আন্তর্জাতিক আলোকচিত্রশিল্পী পাভেল রহমান (নিউ ইয়র্ক, আমেরিকা) লিখেছেন: আলোকচিত্রাচার্য মঞ্জুর আলম বেগ স্যারকে নিয়ে
আলোকচিত্রাচার্য মঞ্জুর আলম বেগ স্যার !
আমার শ্রদ্ধা !!
সায়েন্স ল্যাবের ঐ গলিতে অল্প কিছুটা সময় পেয়েছিলাম আমি। বিখ্যাত রশিদ তালুকদার ভাইয়ের সাথে এবং পরেও। তবে রেগুলার নয় মাঝে মাঝে। সবার মত রশিদ ভাইও প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করতেন আলোকচিত্রাচার্য মঞ্জুর আলম বেগ স্যারকে।
আমার ইচ্ছা থাকলেও দৈনিক পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে দূরত্ব বেড়েছিল বিপিএস এর সাথে।
১৯৮৫ সালে চট্টগ্রাম উপকূলে প্রলয় এলো। সেই সাইক্লোনে সাগরের ভিতরে ১২ ঘণ্টা ভেসে থাকা ডুবো চর উড়িরচরকে শুধু বাংলাদেশ নয় চিনলো পৃথিবী, মিডিয়ার কারনে। উড়ির চরে আমি ঝড়ের তৃতীয় দিনে একটা ছবি তুলেছিলাম। স্বামী স্ত্রী হারিয়ে খুঁজে পাওয়ার ঐ ছবিটি ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় ছাপা হলো। ছবিটি পছন্দ করলেন রশিদ ভাই।
তার আগ্রহে তোপখানা রোডের বাসায় খবরের কাগজের বান্ডিলে ভাবী আমার ছবিটা খুঁজে পেলেন। ছবিটির একটা প্রিন্ট আগাম রেখেছিলেন রশিদ ভাই।
১৯৮৬ সালে ‘ শিল্পকলা একাডেমী আর ফটোগ্রাফিক সোসাইটি BPS জাতীয় আলোকচিত্র প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। আর সেই দিনই এন্ট্রির শেষ দিন। শুধু শেষ দিনই নয় মাত্র ঘণ্টা খানেক বাকি ঘড়ির কাটায়। আমার ঐ ছবিটি ‘ মহামিলন ‘ নিয়ে ছুটলাম আমার হুন্ডায় শিল্পকলায়। ছবিটি শেষ ছবি হিসেবে এন্ট্রি হলো ৪টা বাজার শেষ মুহূর্তে।
আমি উদগ্রীব। জীবনে প্রথম দেশে কোন প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছি বলে টেনশন হচ্ছে। তাছাড়া আমি জানি না আমার তোলা এমন একটা ছবি যে জাতীয় আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে তা ভেবে। রশিদ তালুকদার অভিজ্ঞতায় শীর্ষে। প্রতিটা প্রতিযোগিতা দেশে বিদেশে অংশ নিচ্ছেন তিনি। সেই দিক দিয়ে সকল কত্ ত্ব রশিদ ভাইয়ের, ছবি জমা দেবার ব্যাপারে। সাড়াদেশ থেকে কত হাজার আলোকচিত্র জমা পড়েছে শুনলাম। রশিদ ভাই মাঝে মাঝে প্রতিযোগিতার খবর ক্লাবে বলে যান। জাজদের প্রতিক্রিয়া তার মুখেই শুনলাম। শিল্পকলা বাছাই রুমের ফ্লোরে বাছাই করা ছবি গুলি নিয়ে জড়ো হয়েছেন বিচারকরা। গোল বৃত্তকারে ফ্লোরে সাজানো সব ছবি। ঘুরে ঘুরে দেখছেন আর মার্ক দিচ্ছেন বিচারক মণ্ডলী। দেখছেন ছবির সাবজেক্ট লাইট কম্পোজিশন শার্পনেস ইত্যাদি !
আমার ছবিটি পথ আটকিয়ে ফেলছে অনেক বিচারকের। এর মাঝে আলোকচিত্রাচার্য মঞ্জুর আলম বেগ স্যারের অভিবক্তি ভিন্ন। এমনিতেই তিনি সাধারনের মাঝেও অসাধারণ বক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। তার চশমা পাইপ টানার স্টাইল ড্রেস সবার থেকে ভিন্ন। সেই দিন তিনি হাতে পাইপ নিয়ে প্রতিটি ছবি অন্যদের চেয়ে অতিরিক্ত মনোযোগে দেখে চলেছেন। কোনো ছোট বিষয় কারো চোখ এড়িয়ে গেলেও তার চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না। যা তিনি আমাদের ক্লাসে তুলে ধরতেন নিয়মিত।
জাজমেন্টে কোন ভুল তাঁর চোখ ফাঁকি দিতে পারে না !
কিন্তু ১০X১২ সাইজের সাদা কালো একটি ছবি তাঁর পথ আঠকে দিচ্ছে বারবার। তিনি ছবিটির সামনে এসে মুখ থেকে পাইপ ডান হাতে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকতেন আবার বাম হাতে চশমাটা নাকের উপর টেনে জোড়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ছেন হু… উ উ উ উম শব্দ তুলে ! ঘুরে ঘুরে আসছেন সব ছবি দেখে দেখে। কিন্তু ঐ একটি ছবির সামনে এসে থমকে দাঁড়ান তিনি, আটকে যায় তাঁর চোখ ! তিনি তাকিয়ে দেখেন অনাবিল ! পাইপ মুখ থেকে নামিয়ে চশমাটা টেনে তুলে আবার একই ভাবে হু… উ উ উ উম শব্দ তোলেন।
সম্মানিত বিচারকদের রায়ে সেই ছবিটিকেই দেয়া হলো সর্বচ্চো নাম্বার এবং সেই ছবিটি স্বর্ণ পদকে ভূষিত হলো ১৯৮৬ সালের জাতীয় আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায়।
আমার সৌভাগ্য সেই ছবিটি ছিল আমার তোলা উড়িরচরে হারিয়ে ফিরে পাওয়া স্বামী স্ত্রীর ‘ মহামিলন ‘।
আলোকচিত্রাচার্য মঞ্জু আলম বেগ স্যার
আমার কৃতজ্ঞতা !
(নিউ ইয়র্ক, আমেরিকা)
২৬ জুলাই ২০২১।
আলোকচিত্রাচার্য মঞ্জু আলম বেগ স্যার
ছবি নেট থেকে নেয়া।
স্বর্ণপদক প্রাপ্ত আমার তোলা ‘ মহামিলন ‘ ১৯৮৬ !