বহুমাত্রিক ও সাম্যবাদী চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলাম
– আবুল খায়ের
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। যিনি ২৪ মে ১৮৯৯ইং তারিখে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলা ভাষাকে নিয়ে গেছেন অনেক উঁচুমাত্রায় করেছেন সমৃদ্ধশালী। বাংলা সাহিত্য আজকে যে দাপটের সাথে নিজেকে উপস্থাপন করার প্রয়াস পাচ্ছে, তার মূলে রয়েছে কিছু সাহিত্যিকদের নিরলস সৃষ্টিকর্মের ফলাফল। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষতা বৃদ্ধিতে যাঁরা অবদান রেখেছেন, তম্মধ্যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম অন্যতম। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সঙ্গীতজ্ঞও বটে। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় তাঁর অবিচল পদচারণা ও আস্থা তাঁকে এনে দিয়েছে মুকুটহীন সম্রাটের মর্যাদা। অতি সাধারণ ও গরিব পরিবারে জন্ম নেয়ার কারণে বিভিন্ন সাধারণ পেশার মানুষের সাথে মিশে সৃষ্টি করেছেন তাঁর সব মূল্যবান সাহিত্য উপাদান। কবিতা লিখে জেলে যাওয়ার মতো ঘটনাতো বিশ্বে বিরল। জেলে থাকাবস্থায় তৎকালীন প্রভ‚ রূপী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কলম চালনার মতো সাহস দেখিয়েছিলেন। যেটা বিশ্বের যেকোন সাহিত্য ইতিহাসে বিরল ঘটনাও বটে।
আট-নয় বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পর তিনি পরিবারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সংসার চালানোর জন্য তিনি প্রথমে মাজারের সেবক ও মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি পড়ালেখা চালিয়ে যান। গ্রামে অবস্থিত এলাকার একটি মোক্তব থেকে নিম্ন প্রাথমিক পাশ করেন। খুব অল্প বয়সেই তিনি নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত ও কোরান তেলাওয়াত সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ লাভ করেন। আর এতে করে তিনি তাঁর লেখনিতে ও ইসলামী সঙ্গীত রচনায় নিজেকে বেশ সফলভাবে কাজে লাগিয়েছেন পরবর্তী দিন গুলোতে। আধুনিক বাংলা গানে তাঁর পান্ডিত্যের জন্য তাকে ‘বুলবুল’ নামে ডাকা হয়। তিনি সারাজীবন দেখেছেন এবং কলম ধরেছেন অবিভক্ত বাংলার পরাধীনতা, সামরাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ এবং বিভিন্ন শাসক শ্রেণির শোষণের বিরুদ্ধে। বাংলা সাহিত্যে তাঁর সফল বিচরণের জন্য এবং দ্রোহী মনোভাবের কারণে তাকে ‘বিদ্রোহী কবি’ বলা হয়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি তাঁর লেখা সেরা কবিতা গুলোর একটি। যা তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর মসনদ’কে নাড়া দিয়েছিলো। ফলে তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ ও পত্রিকা ইংরেজ সরকার নিষিদ্ধ করে এবং তাঁকে কারাদন্ডে দন্ডিত করে। আদালতে লিখিতভাবে ‘রাজবন্দির জবানবন্দী’ রচনা করেন, চল্লিশ দিন একটানা অনশন করেন এবং প্রতিবাদ জানান এই বিদ্রোহী কবি। ইংরেজ সরকারের শোষণের বিরুদ্ধে ও জেল-জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে বিশে^র সাহিত্য ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। কেউ কেউ তাঁকে তারুণ্যের কবিও বলে থাকেন। তার কারণ তিনি সব সময় তারুণ্যের উচ্ছ¡াসকে প্রেরণা দিয়েছেন নিরলসভাবে। তিনি কখনো কাউকে অনুসরণ করতেন না। যখন যা দেখেছেন, প্রত্যক্ষ করেছেন নিজ অন্তরচক্ষু দিয়ে, যা উপলব্ধি করেছেন আর তাই লিখেছেন। তাঁর কবিতার সংখ্যা ‘ত্রিশোত্তর’ যার প্রায় সবগুলিই ছিল আধুনিক ভাব ধারার। তাঁর উক্ত প্রতিবাদী মনোভাবের কারণে নোবেল জয়ী বিশ^ কবি রনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে সমর্থন জানান এবং তাঁকে গ্রন্থ উৎসর্গ করে শ্রদ্ধা জানান।
তিনি সমকালীন প্রসঙ্গ, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়কে ধারণ করার কারণে পাঠক সমাজে এক অভ‚তপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সমর্থ্য হন। কবিতা ও গানে হিন্দু ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান, মুসলিম ধর্মের মূল বিষয়বস্তু ইত্যাদিকে বেশ ভালোভাবে এবং সফলভাবে উপস্থাপন করেছেন।
কবি নজরুল লোকনাট্য, পালাগান, কবিগান রচনা করেন। কিশোর বয়সেই সৃষ্টি করেন-চাষার সঙ, শকুনিবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভ‚তুম, রাজপুত্রের সঙ, বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ, মেঘনাদ বধ ইত্যাদি। তিনি একজন সফল গীতিকার। তিনি নজরুলসঙ্গীত রচনা করে বাংলা সঙ্গীতকে নিয়ে গেছেন বিশ্বদরবারে। অসংখ্য গান আজ বাংলা সাহিত্যে অমূল্য সম্পদও বটে।
গরিব বলে আর্থিক অনটনের কারণে পড়ালেখা চলমান রাখতে পারেননি। তবে তাতে কী, তিনিও দমে যাননি। বিরতি দিয়ে আবার ভর্তি হলেন রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ স্কুল। পরে আবার মাথরুন উচ্চ ইংরেজী স্কুলে। ষষ্ঠ শ্রেণির পর ছাত্রজীবনে আবার বিঘ্ন ঘটে। যোগ দেন বাসুদেবের কবি দলে। কিছু দিন পর আবার এক খ্রীস্টান রেলওয়ে গার্ডেও খানসামা পদে এবং শেষে আসানসোলে ‘চা-রুটি’ দোকানে কাজ করার সুযোগ কাজে লাগান। আর্থিক অনটন আর ছোট খাটো চাকুরি এবং এই ছোট বয়সে বাস্তবতার তীব্রভাবে মুখোমুখী হওয়ার কারণে তাঁর কলমের তীক্ষ্ণধার আরো শাণিত হয়। চা-রুটির দোকানের চাকুরি করা অবস্থায় দারোগা রফিজউল্লার সঙ্গে পরিচয় ঘটে বালক নজরুলের। তাঁর অনুপ্রেরণায় নজরুল ১৯১৪ সালে ত্রিশালের (ময়মনসিংহ জেলার) দরিরামপুর স্কুলে ভর্তি হলেন সপ্তম শ্রেণিতে। এক বছর যেতে না যেতেই তিনি আবার গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান। ১৯১৫ সালে আবার সেই আগের রানীগঞ্জ স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এবার আর স্কুল পরিবর্তন নয়। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা একই স্কুলে শেষ করলেন। তবে প্রিটেষ্ট পরীক্ষার সময় যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। ১৯১৭ সালের শেষদিক থেকে ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর ছিলেন সামরিক বাহিনীতে। সামরিক বাহিনীতে কাজ করার কারণে বেশ কিছু লেখার উপকরণও কাজে লাগিয়েছেন অত্যন্ত সফলভাবে। সৈনিক জীবনকে উপজীব্য করে বেশ কিছু গান, কবিতা, গল্প বা নাটকে প্রভাব দেখা যায়। ‘চল চল চল’ একটি বিখ্যাত রণ সংগীত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে আজ অবধি। ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ প্রথম গদ্য রচনা। মুক্তি নামক কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত কবিতা। করাচির সেনানিবাসে থাকাবস্থায়ই তাঁর সাহিত্য চর্চাটা বেশ প্রাণবন্ত ছিল। যেমন-‘হেনা’ ‘ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে প্রভৃতি বিখ্যাত গল্পের রূপকার। ‘আশায়’, কবিতা সমাধি প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ রচনা করার সুযোগ পেয়েছেন সামরিক জীবনে।
যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়, তখন ১৯২০ সালে মার্চ মাসে নজরুল দেশে চলে আসেন এবং কলকাতায় সাহিত্য চর্চা ও সাংবাদিকতা শুরু করেন। বাঁধন হারা উপন্যাস এবং বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া পারের তরণী, কোরবানী, মোহরম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্দহম প্রভৃতি কবিতা যখন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তখন চারিদিকে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এসময় তৎকালীন সকল গুণীজনদের সাথে তাঁর যোগাযোগের দরজা উন্মুক্ত হয়। তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সাক্ষৎ করেন এবং বহুদিন প্রায় দুই দশক ধরে সে সম্পর্ক অটুট ছিল।
ইতিমধ্যে নজরুল পরিচিত হন পুস্তক প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে। তাঁর সঙ্গেই নজরুল প্রথম কুমিল্লায় বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন এবং প্রমীলার সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিছু দিনের মধ্যে যখন অসহযোগ আন্দোনে কুমিল্লায় নিজে অংশগ্রহণ করেন। বেশ কিছু প্রতিবাদী বা জাগরণের গান রচনা ও সুরারোপ করেন। ‘এ কোনো পাগল পথিক ছুটে এলা বন্দিনী মার আঙ্গিনায়, আজি রক্ত নিশি ভোরে/একি এ শুনি ওরে/মুক্তি কোলাহল বন্দী শৃঙ্খলে প্রভৃতি জাগরণী গান জনগণকে আরো ঐক্যবদ্ধ হতে শক্তি যোগাল। বলা যায় তিনিও একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বিবেচিত হলেন। এ সময় ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও ‘ভাঙার গান’ সঙ্গীত রচনা করেন। তুরস্কের সমাজজীবনকে নতুনরূপ দানকারী মোস্তফা কামাল পাশা’র প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে রচনা করেন-‘কামাল পাশা’। এর পর ‘সাম্যবাদী’ ও ‘সর্বহারা’ কবিতাগুচ্ছ অনেকটা রাশিয়ান কমিউনিস্ট-এর প্রতি তাঁর সমর্থন পাওয়া যায়। ‘ব্যথার দান’ গল্প সংকলন; ‘অগ্নি বীণা’ কবিতা সংকলন এবং প্রবন্ধ গ্রন্থ যুগবাণী। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশ হলে ওই দিনের পত্রিকার সংখ্যাটি নিষিদ্ধ করা হয় এবং প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘যুগবাণী’ বাজেয়াপ্ত করা হয়। শুধু তাই নয়, সে দিন কবিকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। আর সে ঘটনা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে আজো বিবেচিত হচ্ছে সাহিত্যের ইতিহাসে। আর সেটা হলো কবি নজরুল আত্মপক্ষ সমর্থন করে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেট সুইনহোর আদালতে যে জবানবন্দী প্রদান করেন, তা ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে সাহিত্য মর্যাদা পেয়েছে। যদিও কবিকে এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়েছিল সে আদালতে। ওই জেলখানায় তিনি রচনা করেন ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ এক অনুপম কবিতা। এরপর কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় হুগলি জেলে। রাজবন্দিদের প্রতি ইংরেজ জেল সুপার খারাপ আচরণ ও দুর্ব্যবহার করার প্রতিবাদে