আমি মানুষ নই; আমি তো শ্রমিক
সেলিনা হোসেন
আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ির দিকের এক ধনী আত্মীয় অভিজাত এলাকায় একটা পাচতলা বাড়ি করছে।
সব অত্যাধুনিক ফিটিংস ; মার্বেল পাথরের টাইলস ; ইত্যাদি মিলিয়ে খুব এলাহি আয়োজন।
এলাকা টা আমার খুব খুব প্রিয় ও চেনা। আমার নানাবাড়ি র এলাকা । যদিও নানাবাড়ির অস্তিত্ব নেই। মামা নেই। নানা নানী কেউ বেঁচে নেই। মা খালারা তিনবোন মারা,গেছেন। শুধু ছোট খালা বেঁচে আছেন।
আমাদের শৈশব কেটেছে ওই এলাকায়। অনেক স্মৃতি বিজড়িত এলাকা। আমাদের খেলার মাঠগুলো আজ প্লটের পর প্লেট। বড় বড় বিল্ডিং। স্কুল ; সরকারি হসপিটাল ; পার্ক কতকিছু!!!!
আমার সেই আত্মীয় আমাকে বড়ভাবি হিসেবে খুবই সমীহ করে। বাড়ির কাজ শুরু র আগে আমাকে দেখাতে নিয়ে যায়।
আমি অবাক বিস্ময়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখছি। প্রায় তিন যুগ পরে আমার শৈশবের সেই ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রাম খানি তে এত আমুল পরিবর্তন!!!
সেই দাড়িয়াবান্ধা খেলার মাঠ ; সেই ডোবা ; সেই বিল কোথায় গেল!!! মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে বড় বড় প্রাসাদ!!!
আমার খেলার সাথি রা কোথায় গেছে সবাই? ভাবতে লাগলাম। জায়গা জমি বেচে দিয়ে চলে গেছে? বিয়ে হয়ে গেছে? এরকম ভাবনার মাঝে হঠাৎ করে ই দেখলাম মিঠু কে!! পাশে ই তো ওদের বাড়ি ছিল!! শানবাঁধানো ঘাটের পুকুর ছিল ; শিউলি ফুলে সাদা হয়ে থাকত পুকুরের সিঁড়ি গুলো। কত শিউলি ফুল কুড়িয়েছি!!!
মিঠু সামনে এসে সালাম দিল। পরিচয় করিয়ে দিলাম আমার শৈশবের সহপাঠী বন্ধু ; খেলার সাথি মিঠু কে আমার শ্বশুর বাড়ি র দিকের ধনী আত্মীয় দের সঙ্গে।
মিঠু বলল আমার ইলেক্ট্রিক দোকান সামনে। আমার বাড়ি পিছনে। এখানে বেশির ভাগ বিল্ডিং এর ইলেক্ট্রিক কাজ আমি করি।
মিঠু আমাকে অনুরোধ করেছিল আমার আত্মীয় র বাড়ির কাজটা দিতে। আমি ও তাদের বললাম। ওরা ও আপত্তি করেনি। আমার কথা রাখল। ওদের বাড়ির কাজ টা মিঠু কে দিল।
এইবার একটু পেছনে ফিরে তাকাই। আশির দশকের শুরু র দিকে আমি প্রাইমারী স্কুলে পড়ি। গ্রামের ছেলে মেয়ে রা ঝাঁকবেধে স্কুলে যাই। একসাথে আবার বাসায় ফিরি। বিকেলে মাঠে খেলি। কত রকমের খেলা। দৌড় ঝাপ ; লুকোচুরি। এ মাঠ থেকে ওমাঠে। এখনকার জীবনের সাথে সেই জীবনের কোন তুলনা হবে না।
আমি মিঠু বুলবুলি মুন্জিলা সবাই একই পাড়ায় থাকতাম। মিঠুদের বাড়ি আমাদের বাড়ি এক ওয়ালের পাশে লাগোয়া। মিঠু র আম্মা কে আমরা খালা বলতাম। ওরা ভাইবোন রা ও আমার আম্মা কে খালা বলত। দুই মায়ের মধ্যে ও কঠিন বন্ধুত্ব ছিল। একটা গল্পের বই দুই মা ভাগে জোগে পড়তেন সংসারের কাজকর্ম সেরে। ছাদে বসে পানচুন খেতেন।
