১,২৩৯ বার পড়া হয়েছে
কমব্যাট ইসলামোফোবিয়া
কাজী জহিরুল ইসলাম
একটি মন্দ দৃষ্টান্ত দিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করি। ধরুন এক গ্রামে ১০০ জন মানুষ বাস করে। তাদের মধ্যে ১০ জন ভয়ঙ্কর ডাকাত। ৯০ জন সাধারণ মানুষ যদি নিয়মিত ডাকাতদের গালি-গালাজ করে তাহলে সম্ভাব্য ফলাফল কী হবে? ডাকাতেরা খুন খারাবী করবে, এর-ওর বাড়িতে হামলা করবে। গ্রামটিতে একটি স্থায়ী অশান্তি বিরাজ করবে। দ্বিতীয়ত, যদি গ্রামবাসী ডাকাতদের কিছুই না বলে, চুপচাপ নিজেরা নিজেদের মত থাকে, তাহলে কী হবে? দুটি ঘটনা ঘটতে পারে। ডাকাতেরাও এই গ্রামের কাউকে বিরক্ত করবে না, দূর-দূরান্তে গিয়ে ডাকাতি করবে। সবাই যার যার মত শান্তিতে থাকবে। আবার এও হতে পারে, যেহেতু ৯০ জন গ্রামবাসী ডাকাতদের ভয়ে সন্ত্রস্ত, ডাকাতেরা যার-তার ঘরে হামলা করবে, লুট করবে, ধর্ষণ করবে, পুরো গ্রামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করবে।
এবার বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখি। ধরুন গ্রামের লোকেরা ডাকাতদের সঙ্গে স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করছে। ওরা চাঁদা তুলে একেকজনকে সৎ ব্যবসা করার পুঁজি জোগাড় করে দিচ্ছে, ডাকাতি ছেড়ে স্বাভাবিক, বৈধ আয়ের পথ বেছে নিয়ে জীবন-যাপনে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছে। এর ফলে কেউ সুপথে আসবে, কেউ আসবে না। যারা আসবে না তারা কিছু বছর পরে সতীর্থদের উন্নতি দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারে। ফলে এক সময় গ্রামটিতে স্থায়ী শান্তি আসবে।
এবার অন্য একটি দৃষ্টান্ত দেই। ধরুন এই গ্রামের ৩০ জন মানুষ উচ্চশিক্ষিত, বিজ্ঞান-মনষ্ক। বাকী ৭০ জন ধর্মের অনুসারী এবং কট্টর ধর্মপন্থী। ধর্মপন্থীরা ৩০ জন বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের আচরণের সমালোচনা করে, ফতুয়া দেয়, বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের সমালোচনা করে, পোশাকের সমালোচনা করে, ধর্মীয় রীতিনীতি পালন না করার সমালোচনা করে। অন্যদিকে বিজ্ঞানমনস্ক দলটি শুধু নিজেদের মধ্যেই মেশে, ধর্মান্ধদের নিচু স্তরের ইতর শ্রেণীর মানুষ মনে করে। সুযোগ পেলে তাদের মূর্খতার ফলে গ্রামের কী কী ক্ষতি হচ্ছে তাও শুনিয়ে দেয়। এই গ্রামের মানুষের সম্পর্কের ডাইনামিক্সটা কেমন হবে? একটা টেনশন সব সময় কাজ করবে। গ্রামের বাতাশে ভেসে বেড়াবে ঘৃণা। বিজ্ঞানমনস্করা যেহেতু অধিক শিক্ষিত এবং অধিক বুদ্ধিসম্পন্ন তারা যদি ধর্মান্ধদের ইতর-প্রাণী জ্ঞান না করে তাদের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় এবং ক্রমশ তাদেরকে আধুনিক শিক্ষাদান করতে থাকে তাহলে কী এই গ্রামে শিগগিরই শান্তির সুবাতাস বইবে না?
পৃথিবী একটি বৃহৎ গ্রাম। এই গ্রামের মোট জনসংখ্যা ৮০০ কোটি। ৬০০ কোটি মানুষ কোনো না কোনো ধর্মের অনুসারী এবং প্রায় দুই’শ কোটি মানুষ মুসলমান। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার দুর্ঘটনার পরে পৃথিবীর মানুষের আচরণ বদলে যায়। সবাই সবাইকে সন্দেহ করতে শুরু করে। যেহেতু টুইন টাওয়ার দুর্ঘটনার দায় একটি সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠী মুসলমানদের ওপর চাপানো হয়েছে, সারা পৃথিবীর মানুষ ঘৃণার আঙুল তুলতে শুরু করে মুসলমানদের দিকে। এমন কী মুসলমানেরাও রাস্তায় দাঁড়ি, টুপিওয়ালা মানুষ দেখলে ভয়ে কুঁকড়ে যেতে শুরু করে। বিমানে চড়েছেন, পাশের সিটে দাড়ি, টুপিওয়ালা এক লোক, আপনি সারাক্ষণ আতঙ্কে আছেন, লোকটা প্লেনে বোম ফোটাবে না তো! এই যে ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র এর ফলে কট্টরপন্থী মুসলমানদের কেউ কেউ প্রতিশোধস্পৃহায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আরো বেশি উগ্র আচরণ করতে শুরু করে। পৃথিবীর এখানে-ওখানে সন্ত্রাসী হামলা করতে শুরু করে। নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য কোথাও কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলেই তার দায় (ক্রেডিট) তারা নিতে শুরু করে। পৃথিবী অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক অস্থির হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত, শিক্ষিত, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ যারা, ইউরোপ এবং আমেরিকানরা, বুঝতে শিখলো ঘৃণা দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। অস্থির পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে দরকার ভালোবাসা। তারা মাল্টি রেইস, মাল্টি এথনিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দিতে শুরু করে।
২০০০ সালে আমি জাতিসংঘের একজন কর্মী হিসেবে কসোভোতে যাই। সার্বিয়ার কাছ থেকে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আলাদা হয় আলবেনিয়ান জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত জনপদ কসোভো। কসোভোর প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ আলবেনিয়ান হলেও, ১০ শতাংশ সার্বিয়ান তখনও কসোভোতে। ওরা কি এখানেই থাকবে? কসোভোর আলবেনিয়ানরা ওদের সার্বিয়ায় তাড়িয়ে দিতে চায় কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, যাদের সহযোগিতায় কসোভো যুদ্ধে জয়লাভ করে, বাঁধ সাধে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বক্তব্য হলো, ওরা এখানেই থাকবে, শুধু ওরাই না, ক্রোট, তুর্কিশ, রোমা সকলেই এই ভূখণ্ডে থাকবে, সবাইকে নিয়েই তোমাদের রচনা করতে হবে এক বহুজাতিক মানুষের শান্তিপূর্ণ দেশ। সেই থেকে আমি মাল্টি-অ্যাথনিক সমাজ প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অনুভব করতে শুরু করি।
আজ ২০২৩ সালে এসে উন্নত দেশের মানুষদের মধ্যে এই বিশ্বাস আরো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়েছে। তারা সুস্পষ্ট করে বুঝতে শিখেছে, ৯/১১ তে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণার বীজ তারাই বুনেছিল পৃথিবীর মাটিতে সেইসব বীজ থেকে জন্ম নেয়া চারাগাছগুলো আজ মহীরূহ হয়ে উঠতে শুরু করেছে, ফুল, ফল, পত্রে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীময়, ওদের নিঃশ্বাস থেকে নিঃসৃত বিষবাষ্পে পৃথিবীর বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। সময় এসেছে সেইসব বিষাক্ত গাছ কেটে ভালোবাসার বীজ বপনের। সেই কাজটিই এখন উন্নত পৃথিবীর মানুষ শুরু করেছে।
২০২২ সালের ২৯ জুলাই টেক্সাসের কংগ্রেসম্যান আল গ্রিন কংগ্রেস সভায় একটি বিল উত্থাপন করেন, ইসলামকে পৃথিবীর একটি মহান ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করার জন্য। এই বিলের সপক্ষে বলা হয় ইসলামের নীতিগুলো পৃথিবীতে শান্তি এবং সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করে। অথচ দুই দশকেরও অধিক সময় ধরে পশ্চিমারা বলে আসছিল, ইসলাম অশান্তি সৃষ্টি করে, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করে। একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করতে করতে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে এসেছে যে আজ ইসলামোফোবিয়ার, মানে ইসলামাতঙ্কের, বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে ওদেরকেই জেহাদ (কমব্যাট) ঘোষণা করতে হচ্ছে। ওরা বুঝতে পেরেছে ২০০ কোটি মানুষের মনে আঘাত দিয়ে কিছুতেই পৃথিবীতে সুখে শান্তিতে বসবাস করা যাবে না।
যারা আমার লেখা পড়েন তারা হয়ত লক্ষ করেছেন, গত এক দশকেরও অধিক সময় ধরে আমি সেক্যুলারিজমের একটি নতুন সংজ্ঞার কথা বলি। সেটি হচ্ছে সকল ধর্ম, মতবাদ ও ধর্মহীনতাকে ভালোবেসে আলিঙ্গন করাই সেক্যুলারিজম। ধর্মকে বাতিল করার নাম আজকের দিনে সেক্যুলারিজম নয়। সেক্যুলারিজমের সংজ্ঞা এর শাব্দিক অর্থে নিহিত নয়, সংজ্ঞাটি এর উদ্দেশ্যে নিহিত। কবি শহীদ কাদরী ছিলেন একজন নাস্তিক মানুষ, ভয়ে ভয়ে কথাটি আমি আকার-ইঙ্গিতে তাকে বলেছিলাম। তিনি আমার মনোভাব বুঝতে পেরে, হয়ত আমাকে খুশি করার জন্যই, নিজেই বলে দিলেন, সব ধর্মকে গ্রহণ করাই সেক্যুলারিজম। তিনি যে কারণেই বলেন না কেন, তার সমর্থন এই সংজ্ঞার পক্ষে কথা বলতে আমাকে উৎসাহিত করেছিল নিঃসন্দেহে।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জাতিসংঘে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি “কমব্যাট ইসলামোফোবিয়া” শব্দযুগল উচ্চারণ করেন। এই শব্দযুগল আমার ভালো লাগেনি। কিন্তু তার যুক্তিগুলো, এই শব্দযুগলের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যটি ভালো লেগেছিল। ইমরান খানের ভাষণের ৩ বছর পরে ২০২২ সালে জাতিসংঘ ১৫ মার্চকে “আন্তর্জাতিক কমব্যাট ইসলামোফোবিয়া” দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এখন থেকে সারা পৃথিবীর মানুষ ১৫ মার্চকে “ইসলামাতঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” দিবস হিসেবে পালন করবে। যেহেতু সব ধরণের যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান তাই “কমব্যাট” বা যুদ্ধ কিংবা জেহাদ এই শব্দটি আমার ভালো লাগেনি। একটি অপরাধ নির্মুলের জন্য আরো একটি অপরাধ করাকে আমি ভীষণ অপছন্দ করি। সমূহ বড়ো ধ্বংস এড়াতে ছোটো একটি ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানোর পক্ষেই অধিকাংশ মানুষ, পৃথিবীর আইন, কিন্তু একজন কট্টর মানবতাবাদী হিসেবে আমি এই ব্যবস্থার নিন্দা জানাই। তাই “কমব্যাট” শব্দটির কারণে আমি এই দিবসকে মেনে নিতে পারছিলাম না। কিন্তু আজ হঠাৎ আমার মনের আকাশের মেঘ কেটে গিয়ে উজ্জ্বল এক ফালি রোদের মতো জ্বলে উঠলো এই শব্দের প্রকৃত অর্থ।
কমব্যাট ইসলামোফোবিয়ার অর্থ এই নয় যে যে মানুষ ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলবে তাকে প্রতিহত করো, তাকে শাসাও, তাকে আক্রমণ করো। মূলত আমার ভেতরে যদি ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামাতঙ্ক থাকে, আমি যেন সেই ভীতির বিরুদ্ধে, সেই আতঙ্কের বিরুদ্ধে, ঘৃণার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হই। এটি নিজের ভেতরের নেতিবাচক চিন্তার বিরুদ্ধে ইতিবাচক চিন্তার যুদ্ধ।
এই দিবস তখনই সফল হবে যখন জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো এর তাৎপর্য তুলে ধরে তাদের নাগরিকদের সচেতন করবে। তাদের দেশের/ভাষার বুদ্ধিজীবীরা, সাংবাদিকেরা, লেখকেরা বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি করবে। মানবাধিকার কর্মীরা এই বিষয়ে সোচ্চার হবে। সরকারগুলো ইসলামোফোবিয়া বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় আইন করবে, যেমন, আমেরিকা কংগ্রেসে বিল উত্থাপন করেছে, ইসলামকে একটি মহান ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করার।