১৮৪ বার পড়া হয়েছে
যে ব্যথা গোপন।
। ছোটগল্প ।
সালেহা ফেরদৌস।
কাকের কা কা কা কর্কশ রবে ঘুম ভাঙলো ঈশিতার। যদিও ঘুমের সময় নয় এখন। আসরের আযান পড়েছে। অফিস থেকে ফিরে বিছানায় শুতেই ক্লান্তিতে চোখ জোড়া মুদে এসেছিল কেবল। এমন অসময়ে কি কাক ডাকে?
বিরক্ত মুখে হাই তুলে বারান্দায় গেল ঈশিতা। ঈশিতাকে দেখা মাত্র কাকটা বারান্দা থেকে উড়ে গেল।
সামনের বাসার ছাদে গিয়ে বসলো কাকটা তবে কা কা রব বন্ধ হলো না।
কাকের কা কা শব্দ শুনলে ঈশিতার দুশ্চিন্তা হয়। ঈশিতা জানে এসব কুসংস্কার তবুও ঈশিতার মনে হয় এই কর্কশ ডাক যেন বিপদের কথা শোনাতে আসে ঈশিতাকে।
কাকটার দিকে পেছন ফিরে ঘরে চলে এলো ঈশিতা।
একে একে বাবা, ভাই, মায়ের সাথে কথা বলে জানতে পারলো সবাই ভালো আছে।
ফোনে কথা চলাকালীন সময়েই কলিংবেল বাজলে দরজা খুলে দিল। আহাদ এলো বাসায়, ঈশিতার হাসবেন্ড।
ঈশিতা মোবাইল রেখে আহাদের হাত থেকে সবজিগুলো নিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগুলো।
আহাদ পেছন থেকে ডেকে বললো, তুমি কি খবরটা শুনেছ ঈশি?
ঈশিতার বুকের ভেতর ধক করে উঠলেও শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল, কি খবর বলো তো? আমি তো শুনিনি কিছুই।
-তোমার এক বন্ধু ছিল না আবির? আরে ওই যে ছেলেটা যে তোমার সাথে কিছুদিন চাকরিও করেছিল, ওই ছেলেটা আজ মারা গিয়েছে।
ঈশিতা থমকে গেল নাকি সময় থমকে গেল বোঝা কঠিন। ঈশিতা হাতে ধরা সবজিগুলোকে বুকে চেপে ধরে নিজের পতন ঠেকালো। আহাদ বলতে লাগলো, পথে আসার সময় তোমার এক কলিগের সাথে দেখা হলো, তোমাকে খবরটা জানাতে বললো। তুমি আজকে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি এসেছ বলে জানতে পারোনি।
এখন শরীর কেমন লাগছে তোমার?
ঈশিতার বুকে চেপে রাখা সবজিগুলো হঠাৎ করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে গেলে আহাদ এগিয়ে এসে বললো, উফ স্যরি জান! তোমার এই অবস্থায় এরকম একটা খারাপ খবর দেয়া আমার উচিত হয়নি। আমাদের বেবীটা ভয় পাচ্ছে তাই না! স্যরি বেবী! এই ঈশি শোনো, আম্মা পরশু চলে আসবে বলেছে। তোমার আর একা থাকতে হবে না। আর কয়দিন অফিস করবে তুমি? অফিস যেতে হবে না আর… এখন থেকে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করতে হবে বুঝেছো…
ঈশিতা অস্পষ্ট স্বরে বললো, আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে আহাদ। আমাকে বেডরুমে দিয়ে এসো।
আহাদ সযত্নে ঈশিতাকে বেডে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, তুমি রেস্ট করো সোনা। আমি দেখি ডিনারে কি রান্না করা যায়!
আহাদ রান্নাঘরে চলে গেলে দমিয়ে রাখা কান্নার দাপটে পিঠ কেঁপে কেঁপে উঠলো ঈশিতার। নিজের মুখে ওড়না পুরে কান্নার শব্দ বাইরে আসতে দিতে চাইছে না ঈশিতা।
এক সাথে পড়াশোনা শেষ করে এনজিওর একটা অফিসে এক সাথে ঢুকেছিল ঈশিতা আর আবির।
দীর্ঘ দিনের প্রেম পরিণয়ে রূপ দেয়ার পরিকল্পনা যখন চলছিল তখন একটা সরকারী ব্যাংকে উচ্চ পদে চাকরি হয়ে যায় আবির। খুব খুশি হয়েছিল ঈশিতা। যাক একজন তো সরকারী চাকরি পেল!
এরপর অবশ্য দূরত্ব আর ব্যস্ততার অযুহাতে ঈশিতার সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছিল আবির।
তারপর তো একদিন দেখা করে বলেই দিল, পরিণয় আর সম্ভব নয়। বাড়ি থেকে পছন্দ করা মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
আবির তার কথা শেষ করে চলে গিয়েছিল কখন ঈশিতা বুঝতে পারেনি। মাথার উপর গোল গোল করে একটা কাক উড়ছিল সেদিন আর সেই কাকের কা কা ডাকে ঈশিতা টের পেয়েছিল অনেকক্ষণ ধরে ঈশিতা একা বসে আছে।
সেদিনের কষ্ট আজকের কষ্টের কাছে হালকা মনে হলো ঈশিতার। সেদিন তো শুধু প্রতারণার কষ্ট ছিল।
আজকে সেই প্রতারক লোকটির চিরতরে চলে যাওয়া শুনে নিজেকে ফাঁকা ফাঁকা লাগলেও এই অনুভূতিকে অস্বীকার করতে হবে! স্বাভাবিক থাকতে হবে স্বামী আর অনাগত সন্তানের জন্য। সাধারণ প্রাক্তন এক কলিগ বা বন্ধুর জন্য চোখের জল ঝরানো যাবে না।
দু হাতে নিজের চুল নিজে টেনে ঈশিতা আল্লাহর উদ্দেশ্যে বললো, ইয়া মাবুদ! আমাকে শক্তি দাও কয়েকটা দিন স্বাভাবিক থাকার। আমি মাফ করে দিয়েছি আবিরকে, তুমিও মাফ করে দিও।
ওর জন্য এই গোপন ব্যথা তুমি গোপনেই রাখো মাবুদ।
সব ব্যথা প্রকাশ করা যায় না যে। আমি ভেঙেচুরে যাচ্ছি ভেতরে, তুমি আমাকে সামলাও প্লিজ!
আমি আহাদকে বলতে পারবো না আবিরের কথা।
আমার গোপন অধ্যায় গোপনেই রাখো তুমি।
আমাকে ধৈর্য দাও প্লিজ! ইয়া মাবুদ! ইয়া আল্লাহ! আমার বাচ্চাটার কষ্ট হচ্ছে। দয়া করো আমাকে, আবিরকে ভুলিয়ে দাও।
১ Comment
গল্পটা খুবই ভালো লেগেছে।