গোধূলির রঙ
তসলিমা হাসান
‘একটা ঘন ঘোরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। একটা তীব্র উপেক্ষা আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে ডানাভাঙা পাখির আর্তনাদের মতো বুকের ভেতরে হাহাকার করছে। আমি কী বীভৎস, বিকৃত, বদ্ধ-উন্মাদকে দেখতে পাচ্ছি এক মানুষ নামের জন্তুর মধ্যে! ঝোপের পাশে পাখির মিষ্টি ডাক, সুর মিলিয়ে দোয়েল-বুলবুলি আর চাতক পাখি ডেকে যাচ্ছে মধুর অথচ করুণ ভঙ্গিতে। ভয় পেয়ে উড়ে যায় একঝাঁক পায়রা। এমন গল্প হতে পারে মানুষ, জন্তু আর পাখিদের নিয়ে। এক নারীর গল্প আছে, যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় জীবনের অনেক বিচিত্র ঘটনা। আমি সেখানে গল্পের ঝুলি খুলে দেখাবো কতো শত রঙ-বেরঙের বুকভরা নিঃশ্বাসের শব্দের করুণ ঝংকার! অসংবদ্ধ গলায় চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করে সব; কিন্তু আমার বাকশক্তি সীমিত।’ — এইসব কথা ঝুমার মনের গহীনে ঘুরে বেড়ায়। সে কোনোদিন ভাবেনি রোহান এভাবে ওকে ঠকাবে। অথচ কী ভালোবাসাই না ছিল রোহানের জন্য ওর মনে! ঝুমার বাবা কতোবার বাধা দিয়েছিল ওর বিয়েতে। কিন্তু সে শোনেনি। রোহানকে ভালোবেসে সবকিছু ত্যাগ করে পা বাড়িয়েছিল অজানা সুখের সন্ধানে! এখন তো বাবার সব কথাই সত্যি হলো!
বাড়িটার চারিদিক থেকে নেমে এসেছে জমাট-বাঁধা অন্ধকার। দমকা হাওয়া একা একা ঘুরপাক খায় এদিক-ওদিক, নিঃশব্দে হাওয়া যেন কাঁদছে বাতাসে ঘুরে-ঘুরে। ঝুমাকে বিয়ের পরে রোহান এখানটায় নিয়ে এসেছে; এটা ওর শ্বশুরবাড়ি। বাবার বাড়ির মুখও দেখতে পারেনি ঝুমা বিয়ের পরে। তাও তো প্রায় তিন বছর হয়ে গেল। আজকের সন্ধ্যাটা বড় বিস্ময়কর; যেন পাখিগুলো ডাকছে — দূরের দেশে ভেসে যেতে! ঝুমা বাইরে এসে একটা গাছের নিচে বসে; এমন সময় একটা শরীরি ছায়া হাওয়ার মধ্য খেলে গেল। একবার নয় — পরপর কয়েকবার। আরে কী আশ্চর্য! ওর শরীর কেঁপে উঠলো জ¦রে কাতর দুর্বল মানুষের মতো। ঝুমা খানিকটা নড়চড়ে বসলো, পায়ের তলার সাথে সিমেন্টের উঠোনের ঘসা লেগে একটা অদ্ভূত ধরনের শব্দ তৈরি হলো; অন্তত ওর কাছে তাই-ই মনে হলো। এই বাড়ি জুড়ে গাছ-গাছালির মেলা; এতো গাছ যে, দিনের বেলাতেও বাড়ির মধ্যে অন্ধকার খেলা করে। ছায়ারা সব চারপাশ থেকে নিবিড়ভাবে নেমে আসে অন্তরমহলে ও বাইরে। ঝুমা বিয়ের পর থেকেই খেয়াল করেছে রাতে ঘরের ভেতরে কে যেন দরোজার এ-পাশ থেকে ও-পাশে হেঁটে যায়; ঠিক ছায়া নয়, যেন শরীরের অবয়ব। খানিক বাদে আবার অন্ধকারেই মিলিয়ে যায়। অদ্ভূত শব্দ করে। ও বুঝতে পারে না — কী ঘটে রাতে! চোখ দিয়ে দেখেও কিছু বলতে পারে না কাউকে। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ঝুমাকে কখনও ভালো চোখে দেখে না। ওর সরলতা নিয়ে ব্যঙ্গ করে, হাসে, অপবাদ দেয়। ঝুমা তো সত্যিই ভীষণ সরল। নিজেকে এই বাড়িতে আশ্রিতা মনে হয় তার কাছে। তার কোনো কথার মূল্য দেয় না কেউ এখানে। রাতে সে কী দেখে — এসব বললে হয়তো তাকে পাগল ভাববে। তাই, চুপই থেকে গেছে ঝুমা। রোহান গভীর রাতে নেশা করে এসে ওকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। ঝুমা নীরবে মেনে নেয় সবকিছু। গাছের ছায়ায় বসে পাশের পুকুরের স্থির জলে চোখ রেখে আনমনা হয়ে পার-করে-আসা রাতগুলোর কথা নতুন করে মনে করতে চেষ্টা করে ঝুমা। যেন, ‘হাজার রাতের কাহিনি’!
