সরকারি, সহকারি, কর্মচারি: বানান রীতি:
অভিধান সামনে নিয়ে লিখতে বসে কজন? বলতে গেলে, কেউই না। সত্যি বলতে কি, বেশির ভাগ বাড়িতে অভিধান থাকেও না। থাকলেও, আলসেমি কাটিয়ে, চেয়ার ছেড়ে উঠে, তাকের ওপর থেকে সেই অভিধান নামিয়ে, তা ব্যবহার করে খুব কম লোকই। অভিধান খুলে একটা শব্দ খুঁজে বের করা খুব কঠিন কাজ নয়। কিন্তু তার জন্যেও একটুখানি প্রয়াস পেতে হয়। শারীরিক আর মানসিক আলসেমি তাতে বাধা দেয়। এ রকম অবস্থায় একটা শব্দের বানান নিয়ে খটকা লাগলে উপায় কী?
ধারে-কাছে কেউ থাকলে, তাকে জিজ্ঞেস করে নেওয়া যায়। অবশ্য তাতে সঠিক বানানটা যে জানা যাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ, তা নির্ভর করে যাঁকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তাঁর বানান-জ্ঞান কত পাকা, তার ওপর। তাহলে সংশয় দূর করার উপায় কী? এ ক্ষেত্রে অনেকে শব্দটা দু-তিন রকমে লিখে যাচাই করে দেখেন—কোন বানানটাকে চেনা মনে হয়। যেটাকে চেনা মনে হয়, সেটাকেই শুদ্ধ মনে করে লিখে ফেলেন।
এমন জায়গায় মনে হতে পারে, কারও সাহায্য ছাড়াই লেখক বুঝি বানানটা পেয়ে গেলেন। সেটা আসলে ঠিক নয়। লেখক সাহায্য নিয়েছেন বৈকি, নিজের চোখের সাহায্য। মনের মধ্যে শব্দটার যে-চেহারা বহুকাল ধরে সঞ্চিত হয়ে আছে, তার মানে, শব্দটার যে-চেহারার সঙ্গে লেখকের চোখ দুটি আবাল্য পরিচিত, এমনকি, লেখার জন্যে হাতের আঙুলগুলো অভ্যস্ত, তিনি সেই বানানটাকেই গ্রহণ করেছেন (সেটা ভুলও হতে পারে)। কিন্তু কোনো ভাষা লেখা বা পড়ার কৌশল আয়ত্ত করতে শব্দের আকৃতি একটা বড় ভূমিকা পালন করে। পাশ্চাত্যে শিশুরা প্রথমে অক্ষর শেখে না, শব্দ শেখে। এ শিক্ষা হয় শব্দের আকৃতি দেখে। একবার আকৃতি দেখে দেখে শেখার পর অক্ষরগুলোকে আলাদা আলাদা করে চিনে ফেলে। ব্যাট, ফ্যাট, হ্যাট, ম্যাট, প্যাট, র্যা ট, স্যাট ইত্যাদি শব্দ পড়তে পড়তে শিশুরা ‘এ’ আর ‘টি’ অক্ষর দুটির আকৃতি এবং সেই সঙ্গে তাদের ধ্বনির মিল বুঝে ফেলে। শব্দের আকৃতি তাই পড়তে শেখার এবং সেই সঙ্গে বানান শেখার একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। বস্তুত, মুখস্থ করে কেউই বানান শেখে না। শিখলে সেই পদ্ধতিটাকে সুস্থ কিংবা স্বাভাবিক পদ্ধতি বলা যায় না। বানান মানুষ শেখে দেখে দেখে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একটা ভাষায় বানানের একটা ঐতিহ্য গড়ে ওঠে। তাতে কোনো কোনো বানানকে অযৌক্তিকও মনে হতে পারে। কিন্তু সেই অযৌক্তিক বানানটাকেই আমরা শুদ্ধ বলে গণ্য করি। যেমন ‘পানি’ কথাটা এসেছে ‘পানীয়’ শব্দ থেকে। এ ক্ষেত্রে ‘পানি’ শব্দের বানান ‘পানী’ হলে সে বানানটাকেই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হতো। হিন্দিতে ‘পানী’ই লেখে। কিন্তু বাংলায় আমরা মূল বানান একটু বদলে ‘পানি’ লিখি। কিন্তু তাই বলে ‘পানি’ বানানটা অশুদ্ধ নয়। কয়েক শ বছর ধরে প্রচলিত থাকায় বাংলা ভাষায় ‘পানি’ই প্রামাণ্য বানানে পরিণত হয়েছে। মূলের সঙ্গে মিল থাক বা নাই থাক, বাংলার জন্যে সেটাই শুদ্ধ।
