‘মা-হারা দিবসে’ অজানা গল্পের ঝাপি,
‘মন্তব্য সাহিত্য প্রতিযোগিতা’য় জিতুন অভিনব পুরস্কার। সালেম সুলেরী
মা মতিনা সোলায়মান-এর প্রয়াণ ৬ জানুয়ারি ১৯৯৮। ঢাকা মেডিকেলে বিকেলে ক্যান্সারে মা-জননীর জীবনাবসান। মৃত্যু-সংবাদ পেলেও সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে পারিনি। কারণ তখন নিউইয়র্কে’র ঠিকানা’র ‘লিড নিউজ’ লিখছি। হাতের কাজ শেষ করতে দেড় ঘন্টা, অতঃপর দৌড়-ঝাপ। ঢাকায় তখন হাড়-কাঁপানো প্রচন্ড শীত। সন্ধ্যায় শান্তিনগরে ‘প্রোপার্টি এস্টেটে’ প্রথম জানাজা হয়। সেটি আমার তৎকালীন অ্যাপার্টমেন্টের প্রাঙ্গন। ফুপাতো বোন কন্ঠশিল্পী ফেরদৌসী আপাসহ অনেক নিকটজন। তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি ফজলুল হক। প্রেসিডেন্টের সাবেক সচিব, এটিএন-টিভি’র উপদেষ্টা কবি সাইফুল বারী… ।
রাতে সড়কপথে পৈতৃকবাস ডোমারের পথে আমাদের অভিযাত্রা। বৃহত্তর রংপুরের নীলফামারীর ডোমার যাবে লাশ। কিন্তু না, প্রায় পাঁচ কিলোমিটার সুদীর্ঘ ট্রাফিক জট। লাশ নাকি আবার সড়কেই গলে-পচে যায়! এরমধ্যে কনিষ্ঠ-সহোদর প্রকৌশলী স্বাধীনের হারিয়ে যাওয়া! অতঃপর কমলাপুর রেল স্টেশনে শেষ ট্রেন ধরা। সেখানেও ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ ছাড়া ওঠানো যাচ্ছিলো না। প্রায় ১৫ মিনিট অপেক্ষা করেছিলো পুরো ট্রেনটি। ঘটনাগুলো এমন যে একটি দীর্ঘ রচনা লেখা সম্ভব। শিরোনাম হবে >> ‘এ মিরাক্যল জার্নি উইথ ডেডবডি!’
অত্যন্ত মেধাবী, ধর্মপ্রাণ, প্রগতিশীল ছিলেন মা-জননী। ছোটবেলায় অনেককিছু শিখিয়েছেন যা সারাজীবন কাজে লাগলো। ঘর-গোছানো, রান্না-নামাজ-কোরান, কবিতা-গান-নৃত্য। ক্লাশে প্রথম হওয়া, পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ। সুন্দর হস্তাক্ষর, সাঁতার-ব্যায়াম, হাডুডু, ফুটবল-ব্যাডমিন্টন। ধানক্ষেত পাহারায় রাত্রিযাপন, নিজেই গরুগাড়ি চালিয়ে শস্য-আনয়ন। সাঁতার শিখে বিলে মাছও মারতে হয়েছে। পারিবারিক ব্যবসা দেখতে দোকানে-হাটেও মা পাঠাতেন। যুদ্ধবর্ষে ভারতের শরণার্থী জীবনে মা’য়ের অসাধারণ অভিভাবকত্ব। শেষসময়ে গ্রামে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে সেকি অবদান…। সৈয়দপুর সেনানিবাস আক্রমণকালে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে সহায়তা। সোয়া লাখ শুকনো রুটি, সেমাই, ভাজি। আমরা কিশোরেরা বাসাতেই বানাই প্রায় ১০ হাজার রুটি। এতো চমৎকার গোল হতো যা ছিলো প্রশংশনীয়।
