গল্প:
অন্তর্বাস
সুচেতনা
বর্ধমানের দাস পাড়ার মেয়ে প্রিয়াঙ্কা…. সবাই পাড়ায় ওকে প্রিয়া বলেই ডাকতো। খুব ডানপিঠে, হুল্লোরবাজ মেয়ে ছিল সে। সবাই কে নিয়ে একসাথে মজা করতে খুব ভালোবাসতো প্রিয়া। ছোট থেকেই পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে নাচ,গান শুনতো ও সব কিছুতেই পাড়ায় সে যোগদান করতো। আস্তে আস্তে প্রিয়া বড়ো হতে থাকে। কৈশরে পা দেবার পর প্রিয়া আস্তে আস্তে পরিবেশের সাথে, সমাজের সাথে মিশতে থাকে ও বুঝতে পারে তার নিজের আত্মসৌন্দর্য কে। ১৬/১৭ বছরে যেই পড়লো তখন থেকেই এক মানসিক ভাবে ভেঙে পড়তে লাগলো। প্রিয়া যে আর ছোট নেই, বন্ধু বান্ধব দের সাথে নানা রকম হাস্যকৌতুকের পাত্রী তাকে হতে হচ্ছিল প্রতিনিয়ত। এদিকে গ্ৰামে সেদিন গাজনের মেলায় সব বন্ধুদের সাথে সেও যাবার জন্য বাড়ি থেকে বের হলো। সবাই মিলে নতুন জামা কিনতে দোকান যায়। সেদিন যা ঘটলো সেটা প্রিয়া আশা করতে পারে নি সেদিন। দোকানে সবাই ছিল, সঙ্গীতা,পারুল, সোমা সবাই প্রিয়ার বান্ধবী। তারাও নতুন জামা কিনতে যায়। দোকানে সবাই এক এক মন্তব্য করে নিজেদের পোশাক কে কেন্দ্র করে। কেউ বলে এটা আমার ছোট, কেউ আবার বলে সেটা তার টাইট, কেউ আবার বলে বুক টা চাপা দেখতে, একটু ঢিলা হলে ভালো হয়। একে একে সবার যখন দেখা শোনা শেষ,প্রিয়ার সময় এলো! তখন দোকান দারের এক অদ্ভুত উক্তি, এই জামা টা প্রিয়াঙ্কা র হয়েই যাবে তাকে আর ফিটিংসের দরকার বা পরে দেখার প্রয়োজন নেই। প্রিয়া অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দোকান দার কে প্রশ্ন করলো, কেন এমন সে বলছে, যেটা ওদের হলো না সেটা তার কি করে হয়…? উত্তরে যা পেলো সেটা মোটেই শ্রুতিমধুর ছিল না। দোকান দারের যুক্তি অনুযায়ী ওদের সুঠাম দেহ,ওদের এটা না হলেও প্রিয়ার এই রোগা শরীরে এটা হয়ে যাওটাই স্বাভাবিক। আর তাছাড়া ওদের মতো তার বক্ষ যুগলের মাপের সাথে তার টা তুচ্ছ মাত্র একটু ঘুরিয়ে বললেও সেদিন প্রিয়া ভালো করেই দোকান দারের ইঙ্গিত টা কোন দিকে তা বোঝে। এই কথাটা শোনার পর প্রিয়া খুব অবাক হয় ও আরো খারাপ অনুভব করে নিজেই, যখন বান্ধবীরা দোকানদারের কথায় হেঁসে ওঠে। কিছুক্ষণ প্রিয়া নির্বাক হয়ে সেখান থেকে কিছু না নিয়ে গার্তদ্ধান করলো। বাড়িতে ফিরে প্রিয়া নিজের ঘরে দরজা দিয়ে আয়নার সামনে নিজেকে বস্ত্র বিহীন দেখলো। সেদিন অনেক প্রশ্ন তার মনকে গ্ৰাস করে কিন্তু সে বলার সঠিক মানুষ পায় নি, এই ভাবে আস্তে আস্তে সে বড়ো