুমায়ুন আহমেদের বাড়ির দিকে।কত স্বপ্ন দেখেছি।কত কল্পনা করেছি সমুদ্র বিলাস দেখবো বলে।আজ সেখানে পৌঁছে গেছি।আমার হাজবেন্ড হাঁটতে ওস্তাদ। আমরা যেখানে যায় ও আমাদের হাঁটিয়ে ক্লান্ত করে ফেলে।আমাদের আনন্দটা তখন কষ্টের হয়ে দাঁড়ায়। কেউ হাটছে কেউ ভ্যানে।আমরা বললাম একটা ভ্যান নাও।কারণ মেয়েটা অতদূর হাঁটতে পারবে না।এবার একটা ভ্যান নিয়ে পৌঁছে গেলাম কাঙ্খিত স্হানে।আহা কি সুন্দর কেয়া বন।কেয়া গাছে কুচ ফল।ছোট বেলার ধাঁধার কথা মনে পড়ে গেলো
রক্তে ডুবু ডুবু কাজলের ফোটা
এই মানে যে না বলতে পারবে সে আসলেই বোকা।সে উত্তরটা ছিলো কুচ ফল।ছোট বেলায় এ কুচ ফলের মালা গাঁথতাম আর কেয়া বাগানের কেয়া ফুল ছিড়ে পাউডার মাখতাম।কেয়া ফুলের সে পাউডারে একধরনের সুগন্ধি থাকতো।
আবার দেখা হলো সে ফলের সাথে।কিছু কুচফল ছিড়লাম।মনে হলো বপের বেটা হুমায়ূনের চোখ কখনো ভুল হতে পারে না।অপূর্ব অপরূপ দৃশ্য।সারি সারি নারকেল গাছ।সমুদ্র সৈকত আর তার পাড়ে সমুদ্র বিলাস।আমি মনে করতাম সমুদ্র বিলাস হুমায়ূন আহমেদের বাড়ি মনে হয় অট্টালিকা। কিন্তু তা নয়।প্রকৃতির কোলে যেন প্রকৃতিরই একটি কুটির। সেখানে গেলে মন এমনি শান্ত স্হির হয়ে যায়।ভাল লাগার নক্সি বুননে অপরূপ সেন্টমার্টিন সমুদ্র সৈকত। এবার সমুদ্র সৈকতে হাঁটতে শুরু করলাম।কি অপরূপ।স্বচ্ছ নীল পানি বড় বড় কোরালের ধ্বংসস্তূপ পানির ভিতর ভাসছে।অাধেক ডুবে আধেক উপরে। ওর উপর উঠে কিছু ছবি তুললাম।পিছনে নীল সমুদ্রের পানি আছড়ে পড়ছে।ভাললাগার এক অকৃত্রিম অনুভব হৃদয়ে প্রশান্তি ডেকে আনছে।কিছু দূর বালিতে হাঁটলাম।লাল কাঁকড়া গুলো কেমন তিরতির করে দৌঁড়ে পালাচ্ছে।রঙিন শামুক ঝিনুক গুলো পাড়ে আছড়ে পড়ছে।এসব সময়ের মধ্যে একটু ডাবের পানি খেলাম।
সমুদ্র আর আকাশের মিতালী মোহনায় বার বার নিজেকে হারিয়ে ফেলছি।মন চাচ্ছে না এখান থেকে ফিরে যায়।ছেড়া দ্বীপে যাব বলে বড় আশা করে এসেছিলাম। কিন্তু যাওয়ার সময় হলো না।কারণ জাহাজে চারটার ভিতর ফিরতে হবে।মনের আফসোস আর কিছু স্মৃতি নিয়ে জাহাজের দিকে রওয়ানা হলাম।জাহাজে উঠে দেখলাম কিছু নতুন মানুষ। ছেঁড়া দ্বীপ দেখা হলো না বলে আমরা যখন আফসোস করছিলাম তখন একজন লোক বললো সেন্ট মার্টিনে এসে একরাত থাকলেই তবে মন ভরে দেখা যায়।আমরা গতকাল এসেছিলাম।আজ ফিরছি।আসলে বুঝলাম আমাদের সাথে যারা এসেছিলো তারা কিন্তু সবাই ফেরেনি।রাতের জোছনা সমুদ্র কেয়া বন এসব হেঁটে হেঁটে পরখ করতে হয়।ছেঁড়া দ্বীপ ও ভালোভাবে দেখা য়ায়।তখন তো আমার হাজবেন্ড বলছে চলো জাহাজ থেকে নেমে ফিরে যায়।আমরা রাত থাকবো।মাঝে মাঝে তার পাগলামি এমন প্রকট হয়।তখন সেই ভদ্রলোক যার সাথে ছোট একটা মেয়ে আছে উনি বললেন এখন ফেরার দরকার নেই।আবার একবার এসে দেখবেন।আমাদের বমির টেনডেন্সি আছে বলেই আমি বললাম এবার আমরা ঢাকা থেকে প্লেনে আসবো।ঢাকা থেকে প্লেনের ভাড়া কত এটা জানতে চাইলে ঐ ভদ্রলোক বললো আমরা দু’জন আসছি সাড়ে আট হাজার করে ভাড়া।তখন ও বুঝতে পারেনি ঐ মেয়েটা ঐ ভদ্রলোকের বউ।আজ অনেক দিন পর বুঝলাম ও মেয়েটা উনার বউ।হয়তো হানিমুনে এসেছিলো।কোন বাবা হয়তো তার মেয়েকে টাকার কাছে বলী দিয়েছে।মেয়েটা যে ঘুরতে এসেছে তার মুখে কোন সময় হাসি দেখিনি কিংবা প্রফুল্লতা।সে যেন মেঘে ঢাকা আধ ফালি চাঁদের মত ম্রিয়মান। জোছনা আছে কিন্তু মেঘে ঢেকে যাচ্ছে।তখন আনন্দের ভীড়ে অত ভাববারও সময় পায়নি।মাথায় আসেনি অত বয়সের ডিফারেন্সে বিয়ে হতে পারে।বার বার বলছিলো আমার সাথে ফ্যামিলি আছে।আর আমি শুধু খুঁজছিলাম তাঁর ফ্যামিলি কই।এতো মেয়ে।বাকী পরিবারের সদস্যগুলো কোথায়।কিন্তু এখন বুঝছি কারণ তারা মাত্র দু’জন ছিল। থাক সে কথা।
তারপর টেকনাফে নেমে আবার নির্দিষ্ট বাসে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। রাত আটটার দিকে কক্সবাজার পৌঁছে ছোটখাটো কিছু জিনিস কেনাকাটা করে একটা হোটেলে খেলাম।শুটকি ভর্তা,মাছ আর ডাল।মেয়ে খেলো সাথে গরুর কালাভুনা।তারপর ওখান থেকে অটো করে হোটেলে আসলাম। হোটেলে এসে সী বীচের রেস্তোরায় কাঁকড়া ফ্রাই নিলাম।কি মজাদার স্বাদ।রাতে সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে বেশ।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের সেই গর্জন শুনলাম।তরপর রুমে এসে ক্লান্তির কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরের দিন সকালের নাস্তা সেরে ডুল হাজরার সাফারি পার্কের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।ওখানে যেয়ে শুনি ভিতরে কোন খাবার নেওয়া যাবে না।নিলেও খাওয়া যাবে না।তবু্ও নিষেধ অমান্য করে আমরা খাবার নিলাম। কারণ অতটা এরিয়া হেঁটে হেঁটে দেখবো।অনেক সময় লাগবে তারপর ক্ষুধা লাগলে তো সমস্যা। অনেকে অটো করে ঘুরে দেখে। কিন্তু আমরা খুব ভাল করে দেখবো বলে হেঁটে হেঁটে দেখলাম।প্রথমে বিভিন্ন পাখি দেখলাম। সাদি পাখি গবেষক এই কারণে সে আর দোলন সব পাখির নাম প্রজাতি এবং অন্যান্য বায়োডাটা লিখতে লাগলো।একটা ছোট সুন্দর লেক আছে।তাতে অনেক সুন্দর জলজ উদ্ভিদ ছিলো। দেখতে খুব সুন্দর। ওখান থেকে আমরা এবার হাঁটতে শুরু করলাম।পথে হাতির দেখা পেলাম।মুক্ত ভাবে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছু দূর যাওয়ার পর একটা টাওয়ার দেখতে পেলাম। সেই টাওয়ারের উপর উঠে বন অবজার্ভড করা হয়।সেটার উপর উঠে উপর থেকে বনটা দেখলাম। সেখান থেকে নিচে নেমে কিছু দূর যেতে জলহস্তিদের মাতামাতি দেখলাম।দুপুরে ওদের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।হঠাৎ দেখি একটা অটো বোঝাই করে মিস্টি আলুর গাছ এনে ডোবার পাড়ে ঢেলে দিলো। হস্তি গুলো সেগুলো খেয়ে সাবাড় করে দিলো।তারপর একটা বানরের খাঁচার কাছে এসে সে গুলো দেখে।পূর্ববর্তী জায়গা ফিরে এসে সেই খাবার গুলো বের করেছি। অমনি চারিদিক থেকে হনুমান এসে খাবার নিয়ে দৌঁড়। তাড়াতাড়ি বাকি কিছু খাবার অতি সাবধানে আরো একটু গেটের দিকে এসে খুব দ্রুত সাবধানে খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।বেরিয়ে সাদি আর দোলন যাবে সাজেক ভ্যালি আর আমার হাজবেন্ড যাবে নাইক্ষ্যংছড়ি।ওরা আলাদা হয়ে গেলো।