চমৎকার একটা পরিবেশ ছিল। খুব সুন্দর দিন কাটত। আমার আব্বা চাকরি করতেন। মিঠুর আব্বা ব্যবসা করতেন। দুই পরিবারের মধ্যে সীমাহীন সখ্য তা।
কিন্তু মানুষের জীবনে উত্থান পতন প্রতিকূলতা থাকবে। মিঠু র আব্বা ব্যবসার কাজে প্রায়ই বাইরে যেতেন। বাড়িতে থাকতেন না।
একদিন ওদের বাড়ি থেকে কান্না র আওয়াজ পেয়ে ছুটে গেলাম। খালা আম্মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছে আমার সব কিছু শেষ হয়ে গেল বু।।
আমরা ছোট। সংসারের জটিলতা বুঝি না। কোন কিছু ই না বুঝে ওদের অশ্রু সজল চোখ মুখ দেখে কান্না করলাম। এটুকু বুঝতে পারলাম ওদের পরিবারের এখন ঘোর বিপদ।
পরে জেনেছিলাম ওর বাবা বিয়ে করে নাকি ঢাকায় চলে গেছে। আর ফিরে আসবে না।।
মিঠুর মামা খালারা বেশ সম্পদশালী ছিল। মিঠু র নানার অনেক জমি জমা। মিঠুদের বাড়ি টা ওর নানা ওর মা কে দিয়েছে।
আমরা ও মিঠু দের বাড়িতে খাদ্য খাবার ফলমুল যা খাইতাম দিয়ে আসতাম। ওর নানা বাড়ি থেকে বড় সাপোর্ট পেত। এভাবে কষ্টে সৃষ্টে ওদের দিন কাটতে লাগলো। মিঠু র বড়ভাই ক্লাস সেভেনে পড়ে। মিঠু ক্লাস ফাইভে। ছোট বোন দুটো ওয়ান টু তে।
কালের বিবর্তনে আমরা ও চলে আসলাম অন্য বাড়িতে। হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। জীবন বয়ে চলল জীবনের মত। প্রথম দিকে কয়েক বছর মিঠু সাইকেল নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসত। আমাদের আর যাওয়া হয়ে ওঠে নি। এভাবে কেটে গেলে অনেক গুলো বছর। তারপর বিয়ে হয়ে তো আমি শ্বশুর বাড়ি।
মিঠু প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মিঠু র বড় ভাই একটু মুখচোরা ও নির্লিপ্ত স্বভাবের। কিন্তু আমার বন্ধু মিঠু ছোট বেলা থেকে ই খুব কর্মঠ ; বুঝদার ও ত্যাগি। মিঠু ওর মা কে প্রানের চেয়ে বেশি ভালবাসে। ভাই বোন কে ও ভালবাসে। মায়ের সঙ্গে সংসারের হাল ধরল মিঠু।
বাজার করা ; এখানে ওখানে যাওয়া ; ঘরভাড়া দেওয়া সব কিছু ই করত। লেখা পড়া করার সামর্থ্য ও তেমন ছিল না। মিঠু র লেখা পড়া র সময় বা আগ্রহ ও ছিল না। কোন রকমে কারিগরি থেকে ডিপ্লোমা করে কাজে লেগে গেল মিঠু। ছোট বোনদের লেখা পড়া শিখিয়ে বিয়ে দিল।
বন্ধু দের মধ্যে বেশ লেট করে ই বিয়ে করল মিঠু। তারপর সেই সংসারের জোয়াল টানতে কাতারে ও শ্রমিক এর কাজ করে আসল দুটো বছর।
সংসারের খরচ ; মায়ের চিকিৎসা র খরচ ; পুরনো দেনা শোধ করতে করতে মিঠুর নাভিশ্বাস দশা।
