শিশুদের প্রতি নির্যাতন নয়।
ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম
শিশু কথাটা শুনলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে কোমলমতি সুন্দর নিষ্পাপ চেহারা। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। অথচ সমাজের কিছু মানুষ তাদেরকে নির্যাতন করে। বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত শিশু হত্যাকান্ডের ঘটনাগুলো আমাদের বেদনাহত করে। ফলে আমরা ক্ষুব্ধ, মর্মাহত, স্তম্ভিত ও শোকাহত হই। এসব ঘটনার ফলে শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠে।
আজকের শিশুরাই আগামী দিনের দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের কর্ণধার। তাদের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে পিতা – মাতার পাশাপাশি সমাজের সকলেরই যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। কারণ তারা ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দেবে। তাই তাদের যদি সুন্দরভাবে গড়ে তোলা যায় তাহলে ভবিষ্যত পৃথিবী হবে সম্ভাবনাময়, বর্ণিল এবং আরও সুন্দর।
সরকার ও জাতিসংঘ শিশু তহবিল ( ইউনিসেফ) এর মতে শিশুর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ। কিন্তু শিশুদের নিয়ে কাজ করার ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্হার মতে, শিশুর সংখ্যা ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ। সুস্থভাবে খেয়ে পরে নিরাপদে বেঁচে থাকা শিশুর মৌলিক অধিকার।
শিশুদের সুরক্ষা দিতে দেশে ৩৫ টি আইন রয়েছে। । আইনের সঠিক প্রয়োগ ও ব্যবহার না হওয়ায় দেশে শিশু নির্যাতনের হার বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়তই শিশুর ওপর সহিংসতা , যৌন নিপীড়নসহ আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। শিশু শ্রম, শিশু বিবাহ, শিশু পতিতাবৃত্তি , শিশু পর্নোগ্রাফি, শিশু গৃহ শ্রম, শিশু যৌন নির্যাতন, শিশু পাচার, পথ শিশু ভিক্ষাবৃত্তি, বাধ্যতামুলক শিশু ভিক্ষাবৃত্তি, শিশু প্রতিবন্ধী, ইত্যাদি ১২ টি ক্যাটাগরিতে শিশু আইন সবসময় লঙ্ঘন হচ্ছে। মহানবী (সাঃ) ঘোষনা করেছেন, ‘ তোমরা শিশু সন্তানদের স্নেহ কর, তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার কর এবং সদাচরণ ও শিষ্টাচার শিক্ষা দাও ‘ ( তিরমিজি)। শিশুদের প্রতি দয়া মায়া সম্পর্কে নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, ‘ যে শিশুদের দয়া করে না, তাকে দয়া করা হয় না ‘ ( বুখারী, মুসলিম, তিরমিজি)।
২০১৩ সালের শিশু আইনের ৪ ধারানুযায়ী অনুর্দ্ধ ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু হিসেবে গন্য হবে। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের (সংশোধনী ২০০৩) এর ২(ট) ধারানুযায়ী শিশু বলতে বোঝায় অনধিক ১৬ বছর বয়সের কোন ব্যক্তি। ১৯৬৫ সালের কারখানা আইনের ২ (গ) ধারানুযায়ী ১৬ বছর পূর্ণ হয়নি এমন ব্যক্তিকে শিশু বলা হয়েছে। ১৯৬৫ সালের দোকান ও প্রতিষ্ঠান আইনের ২(খ) ধারানুযায়ী ১২ বছর পূর্ণ হয়নি এমন ব্যক্তিকে শিশু বলা হয়েছে। ১৯২৩ সালের শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ আইনের ২ (ক) ধারানুযায়ী ১৫ বছরের নীচে বয়স্ককে শিশু হিসেবে বর্নিত করা হয়েছে। ১৯৩৩ সালের শিশু (শ্রম বন্ধকী) আইনের ২ ধারানুযায়ী শিশু বলতে এমন এক ব্যক্তিকে বোঝাবে যার বয়স ১৫ বছরের কম। ১৯৬২ সালের চা বাগান অধ্যাদেশের ২ (গ) ধারানুযায়ী ১৫ বছর পূর্ণ হয়নি এমন ব্যক্তিকে শিশু বলা হয়েছে। ১৯২৩ সালের খনি আইনের ৩ (গ) ধারানুযায়ী ১৫ বছর পূর্ণ হয়নি এমন ব্যক্তিই শিশু। ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ ২ (ক ) ধারানুযায়ী শিশু বলতে ওই ব্যক্তিকে বোঝাবে যার বয়স পুরুষ হলে ২১ বছরের কম এবং মহিলা নারী হলে ১৮ বছরের কম।
মুসলিম আইনে কোনো বালক বা বালিকার নাবালকত্ব তার বয়ঃসন্ধিতে পৌছানোর পরই শেষ হয়ে যায়। হানাফি ও শিয়াদের মতে, ১৫ বছর বয়স পেরিয়ে গেলেই পূর্ণ বয়স অনুমান করা হয়। তবে ১৯৬১ সালের পারিবারিক আইন অনুসারে সাবালকত্বের বয়স ১৬ বছর এবং ১৮৫৭ সালের সাবালকত্ব আইনের ৩ ধারা অনুসারে শিশু বলতে ১৮ বছরের কম বয়সি কোনো ব্যক্তিকে বোঝায়। কোনো নাবালকের অভিভাবকত্ব আদালতের এখতিয়ারাধিন হলে তা ২১ বছর হবে। জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী ১৮ বছর বয়সের সবাই এবং ইউনিসেফের হিসেব অনুযায়ী, ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত যে কোনো ছেলে বা মেয়ে শিশু বলে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশের শিশুনীতি অনুযায়ী ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলে-মেয়েরা শিশু হিসেবে গন্য।
কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে ধার্য্য বয়সসীমা নির্ভর করে সেদেশের অপরাধ আইনের ওপর।।বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৮২ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, যখন ৭ বছরের নীচে কোনো শিশুর কাজকে অপরাধমূলক বলে বিবেচনা করা যাবে না এবং ৮৩ ধারাতে বলা হয়েছে, ৭ বছরের উর্ধ্বে এবং ১২ বছরের নীচে যে কোনো শিশু বা কিশোরের কাজকেও অপরাধমুলক বলে বিবেচনা করা হবে না। যদি না সে বিশেষ কোনো সময় বা পরিস্থিতিতে তার কৃতকর্মের প্রকৃতি বা ফলাফল সম্পর্কে বোঝা বা বিচার করার ক্ষমতা অর্জন করে।
তিন বছর পর্যন্ত শিশুরা দ্রুত বেড়ে ওঠে। ছয় সাত বছর বয়সে আবার দ্রুততা এসে প্রতিরোধ- শক্তির সৃষ্টি হয়। এগারো বারো বছর পর্যন্ত তাদের বেড়ে ওঠা প্রায় স্থির থাকে। পরে তারা আবার বাড়তে শুরু করে। তাদের দৈহিক বৃদ্ধি ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সে পূর্ণতা প্রাপ্তির পর থেমে যায়। শিশুর বুদ্ধি এবং বুদ্ধিমত্তার বিকাশও সেই অনুপাতে ঘটে। শিশু সাত মাসে বসবে, তের মাসে দাঁড়াবে, দশ বছর বয়সে সুসংহত হয়ে কাজ করবে। শিশুর শৈশব , কৈশোর ও যৌবন পর্যন্ত একাধিক বয়ঃসন্ধিক্ষন আছে। ওই বয়ঃসন্ধিক্ষনগুলিতে ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটে। ফলে ওই সময়ে তাদের ধ্যান বদলে যায়।
শিশু ফোরামের তথ্য অনুযায়ী মা-বাবার ওপর প্রতিশোধ, মুক্তিপণ, যৌন নিপীড়ন, জমি সংক্রান্ত বিরোধসহ সামান্য কারনে ঘটছে শিশু নির্যাতনসহ শিশু মৃত্যু বা হত্যা। মেয়ে শিশুকে ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষনের পর হত্যা, ধর্ষিত হওয়ার পর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে। কখনও বা শিশু অপহরণ হয়। মাঝে মাঝে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক নির্যাতনের কথাও শোনা যায়। গৃহকর্মী নির্যাতন, শিশু পাচার এবং নবজাতক চুরির ঘটনাও ঘটে থাকে।
আইনের গতানুগতিক ফাঁক, দীর্ঘ আইনী প্রক্রিয়া এবং বিচারহীনতার কারনে অনেক সময় অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। ফলে তাদের সাহস ক্রমেই বেড়ে চলে। শিশু নির্যাতন রোধকল্পে আর যাতে কেউ এধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তির সাহস না পায় সেজন্য শিশু নির্যাতনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত। তা নাহলে শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলবে। শিশু নির্যাতন বন্ধে আইনের সঠিক প্রয়োগ ও ব্যবহার করতে হবে। তবেই অপরাধীদের মধ্যে অপরাধ প্রবনতা কমবে, অন্যরাও সাবধান হবে। অপরাধীদের শাস্তি যত দ্রুত কার্যকর সম্ভব হবে, সমাজে এধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ ততই সহজ হবে।
শিশুর ওপর সহিংসতা বন্ধে শিশু আইনের প্রয়োগ, শিশু পর্নোগ্রাফি, পাচার ও শিশুবিবাহ রোধে প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে। আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে শিশু নির্যাতনের হার রোধ করা সম্ভব। শিশুদের অধিকার সুরক্ষায় যত আইন আছে সেগুলি যদি প্রয়োগ করা যায় অবশ্যই ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রতিটি পুলিশ স্টেশনে শিশু আইনের আলোকে শিশুবান্ধব পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে। এখন শিশুবান্ধব কর্মকর্তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। পুলিশের অধীনে ৮ টি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার আছে। সেই ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারগুলোতে শিশুদের সাময়িক আশ্রয়ের ব্যবস্হা, আইনী ও চিকিৎসা দেওয়া এবং কাউন্সেলিং করা হয়। এছাড়া প্রতিটি জেলায় এবং পুলিশ সদর দপ্তরে আছে মনিটরিং সেল। যেখানে নারী ও শিশু মামলাগুলো বিশেষ গুরুত্ব সহকারে মনিটরিং করা হয়। শিশু প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৭, ১৮, ২৭, ২৮ এবং ৩৪ এ সুনির্দিষ্টভাবে বিধান প্রবর্তিত রয়েছে।
কন্যা শিশুদের নিরাপদে বেড়ে ওঠার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। কন্যা শিশুদের প্রতি বৈষম্য ঘোচাতে হবে। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য কন্যা শিশুদের এগিয়ে নিতে হবে। তাদেরকে সুশিক্ষার পাশাপাশি যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিশু নির্যাতনকারীদের সনাক্ত, প্রতিরোধ ও বিচারের দাবিতে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকেও অব্যাহতভাবে সোচ্চার থাকতে হবে। আসুন শিশুদের কাছে নিজেদেরকে শিশু বান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণকে শিশু বান্ধব হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করি। শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি তাদের সুরক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সমাজের জনগনকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি শিশুরা যেভাবে বেড়ে উঠতে চায়, সেভাবেই বিকাশের পথ করে দিতে হবে। আসুন আমরা সবাই মিলে সঠিকভাবে সেই দায়িত্ব পালন করে শিশু বান্ধব বাংলাদেশ গড়ে তুলি।
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা।