কেরোসিনের আলো
–সেলিনা রহমান শেলী
রাকা ছোট ভাইয়ের প্লেটের দিকে তাকাচ্ছে একবার আর একবার মায়ের মুখের দিকে। ছোট ভাইয়ের প্লেটের ভাত শেষ হয়ে এসেছে। আর বড়জোর এক বা ২ লোকমা হবে। কিন্তু সে ভাতটা না খেয়ে প্লেটেই নাড়াচাড়া করছে। রাকা খুব বুঝতে পারছে ছোটভাইয়ের পেট ভরে নাই। সে আরও একটু ভাত নেবার অাশায় বসে আছে। কিন্তু সাহস করে বলতে পারছে না মা কে। রাকা ছোট্ট কেরোসিনের বাতির আলোয়, মায়ের মুখটা দেখার চেষ্টা করলো। মায়ের মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ফর্সা মুখটায় অযত্নে রোদের প্রলেপ পড়ে গেছে স্থায়ী ভাবে।মায়ের দৃষ্টি বড় ভাইয়ের দিকে। একদৃষ্টিতে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন। যেকোন মূহুর্তে ঝাপিয়ে পড়বেন তার বড় ছেলে বল্টুর ওপর। বল্টু থোরাই কেয়ার ভঙ্গিতে মুখের মধ্যে ভাতের বড় বড় লোকমা পুড়ে দিতে ব্যস্ত। মায়ের রাগ, মায়ের শাসন উপেক্ষা করার সাহস একমাত্র ওরই আছে। বল্টু প্লেট এগিয়ে দিলো মার দিকে। বুঝায় যাচ্ছে আর কিছু ভাত লাগবে তার। মুখে কিছু বললো না। মা আগুন চোখে একবার তাকালেন। অকারনে চামুচের ঠুংঠাং শব্দ করে ২ চামচ ভাত তুলে দিলেন। বল্টু রাকার দিকে তাকিয়ে একটু হাসি দিয়ে বললো,”রাকু, আমারে মশা কামড়ায়। পিঠটা চুলকায় দে না। “রাকা বই নিয়ে বিছানায় বসে ছিলো। ঘরে আলো বলতে ঐ কেরোসিনের বাতি। মেঝে থেকে এতদূর আলো আসে না। আসার কথাও না। তারপরও বই নিয়ে বসে থাকার কারন মায়ের রাগের হাত থেকে বাঁচা। মায়ের আজকাল যেনো কি হয়েছে। যার ওপর রাগ তারে কিছু বলে না, অন্যদের ওপর সেই রাগ অন্তর খুলে ঝাড়ে।এই যে বড় ভাই আজ রিক্সা নিয়া না বার হইয়া কই যেনো তাস খেলছে। খবর মা বিকালই পাইছে। কিছু বলে নাই। একটু আগে ঘরের পেছনে বিড়ি ধরাইয়া যে বড় ভাই টানছে এইটা কোন সাক্ষি প্রমান দরকার নাই। মা নিজের চোক্ষেই দেখছে। এতোকিছুর পরেও বড় ভাইরে কিছুই বলতে পারছে না। এর কারন তাদের সংসারটা বড় ভাইয়ের টাকায় চলে অনেকটা। মা অন্যর বাসায় কাজ করে যা পায় সংসার চলে না। বাবা থাকতে মাছের ব্যবসা করতো। কোথায় থেকে মাছ অল্প টাকায় কিনে বাজারে বিক্রি করতো। একদিন ট্রাকের নিচে পরে মরে গেলো। রাকাদের সংসারটাও কেমন আরও গরীব হয়ে গেলো। আগে বড় ভাই স্কুল ফাঁকি দিয়া লাটিম খেলতে যেতো । এখন রিক্সা চালানো ফাঁকি দিয়া তাস খেলতে যায়। রাকা ক্লাস ফোরে পড়ে। পড়তো বলা যায় না। কারন স্কুলের বেতন ৪/৫ মাসের বাকি পড়লেও