সত্যিকার অর্থে বানানের কোনো শুদ্ধ-অশুদ্ধ নেই। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শব্দগুলো লিখতে লিখতে যে-বানানগুলো গৃহীত হয়, সেটাই সেই ভাষার শুদ্ধ বানান। আর, সেই বানানের সঙ্গে আমাদের চোখ অভ্যস্ত হয়ে যায়। তাই ইংরেজিতে ‘laugh’ লিখলে শেষের gh অক্ষর দুটোর উচ্চারণ হয় ‘ফ’। কিন্তু ‘ghost’ কথাটা লিখলে সেই gh-এর উচ্চারণ হয় ‘গ’। আর ‘daughter’ লিখলে gh-এর কোনো উচ্চারণই হয় না। ইংরেজি ‘শুগার’ (sugar) শব্দটার বানান ফ্রেন্চ্, জর্মান, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, ডেনিশ ও সুইডিশ ভাষায় লেখা হয় যথাক্রমে sucre, zucker, zucckhero, azucar, sukker, socker। রুশ ভাষার অক্ষরগুলো ইংরেজির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু ইংরেজি অক্ষরে রূপান্তর করলে রুশ ‘শুগার’ লেখা হয় sukher বানানে। সেই সেই ভাষার জন্যে এই বানানগুলোর প্রতিটিই শুদ্ধ। আমাদের চোখ বানানের নিয়ম জানে না, কিন্তু শব্দের আকৃতি সম্পর্কে তার একটা মোটামুটি ধারণা আছে। সেই ধারণার সঙ্গে না মিললে চোখ বুঝতে পারে অক্ষরগুলোর মধ্যে কোথাও একটা গরমিল আছে। কাজেই বাংলায় ‘পানী’ লিখলে পাঠকের চোখে সেটাকে ভুল বলে মনে হবে।
আকৃতি ছাড়া, বানান মনে রাখার আর-একটা উপায় হলো সাদৃশ্য। একটা শব্দের সাদৃশ্য থেকে লেখক আর-একটা শব্দ লেখেন। এত দিন ধরে বানানটা ছিল ‘সরকারী’। কিন্তু এটাকে ‘সরকারি’ লিখলেও তা শুদ্ধ হবে বলে বাংলা একাডেমি বিধান দিয়েছে। বাংলা একাডেমির পণ্ডিতবর্গের যুক্তি হলো: এটা বিদেশি শব্দ, এ শব্দের বেলায় সংস্কৃত নিয়ম খাটবে না। ‘সরকার’ শব্দের শেষে তাই হ্রস্ব ই–কারের বদলে দীর্ঘ ঈ-কার দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বাংলা একাডেমি কিন্তু এ কথা বলেনি যে, দীর্ঘ ঈ-কার দিলে সেটা ভুল হবে। তা সত্ত্বেও অনেকেই ধরে নিয়েছেন যে, হ্রস্ব ই–কার দিতেই হবে, নয়তো ‘সরকারী’ লিখলে সরকারের মর্যাদাহানি হবে।
বানান সংস্কারের সুপারিশ করেছেন যে-পণ্ডিতবর্গ, তাঁরা অবশ্য ‘সরকারি’ লিখলে যে-বিপদ হতে পারে, সেটা বিবেচনা করেননি। তার ফল ফলেছে হাতেনাতে। সাদৃশ্যবশত সাধারণ মানুষ অনেকে তাই ‘সরকারি’ শব্দের সাদৃশ্যে ‘সহকারী’ কথাটাকেও ‘সহকারি’ লিখতে শুরু করেছেন। এই প্রথম আলোতেই আমি ‘সহকারি’ বানানটা দেখেছি। বাংলা একাডেমির বিধান অনুযায়ী এ বানানটা কিন্তু ভুল। ভুল কারণ ‘সরকারী’ কথাটা বাংলা নয়, ‘ফারসী’। অপর পক্ষে, ‘সহকারী’ শব্দটা সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে। তাই বাংলা একাডেমি বলেনি যে, ‘সরকারী’র সঙ্গে সাদৃশ্য আছে বলে ‘সহকারী’র দীর্ঘ ঈ-কারটাকে হ্রস্ব ই–কার লেখা যাবে অর্থাৎ ‘সহকারি’ লেখা যাবে। অথবা ‘কর্মচারী’ শব্দটাকে লেখা যাবে ‘কর্মচারি।’ সহকারী, কর্মচারী, সহযোগী, সহকর্মী—এ শব্দগুলো সংস্কৃত ভাষার। সুতরাং এ শব্দগুলোর শেষে দীর্ঘ ঈ-কার লিখতে হবে। আর ‘সরকারি’ বিদেশি শব্দ বলে হ্রস্ব ই–কার দিলেও তা শুদ্ধ হবে।
এটা অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে সবাই বাংলা একাডেমির বানান কমিটির বিশেষজ্ঞ নন। তাই কোন শব্দটা সংস্কৃত, কোনটা আধা-সংস্কৃত, কোনটা ‘দেশী’, কোনটা ‘বিদেশী’—এটা সাধারণ মানুষের জানার কথা নয়। বাংলা একাডেমির বিশেষজ্ঞরা কি চান যে, দেশের কোটি কোটি লোক ব্যাকরণ শিখে তারপর বাংলা লিখবেন? স্কুলের ছাত্রদের ব্যাকরণ শেখার সুযোগ আছে, কিন্তু দোকানে কাজ করতে করতে, অফিসে কাজ করতে করতে আমার পক্ষে, আমাদের পক্ষে, কোটি কোটি লোকের পক্ষে নতুন করে বানানের নিয়ম শেখা সম্ভব নয়। কোথায় হ্রস্ব ই–কার হবে অথবা কোথায় দীর্ঘ ঈ-কার হবে, সাধারণ মানুষ সে নিয়ম জানেন না। জানলেও বোঝেন না। ফলে, ইতিমধ্যে ‘কর্মচারী’ বানানকেও ‘কর্মচারি’ হতে দেখেছি প্রথম আলোতে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে। এখন কেউ যদি লেখেন ‘সরকারি সহকারি কর্মচারি’ তাহলে দীর্ঘ ঈ-কারের পুরোপুরি বিনাশ দেখে বিস্মিত হব না। কেবল বিস্মিত হব না তা–ই নয়, কাউকে দোষও দেব না। কারণ ভাষা শুধু ব্যাকরণ-জানা পণ্ডিতদের জন্যে নয়, ভাষা সবার। শুদ্ধ বানান লেখার জন্যে কাউকে ব্যাকরণ শিখতে বাধ্য করার কোনো অধিকার কারও নেই। না সরকারের, না ‘সরকারী’ প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির, না সর্বাধিক প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোর। বহু শতাব্দী ধরে বাংলা শব্দাবলির যে বানান তৈরি হয়েছে, সেই বানানেই সবার লেখার অধিকার আছে, সেই বানানেই সবার লেখার কথা।
অবশ্য কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, ‘সরকারি সহকারি কর্মচারি’ বানানে একটা বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হলেও, বেকার লোকেরা কি সেই ‘চাকরি’র জন্যে আবেদন করবেন না? কারণ কথাটা বোঝা যাচ্ছে। সুতরাং ওভাবে লিখলে ক্ষতি কী? দীর্ঘ ঈ-কারকে একেবারে তেপান্তরের ওপারে দূর করে দিলেই বা কী যায়-আসে? যায়-আসে বৈকি।