আমরা নাইক্ষ্যংছড়ির বাস ধরে এগিয়ে গেলাম অনেক চরাই উৎরাই পেরিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ির বাজারে পৌঁছে লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় থাকা যায়। আবাসিক কোন হোটেল ভালো নেই বিধায় রেস্ট হাউজ ভাড়া নিলাম।রাতটা কাটিয়ে পরের দিন সকালে ওখানকার একটা ছোট পাহাড়ি পার্ক মনে হলো সেটা ঘুরে দেখে আমরা নাইক্ষ্যংছড়ি বাজার থেকে ১৫/২০ কিলো দূরে একটি গরুর খামার ঐ গুলোকে গয়লা বলে মনে হয় সে গুলো দেখার জন্য রওনা হলাম।সেদিন আবার একুশে ফেব্রুয়ারি।চারিদিকে একুশের গান।বেশ ভাষার মাসে একটা বাঙালি বাঙালি ইমেজ।দাঁড়িয়ে আছি সে বাজারে কিছু খাওয়ার জন্য বড় বড় বাদাম সেদ্ধ দেখে কিউরিওসিটি নিয়ে কিনে খেয়ে দেখলাম বেশ ভাল লাগে।এর আগে কখনো খাইনি।তারপর গাড়িযোগে গয়লা খামার।উঁচু পাহাড়ের উপর একটা বিল্ডিং সেখানে একজন অফিসার আর কেয়ার টেকার থাকে। আমরা সে বাসায় যেয়ে টয়লেটের কাজ সেরে নিলাম। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে দেখলাম বড় বড় গয়লার গলায় বড় বড় কাঠ ঝুলানো।আর ওগুলো উদোম পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাঠ ঝুলানোর কারণ ও গুলো যেন দৌড়ে পালিয়ে যেতে না পারে।বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আবার রেস্ট হাউজে ফিরলাম। পরের দিন সকাল বেলা চিটাগাংএর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।চিটাগাংএ আমাদের এক রিলেটিভের বাসায় উঠলাম।পরের দিন সবাই মিলে সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক দেখতে বের হলাম।ওখানে পৌঁছে একটা জলপ্রপাত দেখতে পেলাম।খুব উঁচুতে। এ পাশে পার্ক মাঝখানে একটা ছোট লেক বা ঝর্ণা হবে আর তার ওপাশে জলপ্রপাত। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল নিয়ে পড়তাম তখন শিক্ষা সফরে গিয়ে মাধব কুন্ড জলপ্রপাত দেখেছিলাম।কিন্তু তার উপরে উঠে দেখার সুযোগ হয়নি।আমাদের অনেক বন্ধু উপরে উঠেছিলো।কিন্তু আমি আর আমার এক বান্ধবী স্যারের বকা খেয়ে উপরে উঠতে পারেনি।তাই একটা আফসোস ছিলো জীবনে যদি একবার সুযোগ পাই তাহলে জলপ্রপাত কোথা থেকে কিভাবে আসে নিজ চোখে দেখবো।এবার সুযোগটা হলো।কিন্তু কেউ উঠতে দিবে না।কারণ এটা এত উঁচু যে মেয়েরা এই পাহাড়ের উপর উঠতে পারে না।সাহসী পুরুষরা ওঠে।আমি সবার নিষেধ অমান্য করে উঠে পড়লাম।আমার হাজবেন্ড গালি দিতে লাগলো।আত্মীয়রা বলতে লাগলো সাহস ভালো কিন্তু দুঃসাহস ভালো না।আমি বললাম চেষ্টা করছি পারলে উঠবো না পারলে নেমে পড়বো।তোমরা এমন করছো কেন?আমি ভূগোলের টিচার।জলপ্রপাত সচক্ষে দেখা আমার প্রয়োজন।তাছাড়া বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের বিভিন্ন স্হানে ব্যথা হয়।আমার আর সুযোগ নাও হতে পারে।সবাইকে উপেক্ষা করে উঠতে থাকলাম।একটু উপরে উঠতেই দুটো ছেলের সাথে দেখা। তারা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো আপনি উঠতে পারবেন না আপা অনেক কষ্ট। মেয়েরা এখানে ওঠে না।আমি বললাম চেষ্টা করে দেখি।শেষে তারা বললো আপনি তাহলে এই লাঠিটা নিয়ে ওঠেন।লাঠি নিলে একটু সহজ হবে।সত্যি লাঠিটা আমাকে অনেক সহজ করে দিয়েছিলো।