নিস্তব্ধতা।
— জেরিন বিনতে জয়নাল।
অনেক রাত হয়ে গেছে অফিসের অবশিষ্ট কাজগুলো গুছিয়ে রাখছিলেন জারিফ সাহেব, এ সময় তার ফোন বেজে ওঠে। টেবিল থেকে ফোন হাতে নিয়ে দেখলেন তার ছোট ভাই মঈন কল করেছেন। ব্যস্ত হাতে ফোনটা রিসিভ করে কানে রেখেই দ্রুত হাতে কাজ এগিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি, ফোনের ওপাশ থেকে বাবার অসুস্থতার কথা শুনে তার হাত থেমে গেলো।
ফোনের ওপাশ থেকে মঈন বলল, আমরা হাসপাতালের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো।
‘আচ্ছা, আমিও বের হচ্ছি’ বলেই জারিফ সাহেব অফিস থেকে বেড়িয়ে পড়লেন তার গাড়ি নিয়ে।
আধঘন্টার মধ্যে তিনি হাসপাতালে পৌঁছে গেলেন, গাড়ি পার্কিং করে হাসপাতালের মেইন বিল্ডিংয়ের দিকে যেতে যেতে মঈনকে কল করে জেনে নিলেন বাবাকে নিয়ে তারা কোথায় আছে।
‘সাধারণত খারাপ সময়ে সবকিছুই খারাপ ঘটে থাকে কিন্তু আজকে বোধহয় আমার ভাগ্য সহায় হয়েছে’ লিফটের সামনে ফাঁকা পেয়ে এমনটাই ভাবছেন জারিফ সাহেব। লিফটে উঠে যথার্থ বাটন চেপে দাঁড়িয়ে আছে, কিছুক্ষণের মাঝেই লিফটের দরজা খুলে গেলো এবং সে তাড়াহুড়ো করে লিফট থেকে বেড়িয়ে ডান দিকে যেতে ধরল। কয়েক কদম এগোতেই সে বুঝতে পারলো পুরো ফ্লোর অন্ধকার এবং চারিদিকে কোনো শব্দ নেই, ভুল ফ্লোর ভেবে লিফটের দিকে এগোতেই লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেলো, লাগাতার বোতাম চেপেও কোনো কাজ হলো না, উপায় নাই কিছুক্ষণ তো অপেক্ষা করতেই হবে।
অপেক্ষা করতে করতে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো জারিফ সাহেব, বুঝতে পারলো এ ফ্লোরে সব অপারেশন থিয়েটার তাই তো কোনো মানুষের আনাগোনা নেই, সব লাইট অফ। সিড়ি দিয়ে নিচে যেতে চাইলো কিন্তু উপায় নেই, সিড়ির সামনে কেচিগেট দেয়া যাতে বাইরের কেউ আসতে না পারে এবং বাকি অংশটা কাঁচ দিয়ে ঘেরাও করা যার দরজায় লক করা। বলতে গেলে জারিফ সাহেব এখন বন্দী, লিফটের দরজা না খোলা পর্যন্ত সে বের হতে পারবে না।
অনেকক্ষণ যাবত চেষ্টা করেও সে লিফটের দরজা খুলতে পারছে না, লিফট একবার উপরে যাচ্ছে আরেকবার নিচে যাচ্ছে কিন্তু চতুর্থ তলায় কিছুতেই থামছে না। এদিকে তার ফোনও বন্ধ হয়ে গেছে ফলে কাউকে জানাতে পারছে না আর হাত ঘড়িটাও কাজ করছে না, কত সময় হলো এখানে আছে কে জানে।
চারিদিকের নিরবতা, অন্ধকার এবং গুমোটভাবের কারণে জারিফ সাহেবের কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে।
সিড়ি দিয়ে কয়েকজন নার্স যাচ্ছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সেদিকে এগিয়ে গেলো কিন্তু কেউ যেন তাকে দেখতেই পেলো না, জারিফ সাহেব চিৎকার করে ডাকতে শুরু করল তাও কেউ ফিরে তাকালো না। হয়তো শুনতে পায়নি ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলো সে, খানিকবাদে আরও কিছু মানুষকে দেখে সে ইশারা করল, চিৎকার করল কিন্তু ফলাফল শূন্য।
সে হতাশ হয়ে ফিরে এসে আবার লিফটের বোতাম চাপতে শুরু করল কিন্তু কিছু হচ্ছে না। কোনো কিছুর শব্দ শুনে পিছনে তাকালো সে, কাঁচের ওপাশে স্ট্রেচারের উপর থেকে সাদা কাপড় উড়ে গিয়ে বেড়িয়ে এলো মৃতদেহ , রক্তাক্ত শরীর, মাথা থ্যাতলানো, একটা চোখ কোটর থেকে বেড়িয়ে এসেছে, এই বীভৎস দৃশ্য দেখে চিৎকার করে উঠল জারিফ। হয়তো সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে, এমন মুহূর্তে লিফটের দরজা খোলার শব্দ তার কানে ভেসে আসল, কোনো রকমে দৌঁড়ে গিয়ে শুধু লিফটে প্রবেশ করে সে। নিজেকে সামলে নিয়ে বাকিদের সাথে দ্বিতীয় তলায় নেমে যায় সে, তখনই তার ফোন বেজে ওঠে মঈন কল করেছে কিন্তু তার ফোন তো বন্ধ ছিলো। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দিব্বি চলছে সে, এই তো রাত ১০ টা বাজতে চলল কিন্তু ১০ টা কিভাবে? সে তো এমন সময় হাসপাতালে পৌঁছেছে মাত্র, হয়তো ঘড়ি আসলেই নষ্ট হয়ে গেছে। এসব ভাবতে ভাবতে কল কেটে গেলো, জারিফ সাহেব কল ব্যাক করলে-
মঈনঃ ভাইয়া, কোথায়?
জারিফঃ সিড়ির কাছে, আসতেছি।
মঈনঃ লিফটে আসো তাড়াতাড়ি হবে।
জারিফঃ ওখানে অনেক ভীড়।
মঈনঃ আচ্ছা আসো।
সারা রাত বাবার পাশে বসে সেই ঘটনাটি ভাবছে জারিফ সাহেব।
পর দিন সকালে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার সময় একটা নার্সকে ডাক দিয়ে জারিফ সাহেব জিজ্ঞেস করল,
জারিফঃ চতুর্থ তলায় কি অপারেশন থিয়েটার?
নার্সঃ জি
জারিফঃ ওখানে পেশেন্ট রাখা হয় না?
নার্সঃ না স্যার, ওখানে শুধু অপারেশন থিয়েটার, কয়েকটা স্টোররুম যেখানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, মেডিসিন এবং হাসপাতালের ফাইলস রাখা হয়।
জারিফঃ অপারেশন শেষে কি লাশ ওখানে রাখা হয়?
নার্সঃ না, সব লাশ তো মর্গে পাঠানো হয়, হাসপাতালের পিছনে মর্গ আছে।
জারিফঃ কালকে রাতে বোধ হয় কোনো এক্সিডেন্টের রোগীর মৃতদেহ রাখা হয়েছিলো।
নার্সঃ কখনোই হতে পারে না স্যার, খোলা জায়গায় লাশ রাখলে দূর্গন্ধ ছড়াবে তাছাড়া এক্সিডেন্টের যে লাশের কথা বলছেন সেটা তো আমার দায়িত্বে ছিলো আমি নিজেই মর্গ পর্যন্ত গিয়েছিলাম।
জারিফঃ ওহ (অন্যমনস্ক হয়ে)
নার্সটা কিছুদূর গিয়ে পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন স্যার? সে তো বিকালের ঘটনা? আপনি কি ছিলেন তখন?
জারিফ কিছু বলতে যাবে কিন্তু তখনই নার্স তার খুব কাছে এসে ‘ অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করিয়েন না স্যার, ব্যাপারটা ভালো হবে না, আপনার বাবা তো এখানেই।’ বলেই বীভৎসভাবে হেসে হাঁটতে শুরু করল, যেই হাসির মধ্যে জারিফ গত রাতের সেই লাশের মুখ দেখতে পেলো।
জেরিন বিনতে জয়নাল
কালীবাড়ি, ঠাকুরগাঁও।