রবীন্দ্রনাথ নামক এক অকালপক্ব যুবক ১৮৭৯/৮০ সালে এক বিদেশিনী বান্ধবীকে বাংলা শেখাতে গিয়ে বাংলা বানান আর উচ্চারণের মধ্যে অসংগতি লক্ষ করেন। সেই নিয়ে কয়েক বছর পরে তিনি একটা প্রবন্ধও লেখেন। কেবল তা-ই নয়, চিঠিপত্রে এই বানানের কিছু প্রয়োগও করেন। তারপর যখন কবি এবং সাহিত্যিক হিসেবে তিনি একনায়কে পরিণত হন, তখন অসংস্কৃত শব্দের ক্ষেত্রে তিনি কিছু প্রথা-বিরোধী বানান লিখতে আরম্ভ করেন। কিন্তু সর্বত্র এ নিয়ম নিজেই তিনি পালন করেননি। এভাবে তিনি বাংলা বানানের ক্ষেত্রে একটা জগাখিচুড়ি নিয়ম চালু করেন। ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান কমিটি এই অনিয়মকেই নিয়মে পরিণত করে। একবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান সংস্কারের বিধি চালু করার পর যে-সমস্ত প্রতিষ্ঠান ক্ষমতাধর যেমন: বাংলা একাডেমি, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, আনন্দবাজার গোষ্ঠী, প্রথম আলো প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান বাংলা বানানের সাজানো বাগানে মই দিতে শুরু করল—এসব প্রতিষ্ঠানকে এ ক্ষমতা কেউ দেয়নি। তাদের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের ফলে আজ দেখা দিয়েছেন ‘সহকারি কর্মচারি’ এবং অদূর ভবিষ্যতে দেখা দেবেন তাঁর ‘সহযোগি সহকর্মি’। এই ক্রমবর্ধমান নৈরাজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমি সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিচের মোদ্দা কথাগুলো ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি:
দেশের সাধারণ শিক্ষিত লোকেরা কি একটা শব্দ দেখে সেটাকে সংস্কৃত, আধা-সংস্কৃত, সংস্কৃত থেকে আগত, দেশি অথবা বিদেশি শব্দ বলে চিনতে পারেন?
দেশের তাবৎ শিক্ষিত লোকেরা কি ব্যাকরণ জানেন অথবা এখন নতুন করে শিখবেন?
সবাইকে ব্যাকরণ শেখানো কি সম্ভব?
যদি সম্ভব না-হয়, তাহলে তাঁরা কীভাবে জানবেন নতুন নিয়ম অনুসারে কোন বানানটা সঠিক, কোনটা ভুল?
‘শ্রেণী’কে ‘শ্রেণি’ লিখে কার কী লাভ হবে? এর ফলে কি বিভ্রান্তি বাড়বে না?
সাধারণ শিক্ষিত লোকেরা কি জানেন কোন কোন সংস্কৃত শব্দের বেলায় দীর্ঘ স্বর না লিখে হ্রস্ব দিলেও গ্রহণযোগ্য হবে?
নতুন নিয়মে ‘পুজারি’ না-লিখে ‘পূজারি’ লেখা হয় কোন নিয়মে?
ইংরেজি বানান বাংলা বানানের তুলনায় ঢের অযৌক্তিক। তাই নোবেল পুরস্কার-বিজয়ী নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ তাঁর টাকাপয়সা উইল করে রেখে গিয়েছিলেন অবৈজ্ঞানিক ইংরেজি বানান সংস্কারের উদ্দেশে। তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় ষাট বছর চলে গেছে, তা সত্ত্বেও একটি শব্দের বানানও বদলায়নি। ১৯৫০ সালের দিকে বাংলা ভাষা আরবি হরফে, নিদেন পক্ষে রোম্যান হরফে লেখার জন্যে তখনকার সরকার অনেক প্রচার চালিয়েছিল। সে চেষ্টা সফল হয়নি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস বানান সংস্কারের আত্মঘাতী সুপারিশও সফল হবে না। কেবল লোকের দুর্বল বানান-জ্ঞান আরও নড়বড়ে হবে। তাই আমার প্রস্তাব হলো: বানানের যে ঐতিহ্য এতকাল ধরে গড়ে উঠেছে, সেটাই বজায় থাকুক। ভাষা চলুক নদীর মতো, তার আপন পথে।