তখন মনে হয়েছিলো বৃদ্ধ মানুষেরা এই কারণে লাঠি ব্যবহার করে।কিছুদূর উঠার পর আমার কষ্টে দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো।আমি চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মনে করলাম নেমে যায়।তারপর আবার মনে করলাম আর একটুখানি উঠে দেখি পাহাড়ের মাথা যদি না দেখতে পাই তাহলে নীচে নেমে যাব।এতদূর উঠা কি আমার বিফলে যাবে।জোর চেষ্টায় পাহড়ের চূড়া দেখতে পেলাম।মনে ভরসা আসলো এবার বুঝি জলপ্রপাত দেখতে পাব।কিন্তু উপরে উঠে হতাশ হলাম।কোন জলপ্রপাত নেই।খুব মনকষ্ট নিয়ে নীচে নামবো এমন সময় দেখি দুজন ছেলে আর একটা পাহাড় থেকে এ পাহাড়ে উঠছে। সেটা এই পাহাড়ের চেয়ে একটু নীচে।আমাকে দেখে বললো আপা আপনি! কি করে উঠলেন? মেয়েরা তো উঠতে পারে না।আমি বললাম জলপ্রপাত কই?তারা বললো জলপ্রপাত দেখবেন? সেটা ঐদিকে।বর্ণনা শুনে মনে হলো আমি একা দেখতে পারবো না।আমি বললাম আমি কি পারবো?ওরা আমার এ অবস্থা দেখে বললো তাহলে আপনার জন্য আমরা আবার যায়।কারণ এতদূর উঠে যদি জলপ্রপাত না দেখা হয় সেজন্য।আমার সাথে তারা গেলো এবং অনেক ঘুর প্যাঁচ রাস্তা পেরিয়ে অবশেষে জলপ্রপাতের দেখা পেলাম।ওরা বললো আমরা সব সময় ঘুরে বেড়ায়।এখানে অনেক বার এসেছি।ওদিকে আমার হাজবেন্ড আমাকে না দেখতে পেয়ে বকাবকি শুরু করেছে।ভাবছে আমি হারিয়ে গেছি। কিন্তু যখন দেখলো আমি নির্দিষ্ট যায়গায় পৌঁছে গেছি। তখন চিৎকার দিয়ে উঠলো।ঐযে ঐযে আবৃতার মা।যা হোক তখন নিশ্চিন্ত হলো যে আমি বেঁচে আছি ভাল আছি।জলপ্রপাতের আঁকা বাঁকা ঝরণা কত সুন্দর করে পাহাড়ের উপর দিয়ে এসেছে না দেখলে যতই বই এর বর্ণনা থাকুক বুঝা অনেক কষ্টের। আমি ছোট বেলার সেই কল্পনার জলপ্রপাতের সাথে আজ প্রত্যক্ষ জলপ্রপাতের অনেক তফাৎ দেখতে পেলাম।আনন্দে মনটা ভরে গেলো।অন্ততঃ একটা ভূমিরূপ নিজ চোখে দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে নীচে নেমে আসলাম।আমার যে আনন্দটা সেটা এভারেস্ট বিজয়ের মত ছিলো।তারপর শুরু হলো বকাঝকা।শুনলাম তবুও আমি তৃপ্ত যে এবার আমার জলপ্রপাত দেখা হলো।পৃথিবীর এমন কত কিছু আছে যা আমাদের মেয়েদের দেখে ওঠা হয় না।কারণ ইচ্ছে থাকলেও আমাদের মাথার উপর একজনের নিষেধাজ্ঞা থাকে।প্রথম বাবা মা পরে স্বামী তারপর ছেলে মেয়েদের। হাইরে জীবন! আমি তখন আমার হাজবেন্ডকে বলেছিলাম এরপর আমার শরীর সুস্থ থাকবে না। বয়সের কারণে বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা হবে।আজ ২০২০ সাল এখন সত্যি আমার কোমরে ব্যথা।পাহাড়ে আর সে ভাবে উঠতে পারবো না।কেওক্রাডং তাজিংডং দেখার খুব শখ ছিলো। কিন্তু আর হয়তো হবে না।নদী পাহাড় বন আর সমুদ্র আমায় খুব টানে।জীবনে যত অপ্রাপ্তি সব যেন ওখানে ফেরত পাই।ভ্রমণে গেলে আমি যেন ছোট্ট খুকি হয়ে যায়। সেই ১৪ সালে ঘোরার পর আর কোথাও তেমন ঘোরা হয়নি।ইচ্ছে আছে মেয়ের এইচএসসি পরীক্ষার পর আবার ঘুরতে যাব।সে পর্যন্ত যেন বেঁচে থাকি ভাল থাকি। এক জীবনে আর কতটুকু বা দেখলাম।ঘরের দরজার খড়কুটো টুকুও কি ভাল করে আমরা দেখার সুযোগ পাই! কখনো পাই কখনো পাই না।
Writer: An professor in a College.