প্রতারণা।
জান্নাতুল নাঈমা শিমু
আপনার স্বামী আমারও স্বামী”। সকাল সকাল বাটন মোবাইলে এমন একটি মেসেজ পেয়ে চমকে উঠেছিলাম। মাহতাব দাঁত ব্রাশ করছিলো। সেখানে গিয়ে মাহতাবকে মেসেজটি দেখাতেই ও ভ্রুকুঁচকে কিছুক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলো, তারপর মাহতাব নিজেকে সামলে নিয়ে বলে – আমাদের তো আর শত্রুর অভাব নেই, মেসেজটি ডিলিট করে দাও। আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছিলো। হাসি চেপে রেখে বলেছিলাম- সত্যি করে বলো তো আরেক সংসার কোথায় রেখেছো? সে আমার দিকে চোখ বড় করে তাকাতেই আমি হেসে বলেছিলাম- আরে ফাজলামি করলাম, তুমি এতো সিরিয়াস হচ্ছো কেন? সেদিন সকালে নাস্তা না করেই সে বাহিরে চলে যায়। মানুষটা রসিকতা একদম বুঝে না; কেন যে রসিকতা করতে গেলাম! নিজেকেই নিজে ধিক্কার দিলাম কিছুক্ষণ। মাহতাব আদম ব্যবসায়ী। সেদিন সন্ধ্যার পর মাহতাব আমার জন্য গ্রামীণের একটি নতুন সীম এনে নিজেই পুরানো সীমটি ময়লার বাস্কেটে ফেলে মোবাইলে নতুন সীম লাগিয়ে দেয়। সকালে তার যেই গম্ভীর চেহারা দেখেছিলাম সে কথা মনে করতেই ভয় ভয় করছিলো।
বিয়ের সময় মাহতাব একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি করতো। আমি ভাইয়ের বাসায় থেকে বি,এ প্রথম বর্ষের ছাত্রী তখন। আসা যাওয়ার পথে পরিচয়, পরিচয় থেকে পরিণয় তারপর পারিবারিকভাবে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের দুবছর পর মাহতাব চাকরি ছেড়ে নিজে বিদেশে লোক পাঠাতে শুরু করে। ঢাকার পল্টনে একটি অফিস ভাড়া নেয়। প্রচুর টাকা আয় করতে থাকে।
যে মেসেজটির কথা প্রথমে বললাম সে সময় আমার বড় মেয়ে অর্পিতার বয়স সাত বছর এবং আমি আবার প্রেগন্যান্ট ছিলাম। আমরা তখন নিজের ফ্ল্যাটে থাকতাম, নিজের গাড়িতে যাতায়াত করতাম এবং মাহতাব অনেক জমি কিনেছিলো। মাহতাব সেই বছর মধ্যপ্রাচ্য পাঠাবে বলে ক’জন লোকের কাছ থেকে টাকা নেয় , কিন্তু সেই ট্রীপে সে ব্যর্থ হয়। তার ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়। সেই শুরু মন্দাভাব, মাহতাব মানব পাচার ব্যবসায় আর সফল হতে পারে নাই। জমি বিক্রি আর সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশ দিয়ে সংসার চলতে থাকে।
সেই মেসেজের চার বছর পর অর্পিতাকে কোচিং ক্লাসে দিয়ে আমি ছোট মেয়ে অধরাকে নিয়ে অন্য অভিভাবকদের সাথে বাহিরে অপেক্ষা করছিলাম।
তখন মোবাইলে অপরিচিত একটি নাম্বার থেকে কল আসে। কল রিসিভ করার পর কান্নাজড়িত কন্ঠে একজন নারী বলে-
: আপা, আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই।
: জ্বী কে বলছেন?
: আপনার স্বামী আমারও স্বামী। (কান্নাজড়িত কন্ঠ)
একথা শুনে আমার মাথা থেকে শীতল কিছু পায়ে নেমে যাচ্ছিলো! চেনা কন্ঠ, চেনা কন্ঠ! আমি চিৎকার করে বললাম
: তুমি বৃষ্টি, তুমি বৃষ্টি না? তুমি এসব কি বলছো?
: আমি সত্যি বলছি।
একথা বলে বৃষ্টি ফোন রেখে দিয়েছিলো।
আমার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছিলো। আমি চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি যেন হুশ হারিয়ে ফেলবো। পাশে বসা অভিভাবক জানতে চাইলো কোনো খারাপ খবর নাকি? উত্তর না দিয়ে কাঁপা হাতে আমি মাহতাবকে কল করি। ও তখন ফোন ধরে নাই। এরপর আমি আমার ননদকে ফোন করি। ও হ্যালো বলতেই আমি কান্নার জন্য ওকে কিছুই বলতে পারছিলাম না। ও আমাকে বলেছিলো- ভাবী তুমি বাসায় যাও, আমি তোমাদের বাসায় আসতেছি।
বাচ্চাদের নিয়ে কিভাবে বাসায় ফিরেছিলাম, মনে নেই। কলিংবেল চাপতেই আমার ছোট ননদ দরজা খুলে দেয়। তিন ননদ তখন বাসায়। মাহতাব বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলো। বৃষ্টি আমাকে এমন কথা কেন বলল জানতে চাইলে মাহতাব বলে- ওর মাথা ঠিক নাই আমার নামে মিথ্যাচার করছে। আমার মেজ ননদ রেহানা আমাকে শান্ত হতে বলে বৃষ্টিকে ফোন করে স্পীকার অন করে দেয়। বৃষ্টি দাবী করল মাহতাব শুধু বৃষ্টিকে বিয়েই করেনি তাদের একটি পুত্রসন্তানও আছে যে কিনা আমার অর্পিতা থেকে ছয় মাসের ছোট। আমি যখন জানতে চেয়েছিলাম বৃষ্টি কেন এসব বলছে তখন আমার ননদরা জানায়- তারা বিষয়টি লোক মুখে আগে শুনেছিলো কিন্তু বিশ্বাস করেনি। আজ যখন বিষয় প্রকাশ হয়ে পড়লো তখন বৃষ্টিকে তারা বাচ্চাসহ বাসায় আসতে বলে।
মাহতাবের পিএস বৃষ্টি নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে। মাহতাব যখন পল্টনে অফিস নেয় তখনি বৃষ্টিকে নিয়োগ দেয়। বৃষ্টি মাহতাবের অফিসে আট মাস চাকরি করে তখন বাসায় এসেছিলো কয়েকবার। বৃষ্টি যখন চাকরি ছেড়ে দেয় তখন আমি জানতে চেয়েছিলাম- ও চাকরি ছাড়বে কেন? মাহতাব বলেছিলো- বৃষ্টির বিয়ে ঠিক হয়েছে তাই।
শ্যামলা রংয়ের মিষ্টি চেহারার আটত্রিশ কেজি ওজনের ভদ্র মেয়েটি আমার স্বামীর লোলুপ দৃষ্টির শিকার আমি চিন্তাও করতে পারিনি।
লোকে আমাকে দেখলে বলে খালেদা জিয়ার কার্বন কপি ইরানি গোলাপ। কি লাভ হলো আমার এই সৌন্দর্যের!