ঝুমার বাবা-মা মেয়ের কষ্টের কথা শুনে সহ্য করতে না পেরে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। এরপর বাবার ওই ভাড়াবাড়িতে আর কোনোদিন যাওয়া হয়নি ঝুমার। কেউ তো নেই ওর আর। বেশি লেখাপড়াও করা হয়নি; এর জন্য রোহান, শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সব অত্যাচার সহ্য করে পড়ে থাকতে হয়েছে। পড়াশোনা থাকলে না হয় একা থাকা যেতো; কিছু একটা করে নিজেকে চালিয়ে নিতে পারতো সে। রাত হলে, নিঃসঙ্গ সময়ে কষ্টগুলো নিবিড় হয়ে নামে; কখনও-বা দুপুররাতে ঘুম ভেঙে গেলে হাহাকারে হৃদয় ভেঙে যায় ঝুমার। বর্ষার রাতে জানালার বাইরে ডোবায় ব্যাঙগুলো খিলখিলিয়ে হাসে। ঝুমা যেন দূর থেকে হাওয়ায় ভেসে-আসা গান শুনতে পায় — ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর!’ — এ কেমন জীবন হলো ঝুমার!
রোহান নিয়ম করে গভীর রাতে খুব বেশি নেশা করে ঘরে ফেরে। হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে নেশার ঘোরে ঘুমন্ত ঝুমার ঠোঁটদুটো চুষে নেবার জন্য ঠোঁটে ঠোঁট রাখে। হাত দুটো এগিয়ে দেয় বুকের দিকে। ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর দেহের ওপরে। ঝুমার ঠোঁট, হাত, চোখ, বুক এসবের ভেতরে হারিয়ে যায় যো এক নীল সমুদ্রে। সঙ্গে সঙ্গে ঝুমার দেহ শিথিল হয়ে পড়ে নির্দয় বিছানায়। পৌরুষের ভার মুক্ত করে কখন যে বিছানায় লেপ্টেপড়া দেহটা এলিয়ে ঘুমিয়ে যায়, তা তার অনুভূতিতে নেই। এমন ঘটনা একদিন নয় — দিনের পর দিন চলেছে এর পুনরাবৃত্তি। এমন অত্যাচার, অবিচারের শত শত রাতের কাহিনি ঝুমার শরীরে জমা হয়ে আছে।
পরদিন ভোরের নরম আলোয় ঝুমার দেহ ভেসে থাকতে দেখা যায় বাড়ি-সংলগ্ন পুকুরের স্থির কালো জলে। খবর রটতেই কৌতূহলী মানুষ জড়ো হতে শুরু করে। বিস্ময় উপচে পডছে যেন সবার চোখে চোখে। আপনা থেকেই যেন ঝুমার নগ্নশরীর বীভৎস রূপ মেলে ধরে; শরীরে স্থানে স্থানে কাটাচিহ্ন, ছোপ ছোপ দাগ। আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে চিল উড়ছে। গাছে গাছে কাকেদের মিছিল — শ্লোগান। কখন ওর দেহটা কামড়ে ছিড়ে ছিড়ে খাবে! আকাশ কালো করে ঝড় নামছে। বাতাস বইছে। ঝটিকা বৃষ্টি শেষে মেঘ ফুঁড়ে উঁকি দেয় দিবসের শাদা চাঁদ। আসন্ন জ্যোৎস্নার ইঙ্গিতে জলছবি বেরিয়ে ঝুমার তীক্ষ্ম আর্তনাদ মিলিয়ে যায় আকাশে দূর সীমায়; বাতাসের হু হু শব্দে!
টরন্টো, কানাডা।