দেশে ফিরে আবার ব্যবসা করবে। দোকান করবে। কিন্তু টাকা পাবে কোথায়? প্রবাসী কল্যান ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল মিঠু। কিন্তু এখানে দুইজন জামিনদার লাগবে। মিঠু র বন্ধু আব্দুল্লাহ ও ব্যবসা করে। ও বলল তুই দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ১ লাখ টাকা আমাকে দিস। ১ তুই নিস। আমরা একসাথে কিস্তি দিব।
কিন্তু সরকারি চাকরি করে এমন জামিনদার লাগবে ব্যাংকে। মিঠু পেশায় একজন শ্রমিক। পরিচিত দের কাছে গেলে যদি ফিরিয়ে দেয় লজ্জা পাবে। সেই আতংকে কারও কাছে যায় নি।
অনেক আশা,ভরসা স্বপ্ন নিয়ে আমার কাছে আসল সাহায্যে র জন্য। অনেক অনেক দিন পর আমার ই শৈশবের খেলার সাথি যার সাথে মাছ ধরা আম কুড়ানো ; কলার ভেলা ভাসানো দুরন্ত শৈশব কেটেছে তার এহেন বিপদে জামিনদার হব না এমন নিষ্ঠুর তো আমি নই। যথারীতি ব্যাংকে গিয়ে সই স্বাক্ষর দিলাম।
ঋণ নেয়ার পর পর ই দেশে কোভিড এল। লকডাউন। কাজ বন্ধ। কিস্তি দুই একটা দেয়ার পর করোনায় মারা গেল মিঠু তথা আমার ও সহপাঠী আব্দুল্লাহ। ওর দুটো ছোট্ট শিশু। ওরা এতিম হয়ে গেল। মানবিক মিঠু আব্দুল্লাহ র কিস্তি র দায় ও নিল। কি করবে??? ঋণ তো তার নামে। আব্দুল্লাহর বাচ্চা রা ছোট। বৌ গৃহিণী।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!!! মিঠু সংসার চালাতে হিমশিম। কিস্তি ও দিতে পারছে না। ব্যবসা বানিজ্য কাজকর্ম বন্ধ।
এদিকে আমার সেই ধনী আত্মীয় র বাড়ি কাজ করে। লাখ টাকা র ফিটিংস। কাজ চায় একের কিন্তু পেমেন্ট দিতে গড়িমসি!!! গত ৪ বছর ধরে কাজ করছে টুকটুক করে। বিল দেয়ার সময় কড়ায় ক্রান্তি হিসাব।
আমাকে আমার আত্মীয় ফোনে বলল ভাবি আপনার বন্ধু কে একটু কম নিতে বলবেন টাকা পয়সা। বাড়ি করতে গিয়ে ফকির হয়ে যাচ্ছি!!!
আমি বললাম আচ্ছা ঠিক আছে।
মিঠু কে বললাম আমার আত্মীয় তোকে একটু কম টাকা নিতে বলেছে।
মিঠু কাষ্ঠ হেসে বলল আচ্ছা ঠিক আছে। তারপর বলল
চার বছর আগে তোর আত্মীয় আমার সাথে যে চুক্তি করেছে সেই অনুপাতে টাকা দিতে চায়।
তোর সম্মান ইজ্জত এর খাতিরে আমি তাই ই নিব যা তারা খুশি হয়ে দেয়। চার বছর আগে চাল কিনেছি ৪০ টাকা কেজি।এখন কিনি ৬৫ টাকা। চিনির কেজি ১৫০ টাকা। আলু পেয়াজের কথা নাই বা বললাম!!!
আমরা কি মানুষ ; বল??? আমরা তো শ্রমিক।।
আমার বন্ধু মিঠু র এই কথা আমার কানে বাজল অনেকক্ষণ। অন্তরে গিয়ে লাগল।
শৈশব কৈশোর বয়সে জীবন সংগ্রাম করা মানবিক বন্ধু টি আমার আজ ও সংগ্রাম করে চলছে। নির্দিষ্ট টাইমে বেতন নাই ; ভাতা নাই ; আগের রেটে মুজুরি নিয়ে ও কড়াকড়ি হিসাব কষে কোটি কোটি টাকা দিয়ে প্রাসাদ গড়া মানুষেরা।।
তাদের কাছে মিঠু আজ মানুষ নয় ; শুধুই শ্রমিক!