ডেভিড কপারফিল্ড স্ট্যাচু অব লিবার্টি অদৃশ্য করার ম্যাজিক দেখিয়ে পুরো পৃথিবী তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন বেশ কয়েকবছর আগে।
শুধু স্ট্যাচু অব লিবার্টিই নয়, আস্ত একটা ট্রেনের বগি উধাও করে দিয়েছিলেন ডেভিড। দেখিয়েছেন চীনের মহাপ্রাচীর ভেদ করে অপর প্রান্তে গিয়ে। খোলা স্টেজে আরেকজনকে নিয়ে পাখির মতো উড়ে অবাক করে দিয়েছিলেন দর্শকদের।
এই রকম আরো অসংখ্য অদ্ভুত সব জাদু দেখিয়ে ডেভিড খুব দ্রুতই বিশ্বখ্যাতি পেয়ে যান। ডেভিড কপারফিল্ডের খ্যাতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, একই নামে চার্লস ডিকেন্সের বিখ্যাত একটি উপন্যাস আছে এটাই অনেকে ভুলে গিয়েছেন।
নিত্য নতুন জাদু আবিষ্কারের জন্য রীতিমতো বিজ্ঞানীদের মতো নিজস্ব ল্যাবে গবেষণা করতেন ডেভিড কপারফিল্ড।
যাদুবিদ্যা আসলে চোখের ফাঁকি এ কথা সবাই জানলেও, ফ্রান্সের উপহার দেয়া আমেরিকার বিখ্যাত বিশাল স্থাপনা বেমালুম গায়েব করে দেয়ার পর এটাকে স্রেফ কৌশল হিসেবে মেলাতে কষ্ট হয়েছিল সবার।
ডেভিড কপারফিল্ডের জাদু কৌশল নিয়ে অন্য সবার মতো আমারো খুব কৌতুহল ছিল।
যদিও যাদুর কৌশল জেনে গেলে আগের বিস্ময়টা আর থাকে না।
একবার ঢাকার এমিউজমেন্ট পার্কে একটা শপে দেখলাম নানা রকম যাদু দেখানোর সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। দোকানী নানারকম জাদু দেখিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করছে। যাদুর সামগ্রী কিনলে জাদুর রহস্য শিখিয়ে দেয়া হবে এই শর্তে বিক্রি হচ্ছে।
চোখের পলকে ভোজবাজির মতো লাল ফুলের লাঠি হয়ে যাচ্ছে নীল ফুলে ভরা। আরো কতো কি।
কৌতুহল না রাখতে দাম মিটিয়ে দেয়ার পর দোকানী আড়ালে নিয়ে গেলেন। গোপন তথ্য জানানোর মতো করে নীচু গলায় কৌশল দেখিয়ে দিলেন। কৌশল জেনে নিজেই বোকা বনে গেলাম। এতো সহজ জিনিস চোখে পড়লো না!