আম্মার ‘৬ কৌটা’র কাহিনি দিয়ে গল্প লিখেছিলাম। ৬ স্তরের অতিথিদের আপ্যায়নে ৬ রকমের খাবার! ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতায় ‘বঙ্গবন্ধু’ সাজিয়েছিলেন। ব্যাকব্রাশ আর মুখে পাইপ নিয়ে তর্জনী উঁচানো ভঙ্গি। পাশে ইন্দিরা গান্ধী না থাকায় সেবার দ্বিতীয় হলাম। এতো গল্প যে ‘এক বই মা-জননী’ লিখতে হবে। মরণব্যাধি ক্যান্সারে ভুগেছেন মধ্যবয়েসের জীবন-সায়াহ্নে। ভারতের মুম্বাই পর্যন্ত গিয়েছিলাম মাকে নিয়ে। আব্বা, সহোদর-সহোদরা, মামা-চাচা, বৌমারা অনেক করেছেন। ১৯৯১-এ কেনা সুপ্রিয় মাইক্রোবাসটি বিক্রি করে দিলাম। কিন্তু ৬ ছেলে ২ মেয়ের মাতৃদেহটি অকালেই ঝরে গেলো। এরপর আব্বা গেলেন টানা ২৩ বছর পর। এইতো ২০২১-এর ১১অক্টোবর, মায়ের পাশেই সমাধিস্থ।
আমার মা বিষয়ক হৃদ-ঋদ্ধ কবিতা অনেক। একটি এখানে পরিবেশিত হলো। পৃথিবীর সব মায়েদের করকমলেই তা নিবেদিত। ‘মন্তব্য সাহিত্য প্রতিযোগিতা’ হচ্ছে সাতক্ষিরা থেকে। আমার ‘ফেসবুক সমগ্র’ দিয়ে শুভসূচনা হচ্ছে। প্রায় ৩০ জন মন্তব্যকারী পুরস্কৃত হচ্ছেন তাতে। পুরস্কার হিসেবে থাকছে ‘সুন্দরবন ভ্রমণ’ও। আমি বলেছি ‘মা বিষয়ক মন্তব্যগুলিকেও যুক্ত করতে। অতএব, যা মনে আসে লিখুন– কথা / কবিতা বিষয়ে।
স্বর্গবাসী হোক আমার-আপনার সবার পরপারবাসী মাতৃবৃন্দ। যাঁরা বেঁচে আছেন তাদের জন্যেও সর্বোচ্চ শুভকামনা
আ-সমুদ্র হিমাচল, মা-সমুদ্র আমাদের
সালেম সুলেরী
আমিও রন্ধন জানি, মা’কে খাওয়াবো বলে।
মা’য়ের বিমুগ্ধ দুগ্ধতার সম বিশুদ্ধতা নেই,
বাইরে বাজারকেনা প্রচার-প্রহেলিকার পণ্য নয়,
সুমুদ্রিত সুচিত্রিত কোন ভিউকার্ড নয়,
আমার স্বহস্তে লেখা শ্রদ্ধা ভালোবাসা
মায়ের প্রাণের প্রিয়,
হাতের লেখাকে তাই চোখ কাড়ানিয়া, সুস্পষ্ট করেছি।
আমিও বাগান করি,
হয়তো সন্তান-গৃহী-পরিজন পরিতুষ্ট হয়।
সুমিষ্ঠ ফলের স্বাদ, আমি জানি-
প্রথমত মায়ের জিহ্বা’র পাতে তুলে দিতে চাই।
সেই চিরস্মৃতিদিন : ইশকুল যাত্রায় প্রতিদিন
গরম ভাতের ঋণ, প্রজাত ডিমের পোজ,
আদৃত টিফিনবক্স, কপোল-চুমুতে মাতৃকলা।
আমিও মৎস্যশিকারী, দুগ্ধ খামারী! গীতল কবিতা পড়ি।
ছন্দের কবিতা বেশি। মায়ের কোলেই শেখা
ঘুম পাড়ানোর, ধ্যান ভাঙানোর, জীবনকে জাগানোর…।
প্রতিদান কিছুই নেবে না, তবুও প্রতিশ্রুত আমি,
পরিশুদ্ধতার বদলে মায়ের করকমলে রাখতে চাই
বিশুদ্ধতার প্রামাণ্য পরিষেবা।
আ-সমুদ্র হিমাচল, মা-সমুদ্র আমাদের।
নদীজ সন্তান, আগলে রাখার আয়োজন নিয়ে
মায়েরাই প্রথম স্বর্গবাসী হতে চায়!
হয়তো পালায় আর সাজায় সংসার এপার ওপার।
আমি ধরতে পারি না তাই পড়তে শিখেছি
প্রার্থনার প্রাত্যহিক পাঠ।
অসীমের সঙ্গে সমঝোতা, আত্মার প্রশান্তি চাই…
সেজদা-সুযোগ নেই, তবে পদধূলি নিতে
কোমরকে সুঠাম রেখেছি, কফিন বহনে পোক্ত
যদিও বা আজীবন মায়ের উঠোন চাই,
উভতলে চাই মাতৃ-মহানের আশির্বাদাকাশ!
ওপরে আকাশ, বাবা মহা-বাবা আর নিচে
আ-সমুদ্র হিমাচল, মা-সমুদ্র আমাদের।
♦অক্ষরবৃত্ত, নিউইয়র্ক, ২০১৭ {প্রথম প্রকাশ পশ্চিমবঙ্গের নামখানা থেকে। বরেন্দ্রকৃষ্ণ বড়ুয়া সম্পাদিত ‘সমুদ্র জানালা’ লিটলম্যাগে)
#salemsuleri.ss@gmail.com