নাম কাটা যায় নাই এখনও । এটুকুই ভরসা। প্রতিদিন স্কুলের শেষ বেঞ্জে চুপটি মেরে বসে থাকে। যখন নাম কল করে, বুক ধুকধুক করে। আজ হয়তো নাম কাটা যাবে। স্কুল থেকে এসেও বই নিয়ে বসে থাকে সব সময়। বইগুলোর প্রতি ওর কেমন যেনো মায়া। মা প্রায়ই বলছে আর স্কুলে যেয়ে কাজ নাই। কবে যে বন্ধ করে দেয়। কিন্তু রাকার মনে অনেক স্বপ্ন। স্কুলের কাকলি ম্যামের মত একদিন কোন স্কুলের ম্যাম হবে। কাধে গোলাপি ব্যাগ ঝুলিয়ে লম্বা বেনি করে, মিষ্টি হাসি দিয়ে বাচ্চা পড়াবে। বড় ভাইয়ের ধমকে রাকার চিন্তায় বাধা পরে। “কিরে- রাক্ষুসের মত নক রাখছোস কেন। পিঠতো কাইটা ফালাইলি।”রাকা খিলখিল করে হেসে উঠে। মায়ের মুখের দিকে তাকায়। মায়ের কঠিন মুখটা নরম হয়েছে। ছোট ভাইয়ের প্লেটে অনেক গুলো ভাত দেখে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকায়। ছোট ভাই মন দিয়ে ভাত খাচ্ছে। ভাত যে এতো যত্নে কেউ খায়, ছোট ভাইকে না দেখলে জানাই হতো না রাকার। ছোট ভাইকে মা সহ্য করতে পারে না। ছোট ভাইকে বাবা ২ বছর আগে কোত্থেকে যেনো নিয়ে আসলো। সে দিন বাড়িতে কি এক ঝড়টাই না উঠলো। মা মাথা ঘুরে পরে গেলো। এলাকার লোকজন আসলো। কত কি। ১ সপ্তাহ ধরে ছোট ভাই বারান্দায় ঘুমাতো। মা দূর দূর করতো। প্রথম প্রথম রাকা কিছু বুঝে উঠতে পারে নাই। কাউকে জিগ্যেস ও করা যায় না। বাপ-মায়ের ঝগড়া শুনে পরে বুঝেছে। রাকার বাপ গ্রামে একটা বিয়ে করে ছিলো। সেই বউয়ের ছেলে এই ছোট ভাই। ছোট ভাইয়ের মা হঠাৎ মারা যায়। তাই বেচারাকে এখানে নিয়ে আসছে। ছোট ভাই সারাক্ষণ অপরাধী হয়ে ঘুরে। কত আর বয়স রাকার চেয়ে ২ বছরের বড় হবে। খেতে দিলে খায়। না দিলে চুপ করে বসে থাকে। কথা বলেই না।বলবে কি করে বোবা যে। রাকার কেমন যেনো মায়া হয়। আহারে। রাকার মা যতই মুখে দূর দূর করুক, অন্তরে ঠিকই টানে ছোট ভাইকে। এটা রাকা বুঝে। খাওয়া দাওয়া শেষে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হয় রাকাদের। কেরোসিন তেল নষ্ট করার মত জমিদারতো ওরা না। বাহিরে বৃষ্টি হলে ঘরের মধ্যে বৃষ্টির পানি আসে। টিনের চালটা এতো ছিদ্র। কয়টা আটকানো যায়। রাকা ঘুমের মাঝে বুঝতে পারে তার মা ছোটভাইয়ের গায়ে কাথাটা ঠিক করে দেয়। কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে তিন ভাই বোনের দিকে। রাকা বন্ধ চোখের ফাঁকে মাকে দেখে। মায়ের কঠিন মুখটা নরম হয়ে যায়। সকাল হলেই আবার কঠিন। রাত না থাকলে মায়ের এমন নরম মুখ দেখাই হতো না।