কথার কথকতা :
চা, তরল পানীয় ও আটা সমাচার
(মাইন উদ্দিন আহমেদ)
রোববার রাত এখন প্রায় তিনটা। আগামী সংখ্যার জন্য আমার নির্ধারিত কলাম কথার কথকতা-র লেখা এখনো পাঠানো হয়নি। আজ না দিলে লেখাটি এ সংখ্যা পত্রিকায় ধরানো সম্ভব নয়। জ্যাকসন হাইট গিয়েছিলাম একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে, আসতে হয়েছে দেরী আর আনুসঙ্গিক কাজকর্ম সেরে ফ্রী হলাম এইমাত্র। ক্লান্তি বোধ করছি কিন্তু লেখাটা শেষ করে ইমেইলে এক্ষুনি পাঠাতে হবে তাই একটু চা বানিয়ে কাপটা সামনে রেখেই ফোনটা হাতে নিয়ে টাইপ শুরু করলাম। বিষয় আগেই ভেবে রেখেছিলাম। আজকের লেখাটার শিরোনাম হতে পারে, ‘চা, তরল পানীয় ও আটা সমাচার’। প্রিয় পাঠক, কি ভাবছেন? জ্বী হাঁ, নতুন তথ্য পাবেন অবশ্যই, মজাও পাবেন।
সময়টা হবে সম্ভবতঃ ১৯৬৫-৬৬-র দিকে। পাশের বাড়ির ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার প্রার্থী এক আংকেলের আহ্বানে আব্বার অনুমতি নিয়ে মিস ফাতেমা জিন্নার মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম আর মিছিল শেষে চা আর ত্রিভূজ আকৃতির কুকীজ খেয়েছিলাম। তার পরবর্তী সময়ে রেডিওতে কাশ্মীর নিয়ে পাক-ভারত যুদ্ধের নিউজ শোনা যেতো। হ্যাঁ, ষাটের দশকের মাঝামাঝি হবে যখন আমরা স্কুলে ফাইভ বা সিক্সে পড়তাম। আমাদেরকে কিভাবে চা, তরল পানীয় ও আটা খাওয়া শেখানো হয়েছিলো তা খুব সংক্ষেপে বলবো।
গ্রামের বাজারগুলোতে তখন সাধারণত সপ্তাহে দুদিন হাটবার থাকতো। অন্যান্য দিনে দোকানপাট খোলা থাকলেও তেমন জমতোনা, হাটবারে জমজমাট গিজগিজ অবস্থা থাকতো। কিছু লোক ঠেলাগাড়িতে চুলা বসিয়ে বাজারের সবচেয়ে ব্যস্ত প্রবেশ পথে চা বানাতো এবং সবাইকে বিনা পয়সায় খাওয়ার আহ্বান জানাতো। চা খাওয়ার নানাবিধ উপকার বর্ননা করা হতো। এতে কাজ না হওয়াতে পরে একটা উপহার সাথে যোগ করা হয়েছিলো। তা হলো, যিনি এক কাপ বিনা পয়সার চা খাবেন তিনি খাওয়ার পর এক প্যাকেট বিড়ি পাবেন। বিড়ির ব্র্যান্ড হতো, যে এলাকায় যেই বিড়ি সবচেয়ে জনপ্রিয়, সেটাই। চা অভিযানের কোম্পানীটির নাম মনে আছে, বলবোনা কারন তারা এতে খুশি হবে না কি নারাজ হবে তা আমি নিশ্চিত নই। তবে আমি কিছুই বানিয়ে বলিনি। এখন বাংলাদেশে আমরা পাঁচ টাকা থেকে দুইশত টাকা দিয়ে এক কাপ চা খাই। সেভেন স্টার হোটেলে এখন কতো আমার জানা নেই। অনেক আগে জানতাম দেড়শত টাকা আর ফুটপাতে পাঁচ টাকা। কি বুঝলেন চা সেবী বন্ধুগণ! চা আমিও পান করি।
তরল পানীয় এখন ঢাকায় সাধারণ দোকানে ছোট এক বোতলের দাম বিশ টাকা। তারকা হোটেলে টেবিলে পরিবেশন করলে সেবা সহ বিল কত হয় আমি জানি না। নিউ ইয়র্কে তরল পানীয় এক ক্যান এক ডলার, বোতল আরেকটু বেশি, সম্ভবতঃ দেড় ডলার। তাহলে কমপক্ষে এক ডলার হলে নব্বই টাকা আর ঢাকায় বিশ টাকা। এবার এটার শুরুর দিকের কাহিনি শুনুন।
