সুযোগ সন্ধানী।
জাকিয়া সুলতানা শিল্পী।
জয়নাল খান একজন প্রযুক্তি নির্ভর সফল কৃষক।জমি চাষাবাদে তিনি সর্বদাই উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। ফসল চাষের ক্ষেত্রে সর্বত্র তিনি উন্নত কৃষি ব্যবস্থাপনার নিয়ম-কানুনের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেন।মাটির পুষ্টি উপাদান থেকে শুরু করে সমস্ত ফসল চাষ পদ্ধতির নিয়ম-কানুনের সবটা পর্যায়ক্রমে সচেতনতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে প্রতিটি পদক্ষেপে ভেবে কাজে লাগিয়ে কৃষি প্রজেক্টের কার্যাবলীতে যথাযথ ভুমিকা পালন করে চলছেন।
সময়োপযোগী কৃষি ব্যবস্থা বিবেচনা করে তিনি উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ ( উফশী ) ব্যবহার করেন। বেশ কয়েক বছর ধরেই তিনি তার বাড়ি সংলগ্ন চারটি উঁচু জায়গা বেছে নিয়েছেন সব্জি চাষাবাদ করবার জন্য। যেহেতু তিনি সচেতন, তাই তিনি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অধিক আয়ের জন্য সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকেন।তার এই চাষাবাদ প্রযুক্তি তিনি বিভিন্ন ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বাজারজাতকরণ করা পর্যন্ত যতোগুলো ধাপ অতিক্রম করতে হয় তার সব গুলোর ছবি ফেসবুকে প্রচার করতে থাকেন। মাত্র বছর পাঁচেকের মধ্যে দেখা গেল বেশ আলোড়ন তৈরি করে ফেলেছেন তিনি । ফেসবুক ফ্রেন্ড পাঁচ হাজার অল্প কিছুদিনের মধ্যে পূরণ হয়ে যায়। বর্তমানে তার ফ্যান ফলোয়ার কয়েক লাখ ছাড়িয়ে গেছে। অনেকেই তার কাছ থেকে তার গুরুত্বপূর্ণ মতামত সংগ্রহ ও সংরক্ষিত রেখে নিজেদের কাজে ব্যবহার করছেন।এতোসব দেখে, বুঝে জয়নাল খান আত্মবিশ্বাসের বলে বেশ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে নিয়ে কাজের গতি দিনকে দিন বাড়িয়ে দিচ্ছেন ।সবার অনুপ্রেরণায় তাঁর সুনাম খ্যাতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে থাকে দিনের পর দিন।
এখন তার কৃষি প্রজেক্টে অগণিত জনগণের প্রতিষ্ঠান। অনেক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে সেখানে এমতাবস্থায় বিভিন্ন রকম সুনাম,সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশের দিক্ বিদিক। যার জন্য এখন তাকে তার এলাকার মানুষ এক নামে চিনে।
ফয়েজ সাহেব কিছুদিন হলো জয়নাল খানের নতুন কৃষি প্রজেক্টে জয়েন করেছেন।অফিসিয়াল কাজ ভালো বুঝেন বিধায় সময় ভালোই কাটছিল।বিপত্তি ঘটলো তখন, যখন মাঠপর্যায়ে কাজের গতি স্ব চোক্ষে সরজমিনে প্রদক্ষিণ করতে যান।
যেখানে কাজ করে সংসার চালায় অনেক ক্ষুদে কৃষক, যাদের মধ্যে মফিজ ও তার ছোট ছেলে মাহিম ও । তারা দুজন বেগুন ক্ষেত থেকে পরিপক্ব বেগুনগুলো তুলে একটা চটের বস্তায় ভরছিল এবং চলছিল তাদের বাবা-ছেলের মধ্যে কথোপকথন।
নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ফয়েজ সাহেব, বাবা-ছেলের দিকে এক দৃষ্টিতে । আর মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করছিলেন তাদের কথোপকথন।
বাবা ছেলেকে বলছে, বাবা মাহিম শোন, আজকে বাড়ি তোর মা কি রানবি?জানিস কিছু?
না তো আব্বা,তয় মা বাজার করে নিয়ে যাবার কইছে।আমারে কলাম বারবার কয়ে দিছে।
হ,বুঝছি।তয় কান খুলে শোন, তুই কিন্তু কিছুতেই এই আজকের বাগুন বাড়ি নিবি নে।আজকে বাজারে বিক্রি করবি বলে কালকে ঔষধ দিছি।এই বাগুন আজকে খাওয়া যাবেনে না।
এমন কথোপকথন শুনে ফয়েজ মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারায় মুষড়ে পড়লো মুহুর্তেই। তাহলে এ কি হচ্ছে দেশের সাথে, দেশের জনগণের সাথে।কিই বা খাচ্ছি আমরা জীবন বাঁচানোর জন্য? আমরা কি সত্যিই বেঁচে আছি,নাকি মরে বেঁচে আছি? আমরা জেনেশুনে এই বিষ প্রয়োগ করা সব্জি জনগণকে খাওয়াচ্ছি। এভাবে বুঝি বেঁচে থাকা বলে! তাহলে এভাবেই বুঝি বড়লোকেরা আরও বড়লোক হচ্ছে। ফলাফল কি হচ্ছে!