কবি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। টানা চল্লিশ দিন পর অনশন ভঙ্গ করেন। হুগলি জেলে থেকে কবি রচনা করেন এক বিখ্যাত গান-‘এই শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল’। এরপর কবিকে স্থানান্তর করা হয় বহরমপুর জেলে। এক বছর তিন সপ্তাহ কারাবাসের পর কবিকে মুক্তি দেয়া হয়। আর বহরমপুর জেলে থেকে তিনি রচনা করলেন-‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াৎ খেলছে জুয়া’ বিখ্যাত গানটি। তিনি একজন রোমান্টিক কবিও বটে। তাইতো তিনি রচনা করেছেন-কবিতার সংকলন ‘দোলন চাঁপা। আর এতে ‘পূজারিণী’ একটি বহুমাত্রিক প্রেম ও রোমান্টিক মনমানসিকতার স্বরূপ প্রকাশ পায়।
নজরুলের গান ও কবিতা সংকলন ‘বিষের বাঁশী’ এবং একই মাসে ভাঙ্গার গান প্রকাশিত হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, দু’টি গ্রন্থই সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়। এরপর কবি গান রেকর্ডের দিকে মনোযোগ দেন। ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াৎ খেলছে জুয়া’ এবং ‘যাক পুড়ে যাক বিধির বিধান সত্য হোক’ দুটি গান রেকর্ডের মাধ্যমে কবির নতুন প্রকাশ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন সভা সমিতিতে কবি স্বরচিত দেশাত্ববোধক গান পরিবেশন করতেন। ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উপস্থিতিতে পরিবেশন করেন ‘ঘোর রে ঘোর রে আমার সাধের চর্কা ঘোর’। এর মধ্যে সুযোগ হলো পত্রিকা সম্পাদনা করার। সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ পত্রিকা সম্পাদনার প্রধান দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। এসময় নজরুল পেশাজীবি শ্রমিক, কৃষক সংগঠনের পক্ষে সাম্যবাদী ও সর্বহারা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করলে চারিদিকে তাঁর কবি খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
কবি দেশাত্ববোধক, সর্বহারা শ্রেণির গণসঙ্গীতের প্রতি বেশি আসক্ত ছিলেন। কলকাতার সাপ্তাহিক গণবাণী ও লাঙ্গল পত্রিকা একীভূত করে কাজ শুরু করেন। রচনা করলেন ‘জাগো অনশন বন্দী’ ‘রক্তপতাকার গান’ ইত্যাদি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয় ‘রিক্তের বেদন, কবিতা ও গানের সংকলন চিত্তনামা, ছায়ানট, সাম্যবাদী ও পূবের হাওয়া। বাংলা গজল গানের স্রষ্টা বলা হয় কাজী নজরুল’কে। নিজের গানের স্বরলিপি প্রকাশ করা ছিল এক যুগান্তকরী ও অতুলীয় কাজ। কৃষ্ণনগরে অভাব, অনটন, রোগ-শোক ও দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় থেকেও তিনি একের পর এক গান রচনা করে গেছেন। এসময় গানের সংকলন: ফণি-মনসা এবং পত্রোপন্যাস ‘বাঁধন হারা’ প্রকাশিত হয়। কবি নজরুল ‘ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের’ কয়েকটি সাহিত্য সম্মেলনে যোগদান করার সুযোগ পান। ফলে কয়েকজন প্রগতিশীল অধ্যাপক, ছাত্র ও শিল্পীদের সাথে পরিচয় হওয়ার সুযোগ হয় এবং তাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলতে সক্ষম হন। ইতিমধ্যে কলকাতার মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ-এর মাসিক পত্রিকা ‘মোহাম্মদী’তে নজরূল বিরোধী প্রচারনা শুরু হয়। কিন্তু মোঃ নাসিরউদ্দীনের সওগাত পত্রিকা নজরুলকে সমর্থন করা হয় বলিষ্ঠভাবে। এরপর নজরুল ‘সওগাত’ পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ পেয়ে যোগদান