সুপ্রভাত
এই গল্পের কাহিনিকাল ও চরিত্রসমূহ গত শতাব্দীর আশির দশকের।
ট্রেনটি যখন লাহিড়ী মোহনপুর এসে পৌঁছে তখন শেষ বিকাল। একটুপর সূর্য ডুবে যাবে। আশ্বিন মাস। তখনও বন্যার পানি মাঠে খালে বিলে নদীতে থৈথৈ করছে। বাড়িতে যাওয়ার অন্য কোন পথ নেই। মতিন স্টেশনের অদূরে ঘাট থেকে একটি ছোট নৌকায় করে তার গ্রামের বাড়ি কৈবর্তগাঁতী রওনা হলেন।
আবদুল মতিন চাকরি করে ঢাকার লালবাগে একটি এ্যালুমেনিয়াম কারখানায়। সে ঐ কারখানার একজন ফোরম্যান । ছুটিছাটা খুব কম পায়। বছরে এক দুইবার বাড়ি আসে। এবার সে বাড়ি আসছে তার স্ত্রীর অসুখের খবর পেয়ে।
শেষ বিকালের আবছা আলোয় নৌকাটি চলতে থাকে ছলাৎছলাৎ করে। ভরা জলের মাঠ পেরিয়ে নৌকাটি চলছে ধীরে। মতিন মিয়া পাটাতনের উপর চুপচাপ বসে আছে। বালিহাঁস মাথার উপর দিয়ে শোঁ-শোঁ করে উড়ে চলে যাচ্ছে তাদের কুলায়। জলের উপর আমন ধানের ডোগাগুলো ভাসছে। জল কমবে, ডোগাগুলোও আস্তে আস্তে নুয়ে পড়বে। জায়গায় জায়গায় সাদা রঙের শাপলা ফুল ফুটে আছে। ঢেউ লেগে জলে ভিজছে পাপড়িগুলো।
এখানে জলের প্রান্তর দেখতে সাগরের মতো লাগে। বিশাল পাথার পেরুলেই তারপর নদী, তারপর গ্রাম। মতিন সামনে জলের দিকে তাকিয়ে আছে। মনটা খুবই বিষণ্ণ। সে এখনও জানে না, তার স্ত্রী এখন কেমন আছে?
নৌকার ভিতর আরও কয়েকজন মানুষ আছে। কারোর সাথে তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তাদের কাউকেই সে চেনেও না। ভিন গাঁয়ের মানুষ। তারা বিভিন্ন ঘাটে নেমে যাবে।
সন্ধ্যা নামছে জলের উপর। ক্রমে আঁধার হয়ে আসছে। দূরের কোন গ্রাম দেখা যাচ্ছিল না। একসময় নৌকাটা কোমলা নদীতে এসে পড়ে। প্রচণ্ড ভাটি স্রোত। নৌকাটি বেগ পেল। মতিন মিয়া খোলা আকাশের দিকে চেয়ে দেখে — তারায় তারায় আকাশ জ্বলজ্বল করছে। চাঁদও উঠেছে। এমন তারাভরা আকাশ আর চাঁদ দেখলে যে কারোর মন ভালো হওয়ার কথা। কিন্তু মতিন মিয়ার মন ভালো হলো না। তার মন নিমগ্ন হয়ে পড়ে আছে তার ঘরে।
একটু পর নৌকার মাঝি মতিন মিয়াকে বলল — কৈবর্তগাঁতী এসে গেছি। কোন্ ঘাটে নৌকা ভিড়াব?
মতিন মিয়া বলল — হরি মন্দির ঘাটে।
আব্দুল মতিন নৌকা থেকে ঘাটে নামে। চাঁদের আলোয় হেঁটে হেঁটে সে বাড়ির দিকে যেতে থাকে। বাড়িতে এসে দেখে – ঘরের দরজা বন্ধ। ভিতরে হারিকেন জ্বলছে। সে দরজায় কড়া নাড়ে। ভিতর থেকে এক বৃদ্ধা দরজা খুলে দেয়। সে ছিল মতিনের মা।
চৌকির উপর তার স্ত্রী ফাতেমা শুয়ে আছে। প্রায় সাত মাস পর মতিন তার স্ত্রীকে দেখল। ফাতেমা তার স্বামীকে দেখে চোখের জল আটকাতে পারল না। সে ঝরঝর করে কাঁদছে। মতিন তার স্ত্রীর হাতখানি ধরে, এবং বলে — তোমার কী হয়েছে? শরীর এত শুকিয়ে গেছে যে!
ফাতেমা বলে — বঙ্কিরাটের সাইফুল ডাক্তারকে দেখিয়েছি। সে বলেছে — আমার নাকি কলিজায় কঠিন অসুখ হয়েছে। ঔষধও খেতে দিয়েছে। উনি বলেছেন, সদর হাসপাতালে যেয়ে বড় ডাক্তার দেখাতে হবে ।
— তুমি যাও নাই?
— না। ভেবেছিলাম তুমি এলে তোমার সাথে যাব।
— কতদিন ধরে এই সমস্যা?
— তিনমাস হবে।
— আমি কালই তোমাকে সদর হাসপাতালে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
মতিনকে দেখার পর থেকেই ফাতেমা যে কাঁদছে, তা থামছিল না। সে বলছিল — কতদিন তোমার আসার পথের দিকে চেয়ে থেকেছি। প্রায়দিনই হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম নদীর ঘাটে। চেয়ে দেখতাম স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা নৌকাগুলির দিকে। কিন্তু কোনও নৌকায়ই তোমাকে দেখতে পেতাম না।
মতিন ফাতেমাকে বলে — তুমি এত শুকিয়ে গেছ কেন? খেতে পারো না?
— না। খেলেই বমি করে ফেলি। বমির সাথে রক্তও আসে। পেট খুব ব্যথা করে। চিৎকার করি। আল্লাহকে ডাকি। তোমাকে ডাকি।
— টুটুল কই?
— ওর ফুপু এসে নিয়ে গেছে আমার এই অবস্থা দেখে। ফাতেমা কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠছিল । খুব কষ্ট হচ্ছিল। কথাও ঠিক মতো বলতে পারছিল না।
মতিনের মা ভাত খেতে বলে ছেলেকে। মতিন খেতে চায় না। তবুও জোর করে সামান্য কটা ভাত খাওয়ানোর চেষ্টা করে । মতিন খেতে পারে না। ওর চোখে জল চলে আসে। ফাতেমাকে বলে — তুমি খাবে না?
ফাতেমা মাথা নেড়ে বলে — না৷ খেলেই রক্ত বমি করে ফেলব।
মতিন ফাতেমাকে বলে — তুমি ঘুমাও। আমি তোমার শিয়রে সারারাত বসে থাকব। ভোর হলেই আমরা নৌকা করে চলে যাব সদরে। ফাতেমা তার স্বামীর হাত ধরে বলে, আমাকে ধরে একটু বাইরে নিয়ে যাও। উঠোনে তোমার হাত ধরে হাঁটব।
মতিন ফাতেমাকে ধরে উঠোনে নিয়ে আসে। সারা গ্রাম তখন নিঝুম হয়ে গেছে। চাঁদের আলোয় ভেসে আছে আঙিনা। ফাতেমা ওর স্বামীকে বলে — আমাকে ধরে একটু পুকুর পাড়ে বকুলতলায় নিয়ে যাবে? মতিন তার স্ত্রীকে পাঁজরে জড়িয়ে বকুলতলায় বাঁশের মাঁচার উপর নিয়ে বসিয়ে দেয়।
ফাতেমা বলে — আমি একটু তোমার গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকি?
— থাকো।
— তোমার মনে আছে? আমাকে যেদিন তুমি তোমাদের বাড়িতে প্রথম নিয়ে এসেছিলে, প্রথম সেই রাতে তুমি আমাকে এই বকুলতলায় এনে বসিয়েছিলে। সেদিনও ছিল আজকের মতো এমনই চাঁদের রাত। বকুলের গন্ধে আমরা দুজন কী যে আকুল হয়ে উঠেছিলাম! ওগো, তুমি আমাকে তোমার বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো না! আমাকে ছেড়ো না। আমি মনে হয় দূরে কোথাও চলে যাব। আমাকে তুমি যেতে দিও না। তোমার বুকের মাঝে আমার বহুদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে ।
মতিনেরও মনে পড়ছিল কত কথা। ফাতেমা সব দুঃখ, গ্লানি ভুলিয়ে দিয়েছিল– ও যখন এল তখন জীবনে আর কিছু চাইবার থাকল না, তার সব চাওয়া পূর্ণ করে দিলো। মনে করত — তার মতো সুখী মানুষ জগতে আর কেউ নেই।
ফাতেমার শরীর কাঁপছিল খুব। সারা শরীরে প্রচণ্ড জ্বর। মতিন ফাতেমাকে পাঁজরে জড়িয়ে ঘরে নিয়ে আসে। এবং বিছানায় শোয়ায়ে দেয়।
ফাতেমা আরও কিছুক্ষণ জেগে ছিল। সে অস্ফুট করে মতিনকে বলছিল — তুনি নৌকায় করে আমাকে লাহিড়ী মোহনপুর স্টেশনে নিয়ে যাও। তারপর ট্টেনে করে তোমার ওখানে নিয়ে যাবে। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ছাড়বে। ঝিকঝিক করে চলতে থাকবে ট্রেন! জানো, তোমার কাছে আমার জনম-জনম-কাল থাকতে ইচ্ছে করে।
ফাতেমা একটু ঘুমের মতো হয়ে যায়। মতিন হারিকেন জ্বালিয়ে স্ত্রীর শিয়রে বসে থাকে। সারারাত চোখের পাতা ক্ষণতরেও বন্ধ করল না।
শেষ রাতের দিকে হঠাৎ ফাতেনার হেচকি ওঠে। কথা বন্ধ হয়ে যায়। মতিন ওর মাকে ডাকে। ওর মা উঠে এসে ফাতেমার শিয়রে বসে। ফাতেমা মতিনের দিকে এক দৃষ্টিতে নীরব।
Canada:
১ Comment
এমন ট্রাজেডি গল্প যেন বাস্তব