একুশের গ্রন্থমেলা ২০২২ এবং একজন হোসেনউদ্দীন হোসেন
জেবুন্নেছা জোৎস্না (NY/USA)
সাহিত্য পাগল জাতি বোধকরি পৃথিবীর সর্বত্রই সমান আছে কম-বেশি ! কেউ হয়তো একটু বেশি সাহিত্য সমঝদার, কেউ সাহিত্য একটু কম বোঝায় কম অনুরাগী। তবে বই নিয়ে আড্ডায় আমরা হরহামেশাই মেতে উঠি! বইমেলা নামটা শুনলে কেমন যেন সবার মধ্যেই একটু উত্তেজনার হাওয়া দোলায় যেমনটি হয় ধর্মীয় উৎসব -রীতিতে! তবে সে সব উপলক্ষ্য কেবল এক নিদিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, বইমেলা সমস্ত গন্ডির উর্ধ্বে উঠে একটা বিশেষ ভৌগলিক অন্চলের মানুষের জন্য নিয়ে আসে একই অনুভূতি! বাঙালিদের বইমেলা এখন বাংলাদেশ -কলকাতা ছাড়িয়েও ব্যাপকভাবে উদযাপিত হচ্ছে প্রবাসেও! কাজেই পিডিএফ’য়ের যুগে মুদ্রণ প্রিন্টে খসখসে বইয়ের সেই পুরাতন গন্ধ পেতে বইমেলার বিকল্প নেই কোনমতে!
গত ফেব্রুয়ারি মাসে আমার দেশে যাওয়ার সময়টা কেমন যেন বইমেলার সাথে একদম মিলে গিয়েছিল। এ সময়টায় নিউইর্য়কের অনেক লেখক বইমেলাকে উদ্দেশ্য করে দেশে যায় এবং প্লেনে যথারীতি অনেক লেখকদের সাথে দেখা হয়, লেখকরা যেন তাঁদের ডায়াস্পোরা ভাবনাকে স্বদেশের পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য স্বশরীরে দেশে স্থানান্তরিত হয়! এ যেন, চল, চল, চল— আজ বইমেলায় সব চল! আর এমন অনুভূতি নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২ যেয়ে নিজেকে প্রজাপতির মতো মনে হচ্ছিল! যেদিকেই তাকাই কেবল বইয়ের স্টল আর লেখক -পাঠকের সমাবেশ। বেশিরভাগ লেখকের সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকলেও অনেককেই চিনি ফেসবুকের বদৌলতে! কেউ আমাকে চিনে নিয়েছেন, আমি নিয়েছি চিনে কাউকে। বেশ কিছু বই কিনলেও, উপহার পেয়েছি অনেক বই, আর আমিও নিউইর্য়ক থেকে বই নিয়ে গেছি উপহার হিসেবে।
একুশের গ্রন্থমেলা ২০২২ য়ে, বিদ্যাপ্রকাশের কর্ণধার লেখক প্রকাশক মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান খোকা ভাই, “বায়ান্নর ৭০ বছর” পূর্তি উপলক্ষ্যে বিদ্যাপ্রকাশ অনলাইন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, ভ্রমণ গদ্যকার, সাহিত্য বিশ্লেষক, শিশুসাহিত্যিক, আলোকচিত্রী, অঙ্কন শিল্পী, প্রকাশক ও পাঠকদের সাথে প্রতিদিন সরাসরি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেছিলেন । আর এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যাপ্রকাশের গুমটি থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থানরত বাংলা ভাষাভাষীদের মাঝে বাংলাদেশের লেখক এবং বইগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। আর তারই সুত্র ধরে খোকা ভাই আমাকেও তার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করে দেশের মাটিতে বসে লেখালেখি সম্পর্কে আমার মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ তাঁকে।
দেখা হয়েছিল কানাডা প্রবাসী, লেখক -ইত্তেফাকের সাংবাদিক সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল ভাইয়ের সাথে। অসীম সাহসী লোক তিনি। কানাডায় অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর খুনীর বাসার সামনে লাইভে যেয়ে তিনি জুতা টাঙিয়ে রেখেছিলেন! অসীম মমতায় তিনি আমাকে তাঁর লেখা বই উপহার দেন! মেলায় ঘুরে সব বই পেতে কষ্ট হবে বিধায় একজনকে দায়িত্ব দিয়ে দেন আমার পছন্দের সব বই কিনে দিতে। শ্রদ্ধা তাঁকে। তিনি নিয়মিত ফেসবুকে চমৎকার সব ব্যতিক্রমধর্মী কবিতা উপহারও দেন আমাদের। দেখা হলো ২০১৪ তে কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত শ্রদ্ধেয় জাকির তালুকদার ভাই’র সাথে। যিনি একজন ডাক্তার হয়েও সম্পূর্ণ নিবেদিত মানবতার সাহিত্যে, চমৎকার সব গল্প লিখেন তিনি অনায়াসে! জাকির ভাই জানালেন এবার প্রবন্ধে বাংলা একাডেমি কতৃর্ক সাহিত্য পদকে ভূষিত হোসেনউদ্দীন হোসেনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের জন্য তিনি পরিবারসহ যশোর যাচ্ছেন। যশোরের ঝিকড়গাছা উপজেলার গডকালি ফুলের গ্রামে দিনভর চলবে আলোচনা, কবিতাপাঠ, গান সেই সাথে খানাপিনা।