ভাবনার গতি বেড়ে গিয়ে ফয়েজ সাহেব মাঠ থেকে অফিসে ফিরে আসেন কিন্তু তার ভাবনার গতি সময়ের সাথে সাথে বেড়েই চলেছে। কিছুতেই কমছে না। বিষ
প্রয়োগকৃত খাবার খেয়ে জনগণ দিন দিন বিভিন্ন অজানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।বিভিন্ন ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটছে। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন। আর ভাবতে পারছে না ফয়েজ সাহেব । ফসল সংরক্ষণ করে রাখা গুদামঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন এক পা দু পা করে।
দূর থেকে দেখতে পেলেন মফিজ ও তার ছেলেকে।এগিয়ে গেলেন তাদের কাছে। ক্ষীণ স্বরে জানতে চাইলেন, কি ব্যাপার মফিজ, তোমাদের কাজ কি শেষ? মফিজ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে জানাতে বলল,জ্বে স্যার! আমাগের বিলটা দিলি আমরা এহন বাড়ি যাইতে পারতাম। বাজার করতি হবি, বাড়ি রান্দার কিচ্ছু নাই।
ফয়েজ সাহেব জানার আগ্রহেই জানতে চাইলেন,বেগুন কিছু নিয়ে যাও এখান থেকে।
না স্যার,এই বাগুন আজকে নিবো না। কালকে ঔষধ দিছি।এই বাগুন আজকে খাওয়া যাবি না।
তাইলে এগুলো যারা কিনে নিবে তাদের কি হবে?
কি আর হবি স্যার! একবার হাসপাতালে যায়ে দেইখেন স্যার।কত মানুষ কত রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে আছে। কত অসুখের নাম বিজ্ঞানীরা এখনো বার করবার পারে নাই।কিসির জন্যি হচ্ছে, জানেন স্যার?
কিসের জন্য হয়?
এ-ই যে, আমরা যা খাই, তার কোনটা ভালো, বিশুদ্ধ! কন তো স্যার?কত রকম সার,ঔষধ দিয়ে ফসল চাষ করি,মাছ চাষ করি,হাঁস-মুরগী,গরু-ছাগল চাষ করি। সব কিছুতেই এখন ভেজাল। আর তা-ই তো নানান রকম জীবাণুর মাধ্যমে রোগ-বালাই হয়ে সবাই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।
ও তাই,অনেক ভালো বলেছ তো তুমি। আমাকে বল তো, বাজারে গিয়ে তুমি এখন কি কিনবে?
আরও যে তরিতরকারি আছে সে গুলান থেইকে কিছু কিনে নিবোনে।
ফয়েজের মাথা ঘুরতে লাগলো। তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে ব্যাপারটা! মফিজ আরেক কৃষকের কাজ থেকে ঢেঁড়স কিনবে,পটল কিনবে, করল্লা কিনবে। কিন্তু সে জানে না ঐ কৃষকেরা যারা ঢেঁড়স, পটল,করল্লা বিক্রি করতে এনেছে তারাও অধিক লাভের জন্য একই নিয়মে সব্জি গুলো বিক্রি করতে এনেছে। অর্থাৎ তারাও ওগুলো বিক্রি করবে আর মফিজের কাছ থেকে বেগুন কিনে নিবে।
ফয়েজ আর ভাবতে পারছে না। ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে তার ভাবনার গতি।এভাবেই আরও ভালো উৎপাদনের জন্য বেশি লাভের জন্য আমরা একে অপরকে ঠকিয়ে যাচ্ছি দিনের পর দিন। এটাই হচ্ছে আমাদের মনুষ্যত্ব। ব্যক্তি হিসাবে কেবলমাত্র নিজের লাভ কিসে, নিজের স্বস্তি কিসে সেটাই মূল্যায়িত হচ্ছে।
দিন শেষে ভালো মানুষের বড্ড অভাব। ভালো মানুষের মানসিকতা ছাড়া এই অসহায়ের হাত কে রক্ষা করবে আমাদেরকে?কে দিবে আমাদের এই মানসিক মুক্তি?
প্রশ্নটি এখন সকলের মাথায় তীর বিদ্ধ! একটা ভালো মানুষ কখনোই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কারো ক্ষতি চাইতে পারে না। অথচ আমরা ভালো মানুষের “ভ” এর কাছেও নেই।ব্যক্তি হিসেবে আমরা যেমন অসহায়, সমাজ তথাপি দেশের কাছে তো বটেই।
সুযোগের অভাবে ভালোমানুষ সবাই,
এমন সমাজে, করি বসবাস,
সুযোগ পেলেই, দিচ্ছি সবাই
যে যার মতো আছোলা বাঁশ!
কবে হবে,যে সুবুদ্ধি এদের,
সেই চিন্তায় হই হতাশ,
তবুও বাঁচিয়ে রাখি আশার আলো
হবে একদিন সবাই ভালো,
খুব শিগগিরই আসবে সেদিন,
মনে জাগিয়ে রাখি বিশ্বাস,!