সময় আগের মতো, স্থানও গ্রামের বাজার, অবস্থানও বাজারের প্রবেশ পথে। একটা বড় গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে দুই বা তিন জন লোক বোতলে বিশেষ পদ্ধতিতে সাদা এক ধরণের পানীয় ভরছেন। তরল পদার্থগুলো বোতলে ঢুকবার সাথেসাথে কিভাবে যেনো বোতলের ভেতরে থাকা একটা মার্বেল বোতলের মুখে এসে টাইট হয়ে বসে যায় এবং তা ছিপি হিসেবে কাজ করে। সংশ্লিষ্ট লোকগুলো বলতে থাকে ক্যানভাসারের মতো:- সোডা ওয়াটার সোডা ওয়াটার, এটা খাবেন পেট ব্যথা থাকবে না, পেটের গ্যাস দূর হয়ে যাবে, সব সমস্যা সেরে যাব, খেয়ে দেখুন, পয়সা লাগবে না, খেয়ে দেখুন ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ খেতে রাজি হলে একটা শক্ত কাঠি দিয়ে মার্বেলটাকে চাপ দিলে তা ফোঁস করে বোতলের ভেতরের দিকে চলে যেতো। প্রচারণার প্রভাবে তরল পানীয় গ্রহনেও আমরা পিছিয়ে থাকিনি। তবে তরল পানীয় পয়সা দিয়ে খাওয়া কবে শুরু করেছিলো আমাদের মানুষেরা তা আমি ঠিকঠিক বলতে পারছি না। বহুদিন লাগেনি নিশ্চয়। চায়ের থেকে একটু বেশি সময় নিয়েছে হয়তো।
এবার আসুন আটা প্রসঙ্গে। আমাদের প্রাণপ্রিয় জন্মভূমিতে তখন আটা খাওয়াকে খুবই অসম্মানের চোখে দেখা হতো। যদি জানাজানি হতো যে, অমুক বাড়ির মানুষ আটার রুটি খায় তাহলে ঐ বাড়ির সাথে কেউ সম্পর্ক স্থাপনের চিন্তাও করতো না। হ্যাঁ, প্রিয় পাঠক বিস্মিত হয়ে বলবেন, বলেন কি, তাহলে আটা কি করে জাতে উঠলো? জ্বী হাঁ, অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পরইতো আটার রুটি উঠেছে আমাদের খাবার টেবিলে। কাহিনী শুনলে আপনাদের বিশ্বাস করতেই কষ্ট হবে।
ভাতের বদলে রুটি খান, চালের উপর চাপ কমান- এটা ছিলো তখন সরকারি মিডিয়ার প্রচারণা। সাথে ভাতের প্রতিক্রিয়ায় স্বাস্থ্যগত যেসব সমস্যা হয় আর আটা খেলে কি উপকার হয় তাও বর্ণনা করা হতো। যেই রাইস মিল মালিকের গম ক্রাশিং ইউনিট থাকতো তাদেরকে সরকার গম সরবরাহ করে তা ভাংগানোর জন্য টাকা দিতো আর বলা হতো জনগণকে ফ্রী আটা দাও এবং রুটি খেতে উৎসাহিত করো। এ অবস্থায়ও মানুষ সহজে এ অভ্যাসটি গ্রহণ করেনি। অনেক সময় লেগেছে। তাহলে এতো গম পেষানো আটার কি হলো, এরকম একটা প্রশ্ন আপনারা করতেই পারেন। এ কথার উত্তর শুনলেতো আপনাদের চোখ ফুটবল হয়ে যাবে। হ্যাঁ বলছি বলছি। সংশ্লিষ্ট মিল মালিক এক বস্তা আটা নিয়ে একটা লোককে তার প্রতিষ্ঠানের সামনে বন্টনের নিমিত্তে বসিয়ে দিতো। কিন্তু মানুষ আটা খেতে শুরু করেছে অনেক পরে। এবার যা বলবো তা কিন্তু ফিসফিস করে কানেকানে বলতে হবে। একটা কান আমার মুখের কাছে আনুন। যা বলবো তা কাউকে বলতে যাবেন না যেনো। আটার বস্তাগুলো রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পার হয়ে যেতো। সংশ্লিষ্ট মানুষদের অবস্থা স্বচ্ছল হতে হতে যখন বেশি স্পষ্ট হয়ে যেতো তখন তারা সমাজে একটা গল্প ছড়াতো, বলে বেড়াতো, অমুকের বউ স্বপ্নে একটি সোনার কলসী পেয়েছে। আরেক জনকে ছড়াতে শুনেছি, পুকুর ঘাঁটে হাঁড়িপাতিল ধুতে গিয়ে হঠাৎ ওনার স্ত্রীর হাতে কোত্থেকে যেনো অলৌকিক ভাবে একটা স্বর্ণের ডাল ঘুঁটনী চলে এসেছে যার দাম কল্পনারও বাইরে।
প্রিয় পাঠক, আর কি বর্ননা দিতে হবে? গল্পগুলো কি ভালো লেগেছে? যা-ই হোক, কাউকে বলে কাজ নেই, গোপন রাখুন। ওহ্যাঁ, অতিসম্প্রতি ঢাকায় দুই কেজির এক প্যাকেট আটার গায়ে দাম লেখা দেখলাম বিরানব্বই টাকা! প্রিয় পাঠক, লেখা শেষ, সময় এখন ভোর চারটা উনত্রিশ মিনিট!
লেখক: আমেরিকা প্রবাসী কবি ও ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক।