আলাউদ্দিন আলী’র প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী
কর্ম মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। কর্ম মানুষকে পরিণত করে কিংবদন্তীতে। তেমনই কিংবদন্তী বাংলাদেশের সংগীতের অঘোষিত মহারাজ আলাউদ্দিন আলী।
করোনাভাইরাসের এই মহামারীকালের এক বিষণ্ণ বিকেলে তিনি হাত ছেড়েছেন পৃথিবীর। কিন্তু রেখে গেছেন তার সৃষ্টিকর্ম যা যুগ যুগ ধরে বাংলা গানের ভিত্তিকে শক্ত করে যাবে। কণ্ঠে কণ্ঠে ছড়িয়ে যাবে তার সুরের যাদু!
আলাউদ্দিন আলীকে নিয়ে একদিনে বা একটি প্রবন্ধে লেখা শেষ করার মত নয়। তবুও পাঠকের জন্য আরাফাত শান্ত লিখেছেন আলাউদ্দিন আলীকে নিয়ে- তার জীবনের গল্প নিয়ে।
ধীরে ধীরে নিয়তির নির্মমতায় চলে যাচ্ছে সবাই। এ যাত্রায় সামিল বাংলাদেশের গানের কিংবদন্তি সুরকার ও সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী। তিনি ২০১৫ সালের দিকে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে ছিলেন, ব্যাংকক থেকে ফিরেও এসেছিলন সুস্থ হয়ে। কিন্তু এবার আর সুস্থ হওয়া হলো না। চলে গেলেন তিনি অকালেই। তাঁর মতো মানুষের জন্য ৬৮ বছর কিছুই না। এরকম প্রতিভাবান মানুষের কম করে হলেও শতবর্ষ আয়ু থাকা উচিত। একজন আলাউদ্দিন আলী আর কখনোই এই দেশে জন্ম নিবে না।
আলাউদ্দিন আলীকে আমরা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ ভাবছি? কেন উনার চলে যাওয়া মস্ত ক্ষতি? সেই ব্যাপারটাই আগে বলি। আলাউদ্দিন আলী বাংলাদেশে মাষ্টার ক্লাস সংগীত পরিচালক। যিনি যন্ত্রের মত মেলোডি তৈরী করতে পারতেন। আলাউদ্দিন আলী মানেই পরম্পরা। তিনি বিখ্যাত আলতাফ মাহমুদ ও আনোয়ার পারভেজের সহকারী ছিলেন।
অবাঙালী মিউজিশিয়ানরা স্বাধীনতার পর চলে গেলে তিনি এমন কোনো যন্ত্র নাই যেটা না বাজিয়েছেন। তার উপকার পেয়েছে পুরো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি।
প্রায় তিনশত সিনেমায় তিনি সংগীত পরিচালনার কাজ করেছেন। ক্যাসেটের জন্য রাত দিন কাজ করেছেন। এক হিসাবে তার সুর করা গানের সংখ্যা ৫০০০ এর উপর।
যখন প্রফেশনাল সুর করা ছেড়েছেন তখনও তিনি কপিরাইট ও রয়েলিটি নিয়ে সোচ্চার, প্রতিষ্ঠান করেছেন, বিটিআরসির সাথে দেন-দরবারে হাজির হয়েছেন। এরকম প্রতিভা ও কর্মস্পৃহা উপমহাদেশে বিরল।
আলাউদ্দিন আলীর জন্ম সংগীত পরিবারেই। তার বাবা ও কাকা দুজনেই ওস্তাদ। তার কাকা ওস্তাদ সাদেক আলী একটা বেহালা কিনে দেন ছোটবেলায়। তার বোন সেই আমলের একমাত্র মহিলা সেতার বাদক। বিখ্যাত সুরকার আলী আকবর রুপুর মা। তিনি শিখেছেন সব কিছুই। এসরাজ, পিয়ানো, তবলা অল্প অল্প সবই পারতেন। বিভিন্ন সিনেমার সংগীতায়োজনে বেহালা বাজাতেন।
আলতাফ মাহমুদের সাথে কাজ করতেন, সত্তরের নির্বাচনের প্রচারেও ব্যাপক অংশগ্রহণ করেন। এক বাঙালী সুরকার তাকে ধরিয়ে দেন। পাকিস্তানি আর্মি এসে সব মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্ট ভেঙ্গে ফেলে। তার ভাইদের ধরে নিয়ে যায়।
দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি তার বন্ধুর জন্য সুর করেন দেশের গান, ‘ও আমার বাংলা মা তোর’! পরে এটা সাবিনা ইয়াসমিনকে দিয়েও গাওয়ান। টিভিতে কাজ করতেন তখন।
জাফর ইকবালকে গান গাওয়ানো পুরোটাই উনার অবদান। নায়ক জাফর ইকবালের সব গানের সুরকার ও সংগীত পরিচালক তিনি। ‘সন্ধিক্ষণ’ সিনেমা দিয়ে তাঁর কাজ শুরু। পরিচালক আমজাদ হোসেন তাকে আসল ব্রেক দেন। ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’ দিয়ে তাঁর তারকা জীবনের শুরু। ‘ফকির মজনু শাহ’ ছবির কাজ পেয়ে যান। তারপর আলাউদ্দিন আলী মানেই হিট মেশিন। এন্ড্রুকিশোর, আবদুল হাদী, রুনা লায়লা, শাহনাজ রহমাতুল্লাহ, সাবিনা ইয়াসমিনদের দম ফেলার সুযোগ দিতেন না। খালি কাজ আর কাজ। সত্য সাহা, সুবল দাশ, খান আতা, আলম খান এদের মত রথী মহারথীদের ভীড়ে তিনিও হয়ে যান সবার চেনা পরিচিত নাম।
একাশি বিরাশি সাল হবে। মিতালী মুখার্জি ঢাকায় আসেন, বিটিভিতে মুসা আহমেদ নামে একটা প্রযোজক আলাউদ্দিন আলীকে কাজ দেন মিতালীদিকে দিয়ে গান করাতে, বিটিভির জন্য। মিতালী আলাউদ্দিন আলীকে পেয়েই নাকি বলেন, ‘আলাউদ্দিন ভাই আমাকে সাবিনা ইয়াসমিনের, কেউ কোনোদিন আমারে তো কথা দিলো না টাইপের গান দেন।’ এত অসাধারণ গান আমি আগে শুনি নি। আলাউদ্দিন আলী রাতে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে নিজেই কথা দিয়ে সুর করে মিতালী মুখার্জীর সব চেয়ে জনপ্রিয় ও প্রশংসিত গান, ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই’ বানিয়ে ফেলেন। অবাক হয়ে ভাবতে পারেন আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে একজন গান কম লেখা সিনেমার সুরকার লিখেছেন, আমার দুঃখের কথা কইতে গেলে এই দুনিয়ার সবাই বলে শোনার সময় নাই।