যাদু শেখার কৌশল জানা সেবারই নতুন না।
ছোটবেলায় পরিচিত অনেকের কাছ থেকে টুকটাক মজার ট্রিক শিখেছিলাম। বেশীরভাগই বিজ্ঞানের খেলা।
এর একটি হলো, একটি ফোলানো বেলুনে সুঁই ফুটিয়ে দেয়ার পরেও বেলুনটির ফুটে যায় না।
আসলে বেলুনটি যে জায়গাটায় সুঁই ফোটানো হয়, সেখানে আগে থেকেই পরিষ্কার একটা স্কচটেপ এঁটে দেয়া থাকে। যার কারণে সুঁই ফোটানো হলেও বেলুনটির বাতাস বেরুতে পারেনা।
আর একবার ফুটপাত থেকে দশ টাকায় জাদু রহস্যের বই কিনেছিলাম। সেখান থেকেও জেনেছিলাম অনেক রকম কৌশল।
এর একটা ছিল শোয়ানো বাক্সে একজন মানুষকে ঢোকানোর পর দুভাগ করে ফেলা।
আসলে বাক্সটি আগে থেকেই দু’ভাগ করা থাকে, আর পায়ের অংশটিতে আগে একজন থাকে যেটা দর্শক দেখতে পায়না। সবাই যাকে দেখে সে মানুষটি যখন বাক্সে শুতে যায়, সে আসলে পা ভাঁজ করে প্রথম অংশটিতে শুয়ে পড়ে, অপরজন আলগোছে পা বের করে দেয় অন্য অংশটি থেকে। তারপর কিছু একটা দিয়ে বাক্স দু’ভাগ করে দর্শকদের পিলে চমকে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
বিটিভির আনন্দমেলায় জুয়েল আইচের এরকম জাদু দেখেছিলাম।
আরেকটি জাদু ছিল জুয়েল আইচের হাতে থাকা একটা ছোট পাখির খাঁচা হঠাৎই উধাও হয়ে যায়।
পরে ক্যামেরা দিয়ে স্লো মোশনে দেখানো হয় (সম্ভবত জুয়েল আইচের সম্মতিতেই), জুয়েল আইচ আসলে তার কোটের হাতার ভেতর খাঁচাটি লুকিয়ে ফেলেন। জাদুর ভাষায় যাকে বলে পামিং।
তবে জুয়েল আইচের দুয়েকটা জাদুর কৌশল জানা গেলেও বলার অপেক্ষা রাখেনা আমাদের উপমহাদেশের সেরা জাদুকরদের একজন তিনি।
আমাদের উপমহাদেশীয় আরেকজন প্রবাদপ্রতিম জাদুকর পিসি সরকার। তার একটা বিখ্যাত জাদুর কথা শুনেছিলাম। জানি না কতটুকু সত্য।
একবার পিসি সরকারের যাদুর একটা প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছে। হল ভর্তি দর্শক। নির্ধারিত সময় (ধরা যাক দুপুর দু’টো) পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পিসি সরকারের দেখা নেই।
সবাইকে অপেক্ষায় রেখে প্রায় মিনিট দশেক পর পিসি সরকার হাজির হলেন। দর্শকদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন, তার দেরী নিয়ে। পিসি সরকারের সাথে এমনটা একেবারেই যায় না।
পিসি সরকার মৃদু হেসে বললেন, কই আমিতো দেরী করিনি। বিশ্বাস না হলে নিজের ঘড়ির দিকে দেখুন।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, দর্শকরা হাত উলটে ঘড়ির কাটা আসলেই ঠিক দু’টোর ঘরে।
এর পেছনে কি কৌশল থাকতে পারে জানা নেই।
তবে সব জাদুতেই কৌশল থাকে এমনও নয়।
স্ট্রিট ম্যাজিকের জন্য বিখ্যাত ইলুশনিস্ট ডেভিড ব্লেইন।
হাতের কারসাজি বা চোখের ধুলো দিয়ে পথে ঘাটে বহু মানুষকে চমৎকৃত করেছেন।
এর একটি হলো, জীবন্ত একটি ব্যাঙ গিলে ফেলে, সবাইকে খালি মুখ দেখিয়ে কিছুক্ষণ পর ব্যঙটি মুখের ভেতর ফিরিয়ে আনেন।
এই জাদুটির মধ্যে আসলে চোখের ফাঁকি দেয়ার কোন কৌশল নেই। দীর্ঘ প্রায় ছয় মাসের চেষ্টায় ডেভিড ব্লেইন সত্যি সত্যি একটি জীবন্ত ব্যঙ গিলে ফেলে কিছুক্ষণ পেটের ভেতর রেখে কসরৎ করে সেটিকে আবার ফিরিয়ে আনতে পারেন।
ডিশ এন্টেনার যুগে একশন টিভিতে “Magic Secrets Revealed” নামে একটি শো জনপ্রিয় ছিল।
অনেক বিখ্যাত জাদুর কৌশল ধুমধাম প্রকাশ করে দিয়ে কালো মুখোশ পরা রহস্যময় উপস্থাপক জগতের সকল জাদুকরদের একেবারে পথে বসিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।
তার প্রকাশ করা কৌশলগুলো দেখতে দেখতে এমন অবস্থা হয়েছিল, পরে নতুন কোন জাদু দেখানোর পর তার কৌশল দেখানোর আগেই ধরে ফেলতে পারতাম কোথায় ফাঁকিটা হতে পারে।
এর পর ইন্টারনেটের কল্যাণে প্রায় সব জাদুই রহস্যের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে।
বাদ পড়েনি বেচারা ডেভিড কপারফিল্ডের জাদুও।
স্ট্যাচু অব লিবার্টি নিয়ে প্রদর্শনীটি হচ্ছিল একটি হল ঘরে, যেখান থেকে দর্শকরা জানলা দিয়ে স্থাপনাটি দেখতে পাচ্ছিলেন।
একটা সময় বড় একটা পর্দা দিয়ে মূর্তিটি দেখার পথ আটকে দেয়া হয়। বাজতে থাকে নাটকীয় মিউজিক। কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে সরিয়ে ফেলা হয় বড় পর্দাটি।
এরপর আর কি! পৃথিবীর সবচাইতে বিখ্যাত একটি স্থাপনা স্ট্যাচু অব লিবার্টি বেমালুম গায়েব!
দর্শকরা দেখতে পেলেন যে জায়গাটায় স্থাপনাটি ছিল, সেই জায়গাটা শূন্য এটা নিশ্চিত করতে হেলিকপ্টার দিয়ে সার্চ লাইচ ফেলা হচ্ছে একপাশ থেকে। রাতের অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে সে রশ্মি এপাশ থেকে অপাশে চলে যাচ্ছে কোনরকম বাঁধা ছাড়াই।
আবার আগের মতো পর্দা টানানো হলো স্ট্যাচু অব লিবার্টির দৃশ্যপথে। কিছুক্ষণ পর পর্দা নামানোর পর দেখা গেল স্ট্যাচু অব লিবার্টি আগের জায়গাতেই আছে।
দর্শকদের মুহুর্মুহু তালি। তৈরী হলো জাদুর জগতে নতুন ইতিহাস।
এবার জাদুটির রহস্য জানা যাক।
যে হলঘরটিতে জাদুটি দেখানো হচ্ছিল, সেটা আসলে রিভলভিং চেয়ারের মতো ঘুরানোর ব্যবস্থা ছিল। যখন পর্দা দিয়ে স্ট্যাচু অব লিবার্টির দৃশ্যপথ আটকানো হয়েছিল, তখন যান্ত্রিকভাবে খুব আস্তে হলঘরটি অন্যদিকে ঘুরিয়ে আনা হয়, যেখান থেকে স্ট্যাচু অব লিবার্টি চোখে পড়বে না।
উঁচু ভলিউমের মিউজিক, আর ডেভিডের কথার তালে তালে দর্শকরা টেরও পাননি কখন পুরো হল ঘরটি ঘুরে যাচ্ছে অন্যদিকে।
সত্যি বলতে কি জাদুর কৌশল জানার পরও আমার কাছে পৃথিবীর সেরা জাদুগুলোর একটি মনে হয়েছে।
কোন জাদুর ট্রিক জানা বা আন্দাজ করা গেলেও জাদুটি উপভোগ্য হয় তার পরিবেশনা ও নাটকীয়তার কারণে।
পুরো সময়টাতে ডেভিড কপারফিল্ড দর্শকদের কথা বলে যেভাবে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন, শুধু এর ভিত্তিতেই ডেভিড কপারফিল্ডকে পৃথিবীর সেরা পারফর্মিং আর্টিস্টদের একজন বলা যায়।
৪ Comments
ভালোবাসার মানুষ গুলো বেঁচে থাকুক হাজার বছর
Congratulations.Go ahead.
thanks
great website thank you for elaborating ?