করলেন এবং একটি রম্য বিভাগ পরিচালনার কাজে হাত দেন। মজার ব্যাপার হলো সওগাতে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ‘জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দীন’ কবি নজরুল-কে যুগপ্রবর্তক কবি ও বাংলার জাতীয় কবি হিসেবে প্রথম আখ্যায়িত করেন। যা পরবর্তীতে কবি নজরুলকে ‘জাতীয় কবি’র তকমা মানুষের মনে স্থান করে নিতে সক্ষম হন। পরবর্তী সময়ে উক্ত উপাধি সুপ্রতিষ্ঠিত হয় সাহিত্য প্রেমিকদের হৃদয়ে এমনকি জাতীয় পর্যায়ে। যা আজ সারাবিশ্বে পরিচিত।
কবির প্রিয়পুত্র বুলবুল বসন্ত রোগে মারা যাওয়ার পরে প্রচন্ড মানসিক আঘাত পান। ফলে কবির জীবনের মোড় অনেকটা ঘুরে যায়। তিনি ক্রমশ অন্তর্মুখী হয়ে ওঠেন এবং আধ্যাত্মিক সাধনার প্রতি মনোনিবেশ করেন। বিখ্যাত লেখক হাফিজের রুবাইয়াৎ অনুবাদ করলেন বুলবুলের রোগশয্যায় বসে বসে। রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ নামে যা পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়। এরপর মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাস, অনেকে এটাকে রাজনৈতিক উপন্যাস বলে থাকেন; গানের সংকলন নজরুল গীতিকা, ঝিলিমিলি নাটিকা এবং কবিতা ও গানের সংকলন প্রলয় শিখা ও চন্দ্রবিন্দু। চন্দ্রবিন্দু গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত হয় এবং প্রলয় শিখা’র জন্য নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। আদালতের রায়ে নজরুলের ছয় মাসের সশ্রম কারাদন্ডের আদেশ হয়, কিন্তু নজরুল হাইকোর্টে আপিল ও জামিন লাভ করেন। পরবর্তীতে মামলা খারিজ হওয়ায় নজরুলকে আর ২য় বার কারাবাস করতে হয়নি। কবি চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত হলেন, গানের প্লেব্যাক, গান লেখা, সুর দেয়া ইত্যাদি দিন দিন জনপ্রিয়তার শীর্ষে পোঁছায় নজরুলকে। প্রায় সহস্রাধিক গানের রেকর্ড প্রকাশিত হওয়ায় নজরুলের অবস্থান তখন আকাশচুম্বী। যদিও সব গান যথাযথভাবে সংকলন করা যায়নি বিভিন্ন কারণে। এরপরেও নজরুলের প্রকাশিত গানের সংখ্যা প্রায় দুই সহস্রাধিক । কবি নজরুল হঠাৎ শারীরিকভাবে অসুস্থ ও ক্রমন্বয়ে নির্বাক হয়ে যান, ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ ইং তারিখে তারুণ্যের কবি, দ্রোহের কবি, জাগরণের কবি, প্রেমের কবি, দুনিয়ার মায়া ছেড়ে ওপারে পাড়ি জমান।
পরিশেষে, পুজিবাদী ও শোষনমুক্ত সমাজ গড়তে এবং বিশ্ববিবেক জাগ্রত করতে কবির সাম্যবাদী চেতনা আজ খুবই প্রয়োজন। সাহিত্য বোদ্ধাগণ বলে থাকেন, কবি নজরুল যদি মুসলমান না হতেন এবং ব্রিটিশ বিরোধী লেখা না লিখতেন, তবে কয়েকবার নোবেল বিজয়ী হওয়ার সুযোগ পেতেন। তাই আমাদের উচিত নজরুল সাহিত্য চর্চা ও গবেষণার প্রতি আরো বেশি বেশি মনোনিবেশ করা। সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও শুদ্ধ সাহিত্য চর্চার মাধ্যমেই কেবল আত্মার পরিশুদ্ধতা অর্জন এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব। সমাজ কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবনে ভরে উঠুক সাহিত্যের শুদ্ধতায়। জাতীয় জীবনে সর্বহারা, শোষিত, বঞ্চিত ও দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়ে সমাজ কাঠামো আরো সমৃদ্ধশালী হোক। মানবিক মূল্যবোধের উন্মেষ ঘটুক সারাবিশ্বে। মেহনতি মানুষের বিজয় সুনিশ্চিত। (লেখক: কবি ও কলামিস্ট)