হতে থাকে এই সমাজের ই বুকে। স্কুল জীবন শেষ করে কলেজ,সেখানেও তাকে নিয়ে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপের মধ্যে তাকে পরতে হয়। লোক চক্ষুর নির্মম পরিহাস তাকে নানাভাবে অস্থির করছিল তার চলার পথে। দেখতে দেখতে ১৮ থেকে ২২ এ পা দিল প্রিয়া, দৈহিক পরিবর্তন না হলেও সংখ্যায় তার বাড়ন্ত বয়সের পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। কলেজ এর পড়া শেষ হতেই বাড়ি থেকে আর পাঁচটা মেয়ের মতো তার ও বিয়ে নিয়ে দেখাশোনা শুরু হয়ে গেল। তাকেও পরিপাটি হয়ে পাত্র পক্ষের কাছে বসতে হয়। একটা সম্বন্ধ ঠিক হয়ও বটে। পাত্র কলকাতা বাসি পরিবারের ছোট ছেলে সে। শোনা যায় ছেলে টি আবার নাকি সরকারি চাকুরিরতা। দেখাশোনা করে সবকিছু দেখে বিয়ের দিন ঠিক হল। বেশ ধুমধাম করে প্রিয়ার বিয়ে হয়, অনেক লোকের সমাগম ঘটে সেদিন। বৌভাত ও বেশ ভালোই হয়। বৌভাতের রাতে সেই দিনটি ছিল ১২ ই ফাল্গুন, ঘড়ির কাঁটা তখন ১২ ছুঁই ছুঁই। প্রত্যেক মেয়েদের জীবনেই এই রাতকে ঘিরে নানা স্বপ্ন বাসা বাঁধে। প্রিয়াও অনেক কিছু ভেবে লাজুক চোখে বসেছিল কিছু ভালো মূহুর্তের আশায়। বরং যখন প্রথম তাকে স্পর্শ করলো চমকে গিয়ে অদ্ভুত গলায় তাকে বলে উঠলো….” এমা একি গো তুমি তো নিমাই, ধ্যাত্ মজাই হবে না, তোমাকে তো দেখে সেদিন বোঝা যায় নি,ও সেদিন বেশ ভালোই উঁচু করে রেখেছিলে, বুঝতে পারছো না নেকা, ব্রা গো ব্রা আমাকে দেখানোর জন্য সেদিন ফুলিয়ে রেখেছিলে। ধুর ভাবলাম কতো কি করবো, পিন্টুর বৌ এর কি সাইজ উফ্ মাখন দেখেও শান্তি, যাই পরবে তাই ভালো লাগবে….” প্রিয়া নির্বাক হয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল, কি বলবে বুঝতে পারছিল না। হলো সেদিন ওদের ফুলসজ্যা হলো বৈকি, তবে নিছক শারিরীক চাহিদা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আসা কোন অনুভূতি’ই সেদিন প্রিয়া অনুভব করলো না। তার বর তো সে খুশি হলো না, বারবার সেটা প্রকাশ করছিল। শুরু হয় প্রিয়ার নতুন এক জীবনের অধ্যায়।
আস্তে আস্তে সে বাস্তবের মাটিতে পড়ে ও বোঝে সেটা কতো নরবোরে। শুরু হয় ভুলবোঝাবুঝি, নানা অশান্তি সংসারে, দেরি করে স্বামীর বাড়ি আসা, অন্য নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে প্রিয়ার স্বামী, প্রিয়া বুঝেও কিছু করতে পারে না.. একান্নবর্তী সংসারে ওর কথা কেমন যেন ফিকে হয়ে যায়। বাপের বাড়ি তে বললে সেই একি কথা,একটু মানিয়ে নেবার চেষ্টা করতে বলা। যে যার