সুগন্ধ
তসলিমা হাসান
মৌমিতা একটি বাতাবি লেবু গাছ লাগিয়েছিল। মন প্রাণ ঢেলে ওর যত্ন করেছিল। পানি ,সার দিয়েছিল,নিয়ম করে রোদ্দুর লাগিয়েছিল। দিনে দিনে গাছটি রূপসী হয়ে বেড়ে উঠছিলো। মৌমিতা অপেক্ষায় ছিল কখন ও তাকে ফল দিবে, আর ফল খেয়ে ওর দেয়া শ্রমের কস্ট ভুলে যাবে। কিন্তু না কোন ফল ফলছে, না ফুল হচ্ছে। পরাগায়ন করা হলো, তাতেও কাজ হলো না।
দিনে দিনে গাছের প্রতি যত্নের কমতি দেখা দিল। মৌমিতার মনে হলো গাছটি ঠিক যেনো ওর একমাত্র ছেলে প্রিন্সের মতো।
কেউ তার শ্রমের মূল্য দিল না। তাই সে আজকাল গাছটির দিকে তেমন মায়ার দৃষ্টিতে আর তাকাতে পারে না, তাকালেই মনে হয় গাছটি যেন ওকে তিরস্কার করছে , বলছে, তোমার লালন পালনে ক্রটি আছে তাই তুমি প্রতিদান পাও না।
মৌমিতা বুঝতে পারে না পানি, উপযুক্ত মাটি, সার আর রোদের বাহিরে তাকে আর কি দেয়া যায়!
সত্যি সত্যি কি গাছটি ফল না দেয়ার জন্য তাকে দোষ দিচ্ছে নাকি মৌমিতাই গাছটিকে তার একমাত্র বখে যাওয়া পুত্রের সংঙ্গে মিশিয়ে ফেলেছে! আজকাল ছেলে সব কিছুতে বাবা মার দোষ দেখে। সে বুঝতে পারে না, কি করে ছেলেকে বুঝাবে যে একমাত্র প্রিন্সই তার ধ্যান জ্ঞান সব। হয়তো বিদেশে নিজ হাতে সব কাজ করতে হয় বলে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারে না। এ ছাড়া আর কোন ক্রটি সে নিজের কিংবা স্বামীর খুঁজে পায় না। প্রিন্স আজ কাল তেমন বাবা মার সাথে কথাও বলে না, কখনো কখনো বাসায় খায়, বেশির ভাগ সময়ই হোটেলে খায়। বাবা মার কস্টে উপার্জিত অর্থ ব্যয় করে বাবা মা’র দোষ খোঁজাই তার একমাত্র কাজ।
মৌমিতাকে হতাশায় পেয়ে বসেছে।যাকে বিষন্নতা রোগ বলে।রোগ নিরাময়ের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া দরকার কিন্তু সে তা মনে করে না, সে জানে তার কি রোগ আর কি তার ঔষধ। তার বাতাবিলেবু চাই।
ছেলের অত্যাচার সীমার বাইরে চলে গেছে। এক দিকে ছেলের অত্যাচার অন্যদিকে স্বামীর চাপের মুখে থাকতে হয় সারাক্ষণ। তার স্বামীর এক কথা তোমার প্রশ্রয় পেয়ে ছেলে মাথায় উঠেছে, এখন তুমি সামাল দাও। মায়ের ভালোবাসার নাম যে প্রশ্রয়, এতো মৌমিতার জানা ছিলো না। আজও নিজের মায়ের ভালবাসার কথা মনে করে ছেলের প্রতি কঠোর হতে পারে না, মনে মনে আশা বেঁধে রাখে ছেলে তার মায়ের মমতা কি তা একদিন ঠিকই বুঝবে, জীবিত না হলে ও মৃত্যুর পর!
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মৌমিতা জানার পর্দা সরিয়ে দিতে গিয়ে দিলো না, মনে মনে ভাবলো লেবু গাছটিকে আর রোদ লাগতে দিবে না, তার শাস্তি পাওয়া দরকার। একদিন, দুদিন, তিনদিন , নাহ্, আর নয়, অনেক শাস্তি দেয়া হয়েছে, মৌমিতা পর্দা সরিয়ে দিল, পাশে বসে কথা বলে বলে আদর করতে লাগলো ” আচ্ছা বাতাবি তুই কি ফল গাছ নাকি সব্জি গাছ? তুই কি জানিস, তোর গায়ে কত সুগন্ধ? সে গন্ধ নিতে গেলে তোর পাতা ছিঁড়তে হয় তা না হলে পাওয়া যায় না। কিন্তু আমি যে তোকে অনেক ভালোবাসি, তোর গায়ে আঁচড় কাটতে পারি না, তোর গায়ে ফল হলে আমি ছিঁড়তে পারবো না, শুধু দেখে দেখে তৃপ্ত হব। তুই যে আমার ছেলের মতো!
মৌমিতার চোখ থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে জল পরতে লাগলো। লেবুর একটি ডাল টেনে পাতায় চুমু দিল,
চোখের দু’ফোঁটা নোনা জল তেতো লেবু পাতার উপর পরে রইলো আর রোদের আলো পরে নোনা জল মূল্যবান পাথর পান্নার মতো জ্বলজ্বল করতে লাগলো মৌমিতা গুন গুন করে গাইতে লাগলো
“আমি আশায় বেঁধেছি বুক,
তুমি আমায় দিয়েছিলে সুখ।
আবার যেন দেখি আমি
তোমার সেই সোনালী নির্মল মুখ “।
মৌমিতা অনুভব করলো কেউ যেন তার কাঁধে হাত রেখেছে, বড় মোলায়েম, আদরের হাত। বা’হাত দিয়ে হাতটি ছুঁয়ে দেখলো, মনে মনে ভাবলো কার হাত হতে পারে, মন বলছে ছেলের হাতই হবে, অবস্থা বলছে ছেলের বাবার হাত হবে।
নাহ্, এটা ছেলের হাত।
চোখের জল মুছে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো, কিরে বাবা আজ এত সকাল সকাল উঠে পড়লি?
ছেলে প্রশ্নের উওর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
মা!তোমার কি হয়েছে, কাদঁছো কেনো?
মা, সহজ ভাবে বললো; আমি লেবু গাছটিকে এত যত্ন করলাম অথচ গাছটিতে একটি লেবুও ধরলো না।
ছেলে অবাক হয়ে বললো,
এই জন্য তুমি কাঁদছো?
মৌমিতা উওর দিলো না। শুধু দুঃখভরা নয়নে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলো ।
ছেলে মাকে আস্বস্ত করে বললো, আমি আজই তোমার জন্য অনেক লেবু কিনে নিয়ে আসবো ।
মৌমিতা বললো, কিন্তু আমি যে আমার নিজ হাতে লাগানো গাছের লেবু চাই।
ছেলে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
সকালের রোদ লেবু গাছ থেকে সরে ছেলের মুখের উপর পরলো। মৌমিতা পর্দা টেনে ছেলের মুখ রোদের আড়াল করে দিল ।
ছেলে মাকে ছেড়ে লেবু গাছের সামনে এসে বসে লেবু গাছটি দেখতে লাগলো আর ফিস ফিস করে বললো ; দেখেছো মা, লেবু গাছটি কত সুন্দর? ও ফল না দিলেও অক্সিজেন তো দেয়।
মা ও ফিস ফিস করে বললো, ঠিক যেন তোর মতো ।
হঠাৎ ছেলে উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলো,
দেখো,দেখো মা!
গাছের গোড়ার দিকে দেখো, ওখানে একটি লেবু দেখা যাচ্ছে।
মৌমিতা লেবুর দিকে তাকালো না, ছেলে মুখের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো, ছেলের দু গালে হাত দিয়ে উপরের দিকে তুলে ধরে বিস্ময়ের সাথে বললো; বাবা, তুই তো আমার বাতাবিলেবু, সত্যিই আমার গাছে ফল ধরেছে।
ছেলে বললো; হ্যাঁ মা, তোমার গাছে ফল ধরেছে।
আচ্ছা মা, লেবু ফল না সব্জি?
মা আর ছেলে এক সঙ্গে হেসে উঠলো ।
ছেলে বললো, মা, লেবুর রস বেশি খাওয়া যায় না ।
মৌমিতা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললো আমার রস চাই না, সুগন্ধেই আমি খুশি।
তসলিমা হাসান
কানাডা: ১১-০৭-২০২২
১ Comment
গল্পের থীমটা রীতিমতো অন্যরকম।আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। লেখিকা তসলিমা হাসান কে অনেক ধন্যবাদ।