এক মুঠো সুখ
তসলিমা হাসান
অর্পাকে আজ আমি আচ্ছা রকম বকা দিয়েছি। না এটা নিয়ে আমার ভিতর কোন অনুশোচনা নেই। মেয়ে মানুষ থাকবে মেয়ে মানুষের মত। সব বিষয়ে এত প্রশ্ন কিসের। এই যে , আমি এখন অফিস থেকে মাত্র তেতে পুড়ে ফিরলাম। কই আমার সেবা যত্ন করবে। তা না, এত দেরী হল কেন? অফিস থেকে কি কোথাও গিয়েছিলে? মুখ গোমরা করে আছ, বস ঝাড়ি দিয়েছে নাকি? একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। আরে বাবা তুমি এই যে সারাদিন বাসায় বসে থাক, আমি কি কখনো প্রশ্ন করি আজ সারাদিনে কি কি করলে? কখনো বলেছি যে পাশের বাসার ভাবি কি বলে গেল? তাইলে তোমার এত প্রশ্ন কেন?
ধুর ছাই,সন্ধ্যাবেলা করে মেজাজটাই খারাপ করে দিল। ভেবেছিলাম আজ একসাথে বাইরে খেতে যাব। যাবই না আর। এখন এই গরমে রান্না করুক, বুঝুক কেমন লাগে।
ড্রইংরুমে এক ঘন্টার উপর বসে বসে পেপার পড়লাম। প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। অফিসে আজ কাজের চাপে দুপুরে একটা স্যান্ডুইচ ছাড়া কিছুই খেতে পারি নি। দেখতে গেছি অর্পা রান্না ঘরে কি করছে, খাবার দিতে এত দেরী হচ্ছে কেন। কিন্তু যেয়ে দেখি মহারানী ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সাজুঁগুজু করছে। মেজাজটা কেমন খারাপ হয়। মাত্র একটা ধমক দিয়ে কথা বলেছি তাতেই কান্না শুরু হয়ে গেছে। অন্যসময় হয়তো ওর কান্না দেখে খারাপ লাগতো কিন্তু এই মুহূর্তে রাগ হচ্ছিলো। প্রচন্ড আকারের রাগ। স্বামী না খেয়ে আছে আর বউ মনের সুখে ঠোটে লিপিস্টিক ঘষতেছে। কেমনটা লাগে। রাগে আমার গা হাত পা কাপঁতেছিলো। পুরোপুরি হিতাহিত জ্ঞান শুন্য হয়ে পড়েছিলাম। ওই সময় মুখে যা আসছে তাই ওকে বলছি।
একটু পর সম্বিত ফিরে পেতেই দেখলাম অর্পা ব্যাগ গুছানো শুরু করছে। আশ্চর্য সব এখনকার মেয়েরা। ক্যান স্বামী কি কিছুই বলতে পারবে না? একটু রাগ করলেই তল্পিতল্পা গুছিয়ে বাপের বাড়ি চলে যেতে হবে? এগুলো সব ঐ হিন্দি সিরিয়াল দেখার ফল। যাজ্ঞা, দেখি কতদিন বাপের বাড়ি থাকতে পারে, আমিও আনবো না।
রাত্রি যত গভীর হচ্ছে তত অর্পার জন্য খারাপ লাগছে। এই রাস্তায় ট্যক্সি পাওয়া খুবই মুশকিল। বিশেষ করে রাত্রে। পেলো কিনা কে জানে। ফোন দিব কি একবার? না থাক। আসলে বেচারীর আর কি দোষ, আমিই অফিস থেকে ফোন করে ওকে বলেছিলাম আজ রাত্রে বাইরে খাব। বাসায় ফিরে তো আর ওকে বলি নি যে যাব না। এজন্যই হয়তো ও সাজঁতে বসেছিলো। অথচ আমি কি বলা টাই না ওকে বললাম। বেচারী ! আমার জন্য আজ সারারাত হয়তো ওর কাদঁতে কাদঁতেই যাবে। ফোন দিব নাকি একবার, নাকি ওকে আনতে যাব। নাহ, এত রাত্রে শ্বশুর বাড়ি গেলে সবাই কি ভাববে। আজ রাতটা না হয় থাক কাল সকালেই ওকে নিয়ে আসবো। পরক্ষনেই আবার মনে হলো, আমি কেন ওকে আনতে যাব। ও আমার উপর রাগ করলো ভালো কথা , আমি যেমন চিল্লাইছি ওউ চিল্লাইতো। কিন্তু তাই বলে বাড়ি থেকে চলে গেলো কেন? যেমন গেছে তেমন নিজে নিজেই ফিরে আসবে। আমি আনব না। থা্কুক একা একা।
নিজের ইগোর সাথে পুরো আড়াই ঘন্টা ধরে যুদ্ধ করলাম। তারপর প্যান্ট শার্ট পরা শুরু করলাম। যা থাকে কপালে, আগে অর্পা কে তো নিয়ে আসি। আর এক মুহূর্ত দেরী ও সহ্য হচ্ছে না। ফ্লাটে তালা দিয়ে হুড়পাড় করে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে আবছা কালো মত কিসের সাথে যেন ধাক্কা খেলাম।
ভালো করে তাকিয়ে দেখি অর্পা। সিড়ির কোনা ঘেষে ওর লাগেজ ব্যাগ নিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখে উঠে দাড়ালো। চোখের কোনে কাজল একদম লেপ্টে বেড়াছ্যাড়া হয়ে আছে। কপালের টিপ একপাশে হেলে পড়েছে। অনেকক্ষন ধরে কাদাঁর ফলে চেহারায় কেমন একটা লালিমা আভা দেখা যাচ্ছে।
পু্রোপুরি বিধ্বস্থ অর্পার সামনে যখন নতজানু আমি সকল অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে শাস্তির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, অর্পা তখন হাহাকার মাখা গলায় শুধু একটা কথায় বললো-
“তুমি আসতে এত দেরী করলে কেন শুভ্র?”
তসলিমা হাসান
কানাডা, ১৫-১২-২০২২
১ Comment
ভালোবাসার এমন জ্বালা, অন্তর করে খাঁ খাঁ। পরিচ্ছন্ন ভালোবাসার গল্প। লেখিকা তসলিমা হাসানকে অভিনন্দন।