জায়গায় থাকলে বোঝে যে কতোটা মানসিক চাপ না হলে কোন মেয়ে নিজের সংসার থেকে বাপের বাড়ি যাবার কথা ভাবতে পারে। এমন চলতে চলতে হঠাৎ করেই একদিন ডিভোর্স এর কাগজ টা হাতে এলো। প্রিয়া বুঝতেই পারছিল সংসারে তার যে আর কোন প্রয়োজন নেই……. হ্যা সেদিন হয়তো প্রিয়া বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে ঠিক, কিন্তু ডিভোর্স সে দেয় না। বাপের বাড়ি সেই অগত্যা আর সব মেয়েদের মতো তাকেও উঠতে হয়েছিল সেদিন, প্রিয়া জানতো যে আরো অনেক কথা তাকে শুনতে হতে পারে, কিন্তু সেদিন আর কোন উপায় তার কাছে ছিল না। তবে সেদিন প্রিয়া মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল এ সমাজের উপযুক্ত হয়ে সে দেখিয়ে দেবে। বাড়িতে থেকে সময় কাটছিল না তার এদিক ওদিক কাজের চেষ্টা করতে থাকে পেয়েও যায় একটি বেসরকারি মাধ্যমের স্কুলের চাকরি। দিন যতোই এগোচ্ছিল প্রিয়ার মধ্যে জেদ কিন্তু বিন্দুমাত্র কম হচ্ছিল না। একদিন, পেপার পড়তে পড়তে সে এক ব্রেষ্ট বিশেষজ্ঞ ডাঃ এর সন্ধান পায়। সেখানে যায় ও প্রিয়া, কিন্তু সেই ডাঃ এতো সুন্দর করে তাকে বোঝালো যে সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। এটা ঠিক যে নানা সার্জারির মাধ্যমে আজকাল অনেক অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে সম্ভোব ডেবলভ করার, কিন্তু সেটা যেমন ব্যয় সাপেক্ষ তেমনি কৃত্রিমভাবে করা তার পক্ষে অতোটা ও ঠিক হতো না। তাই গোলাপের উদাহরণ দিয়ে সেদিন ঐ ডাঃ প্রিয়ার চোখ খুলে দেয়, তিনি বলেছিলেন..” দেখ প্রিয়া,তোমাকে যে ভালোবাসবে সে তোমার শারীরিক গঠন দেখে ভালোবাসবে না,সে তোমার নিজের ভালো সত্তাকে ভালোবাসবে,আর এই গঠন সে তো সাময়িক আনন্দ দেবার মাধ্যম,ক্ষণস্থায়ী। এক সময় না এক সময় সেটারো অন্তিম আছে,গোলাপ তো কতো রকম রঙের হয় লাল কালো ও হয়, আবার কাঁটা ও আছে এতে কি এর রূপ, সৌন্দর্য্য কিঞ্চিত কমেছে….?” কথাগুলো শুনে কিছু ক্ষণ স্তম্ভিত হয়েছিল প্রিয়া। এমন ভাবে তো সে কখনোও ভাবে নি। তবে সেদিন প্রিয়ার আরেক টা ভালো কাজ হলো। কিছু পরামর্শ সে সেই ডাঃ এর কাছে পায়। আস্তে আস্তে সেই ডাঃ এর কথা মতো প্রিয়া রোজ শরীর চর্চা করে, নানা রকমের ওয়েল, দামী “অন্তর্বাস” কিনে সেটা ব্যবহার করতে শুরু করে। নিজেকে নতুন ভাবে তৈরী করতে এই যুগের সাথে তালে তাল মিলিয়ে চলতে সে প্রস্তুত। এমন করে বেশ কয়েক মাস কাটলো, প্রিয়াকে আজকাল বেশ অন্যরকম লাগে, খুব” এটরেক্টটিভ ” ঢিলা ঢালা পোশাক বদলে মার্জিত কিন্তু স্ট্যাইলিস পোশাকে তাকে বেশ লাগে আজকাল। পরিবারের সবাই অবাক প্রিয়ার নতুন রূপে। যে বান্ধবীদের নানা কথায় তাকে নিজেকে লোকাতে হয়েছিল বার বার , সেই বন্ধু বান্ধবীরা আজকাল প্রিয়াকে ছাড়া চলতেই পারে না। রাস্তায় বেরোলে সবার মতো তার দিকেও ছেলে রা তাকায় ও নানা কথা তাকেও শুনতে হয় বৈকি। তবে এখানেই থামে নি প্রিয়া, নিজেকে আরো আপটুডেট যে তাকে করতেই হতো। শিখলো নানা আদব কায়দা, বিউটি পার্লার এ গিয়ে নিজেকে আরো সুন্দর সে করলো। চুলের নানা রকম কাটিং তাকে আরো নতুন রূপ প্রদান করলো। বেশ এমনি কাটছিল প্রিয়ার , তবে সেই পেপার টা তার কাছে তখনো বিত্তমান, একদিন সেই পেপারে সই করে তার আগের শ্বশুরবাড়িতে, যেখান থেকে তাকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল, পরে সেই বাড়িতে যায় প্রিয়া। সকাল সকাল তার সরকারি চাকুরে স্বামি বাড়িতেই ছিল, খাবার ঘরে পেপারে মগ্ন। ঘরের দরজা খোলা থাকায় প্রিয়া সরাসরিই খাবার ঘরে পৌঁছায়, লাল টপ আর নীল জিন্স এ বেশ লাগছিল সেদিন প্রিয়াকে। ডিভোর্সের পেপার টা তার বরের মুখের ওপর ছুঁড়ে বললো, এটাই তো সে চেয়েছিল, সই সে করে দিয়েছে, তার বর প্রিয়ার এই নতুন পরিবর্তন এর কথা জানতো না, প্রিয়াকে দেখে অবাক হয়ে রোইলো, চোখ টা মিথ্যা বলবো না, সেদিন একবার হলেও বক্ষযুগলের দিকে দৃষ্টিপাত পরেছিল। আর তার সৌন্দর্যের সামনে কি বলবে কিছু বুঝতে না বুঝতেই, প্রিয়া বলে ওঠে যে, সে আজ তাকে ত্যাগ করলো। আর কোনদিন যেন এই কাপুরুষ চেহারা টা তাকে আর না দেখায়। এই বলে গট গট করে সে সেখান থেকে গাত্রদ্ধান করলো……. পরে অবশ্য তার স্বামী প্রিয়ার এই নব যৌবনা সুঠাম শরীর দেখে সেদিন আবার তাকে ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেদিন প্রিয়া তার সাথে যায় নি। ফিরিয়ে দেয় তার তার এক্স স্বামী কে….। এরপর আস্তে আস্তে প্রিয়া গতানুগতিক ধারায় নিজেকে আরো লাবণ্যময় করে তোলে। নিত্যনতুন ” অন্তর্বাস ” যে তাকে এই সমাজের বুকে এক নতুন পরিচয়ে আনবে সে এতোটাও ভাবেনি কখনোও। বাবা, মার সাথেই প্রিয়া তার এই ডিভোর্সি জীবন ছেড়ে এক নতুন পরিচয়ে বাঁচার উপায় খুঁজলো। নিজের মতো নিজেকে ভালোবাসতে আজ সে ও পারে। আজকাল তাকেও বাইরে বেরোলে উফ্ কি যাচ্ছে দেখ,হেব্বি হট, সেটাও শুনতে পায় সে। হয়তো এটাই সবাই চায়,এটাই চেয়েছিল সবাই। নতুন কেউ তার জীবনে আসবে কিনা সে জানে না, তবে অনেক অভিজ্ঞতা তার হলো এই সমাজের বুকে…..।
#সুচেতনার/Kolkata