যশোর আমার শহর, আমার শৈশব-বাড়ন্ত বয়সের সব স্মৃতি ওকে ঘিরে। ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে আমিও ঢাকা থেকে দু দিনের প্লেনের টিকিট কাটি পুরনো সব মানুষ জনকে দেখবো বলে। পাড়ার সব বাড়ি ঘুরে, স্কুল-কলেজের বন্ধুদের সাথে আন্তরিক আড্ডা শেষে পরের দিন সকালে হাজির হই গডকালি লেখক হোসেনউদ্দীন হোসেনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে।
কে এই জনাব, হোসেনউদ্দীন হোসেন (৮০) ? তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, পেশায় কৃষক, এবং মূলত কথাশিল্পী। এক সময় দেশ সেরা সাহিত্য পত্রিকা এবং দৈনিকে তাঁর লেখা ছাপা হতো বেশ গুরুত্বের সাথে। যেমন: সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’-এ, কবি আহসান হাবিব সম্পাদিত দৈনিক বাংলাতে এবং আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘সংবাদ সাময়িকী’তে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতা, গল্প – প্রবন্ধ। তাঁর ইংরেজিতে অনূদিত উপন্যাস ‘প্লাবন এবং একজন নূহ’ প্রকাশিত হয়েছে ইংলন্ডের মিনার্ভা থেকে। যেখান থেকে তিনি এখনো প্রতিবছর রয়্যালিটি পান কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা। কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি কতৃর্ক ঐ বছরের সেরা ১০টি বইয়ের তালিকায় বইটি স্থান পায়, এবং তাঁকে সেরা একশজন লেখকের একজন ঘোষণা করে ২০০৬ সালে কেম্ব্রিজ ভার্সিটি তাঁকে লন্ডন সফরের আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে তাঁকে সম্মানীত করার পাশাপাশি স্বর্ণপদক দেয়া হয়। এছাড়াও দিল্লির পেন এন্ড পাবলিশার্স থেকে ইংরেজি অনুবাদে বেরিয়েছে তাঁর ‘ইঁদুর এবং মানুষেরা’ বইটি। কোলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ সালে বাংলা বিভাগে হোসেনউদ্দীন হোসেনের ‘ইঁদুর ও মানুষেরা’ উপন্যাসটি এম এ ক্লাসের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্তে করা হয়েছে। আমাদের যশোরের ঝিকড়গাছা উপজেলার গডকালি গ্রামের গর্ব এমন এক মহান মানুষের পাশে ছিলাম একটা দুপুর। তাঁর ভেতর কোন অহংকার নেই, যতক্ষণ ছিলাম সম্মান আর যত্নের কোন ত্রুটি করেন নাই। তিনি বিশ্বাস করেন ভাল লেখক হওয়ার জন্য রাজধানীতে বাস করার প্রয়োজন নাই, তবে দেশি – বিদেশী সকল ধরনের লেখা পড়ারও বিকল্প নাই।
দেশি -বিদেশী নানা ধরনের সাহিত্য পড়ার বিকল্প নেই বিধায় “ বইহোক বিশ্ববাঙালির মিলন সেতু”, শ্লোগানে মুক্তধারার আয়োজনে জুলাই’র ২৮ থেকে ৩১ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠীত হয়ে গেলো ৩১তম নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলা। বাংলাদেশ ও কোলকাতার পরে এটিই সবচেয়ে বড় বইমেলা। বাংলা ভাষার পাঠক ও লেখকদের সবচেয়ে বড় মিলনমেলা। বাংলাদেশ ছাড়াও উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং ভারত থেকে লেখক, প্রকাশকরা এই মেলায় অংশ নেন। নতুন বই, আলোচনা, ছড়া, কবিতা, সেমিনার, গান, আড্ডা আর খ্যাতিমান লেখক প্রকাশকদের পদচারনায় মুখর নিউইয়র্ক।
এমন একটা সময় ছিল যখন কারো সাথে বন্ধুত্বটা গাঢ় হতো যার সংগ্রহে বই আর ফুলের গাছ আছে তার সাথে। প্রতিদিন একটা করে ফুলের গাছ কিনলেও, বইটা আমি কেনার চাইতে বন্ধুর কাছ থেকে নিয়ে পড়তে বেশি ভালবাসি। এর কারণ অনেক অনুসন্ধান করেছি, আর যেটা মনে হল, আসলে বই কেবল আত্মার মুক্তি নয়, এটা বন্ধুত্বের মধ্যে একই মানসিকতা বা রুচি বর্ধকের মতো কাজ করে, সম্পর্ক জোড়দার করে, ভাবনা বিনিময় করে, আর নিজে বই কিনে ফেলে রাখলেও, লোন করা বই পড়ে ফিরিয়ে দেয়ার একটা তাগিদ থাকে। তাই বন্ধুর ভাবনায় প্রভাবিত হতে এবং করতে অবশ্যই বই লেনদেন বিষয়টি বিবেচনায় থাকতে পারে। আর এ লেনদেনের উৎপত্তিস্থল হতে পারে বইমেলা, কারণ সমমনা বন্ধুরা জড়ো হয় বইমেলাতে ঝিঁ ঝিঁ পোকার মতো সাহিত্য কোরাস সন্ধানে!
শারীরিক সুস্থতার জন্য বই হতে পারে মানুষের একনিষ্ঠ বন্ধু, বই হতে পারে মুক্তি! বই হতে পারে পথ্য — তাই বই কিনি, পড়ি, উপহার দিই এবং সেই সাথে লোনও!
লেখক: আমেরিকা প্রবাসী কবি