প্রখ্যাত গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেছিলেন, আলাউদ্দিন আলী এত এত ভালো গান সুর করেছেন, নাম বলতে গেলেই কিছুদিন হারিয়ে যাবে। বাংলা চলচ্চিত্রের গান বলতেই একটা সময় উনি।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পেয়েছেন সংগীত পরিচালক হিসাবে একাধিকবার। পেয়েছেন গীতিকার হয়ে। তার ভাষায় বলতে গেল, ‘আশাজী লতাজী ছাড়া এমন কেউ শিল্পী নেই এ উপমহাদেশে যে আমার গান গায় নি।’
একবার অর্থনৈতিক সংকটে তিনি বোম্বে কলকাতা আর ঢাকায় এক সাথে কাজ করেছেন। কলকাতার ৩০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সলীল চৌধুরী, আশা ভোঁসলের মত মানুষদের সাথে তাঁকে বাংলা গানে অবদানের জন্য সম্মাননা জানানো হয়। এসব তো প্রাতিষ্ঠানিক, আসলে তো তিনি পেয়েছেন এ বাংলার মানুষের ভালোবাসা। তাইতো মুর্শিদাবাদ থেকে অমলেন্দু নামে এক লোকের কমেন্ট দেখি ইউটিউবে ‘সুন্দরী’ ছবির গানে, ‘এরকম সুর আলাউদ্দিন আলী ছাড়া কেউ পারবে না।’
যে কর্ম কিংবদন্তীর বর্ম দিয়ে সুরক্ষিত – তাকে ভোলা অসম্ভব। একারণেই আড্ডায় এখনও তরুণরা গায়, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর’ কিংবা ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী’। অবসাদে গেয়ে উঠে মন, ‘চোখের নজর এমনি কইরা’ কিংবা ‘হারানো দিনের মতো’। কণ্ঠশিল্পীদের অসম্ভব প্রিয় ছিলেন তিনি।
ছিলেন আড্ডাবাজ, ভোজনরসিক, পরোপকারী এক মানুষ। কত শিল্পী আয় রোজগার করেছে শুধু তার গান করেই। তিনি অতুলনীয়। বাংলাদেশের গানে তিনি বারবার ফিরে আসবেন।
আলাউদ্দীন আলী বাংলা গান, বিশেষ করে বাংলা চলচ্চিত্রে অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান তৈরি করেছেন। তিনি একই সঙ্গে সুরকার, সংগীত পরিচালক, বেহালাবাদক ও গীতিকার। গান লিখে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন। গুণী এই মানুষের জন্ম ১৯৫২ সালের ২৪ ডিসেম্বর মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বাঁশবাড়ি গ্রামে। তাঁর বাবা ওস্তাদ জাদব আলী। মায়ের নাম জোহরা খাতুন।
দেড় বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে ঢাকার মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে চলে আসেন আলাউদ্দীন আলী। তিন ভাই ও দুই বোনের সঙ্গে সেই কলোনিতেই বড় হন এই গুণী শিল্পী। সংগীতে প্রথম হাতেখড়ি ছোট চাচা সাদেক আলীর কাছে। পরে ১৯৬৮ সালে বাদ্যযন্ত্রশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রজগতে পা রাখেন। শুরুটা শহীদ আলতাফ মাহমুদের সহযোগী হিসেবে, পরে প্রখ্যাত সুরকার আনোয়ার পারভেজের সঙ্গে কাজ করেন দীর্ঘদিন।
লোকজ ও ধ্রুপদি গানের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা আলাউদ্দীন আলীর সুরের নিজস্ব ধরন বাংলা সংগীতে এক আলাদা ঢং হয়ে উঠেছে প্রায় চার দশক ধরে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বহু স্বনামধন্য শিল্পী তাঁর সুরে গান করে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর সুরারোপিত গানের মধ্যে ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসত’, ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’, ‘ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়’, ‘দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয়’, ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই’, ‘সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি ও আমার বাংলাদেশ’, ‘এমনও তো প্রেম হয়, চোখের জলে কথা কয়’, ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’, ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান রয়েছে।
তিনি ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ (১৯৭৯), ‘সুন্দরী’ (১৯৮০), ‘কসাই’ এবং ‘যোগাযোগ’ চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৮৮ সালে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি খ্যাতিমান পরিচালক গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন।