শিশুতোষ গল্প
শিরোনাম : প্রতিদান
লেখায় : আব্দুস সালাম
আশির দশকের একটি ঘটনা। জীবন তখন এতো আধুনিক ছিলো না । হাতে হাতে মোবাইল ফোন দেখা যেতো না ।
রফিক আর বেলাল পরস্পর দুই সহোদর ভাই । ওরা উভয়ে বেশ মেধাবী ছিল । রফিক নবম আর বেলাল সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র । উভয়েই সরকারী বৃত্তি প্রাপ্ত ।
কিন্তুু দুঃখের বিষয় হলো ওরা এতিম । বছর দুয়েক আগে ওদের প্রাণ প্রিয় বাবা রাস্তা পাড়াপাড়ের সময় চলন্ত এক গাড়ীর সাথে প্রচন্ড ধাক্কা খেয়ে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্হায় মারা যান ।
সংসারের হাল ধরার মত কেউ না থাকায় ওরা ভীষন অসহায় হয়ে পড়ে । বাবার অভাবে ওরা দিশেহারা হয়ে যায় । ওদের মা আমেনা বেগম সব থেকে বেশী শোকগ্রস্তা হয়ে পড়েন । স্বামীর অকাল মৃত্যুতে জীবনে আসে ছন্দ পতন ।
চোয়াল শক্ত করে বাচ্চাদের নিয়ে শুরু করেন জীবনের লড়াই । উচ্চ মাধ্যমিক পাশ হওয়ায় পার্শ্ববর্তী বাচ্চাদের পড়াতে লাগলেন । সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন খলিফার কাজ । যাতে সন্তানদের লেখা পড়ায় বিঘ্ন না ঘটে । একই সাথে বাড়ীর আঙ্গিনায় হাঁস মুরগী পালনে সচেষ্ট হন ।
সন্তান দুটি মায়ের ভীষন ভক্ত এবং বাধ্যগত । ওরাও মাকে সাধ্যমত সাহায্য করে ।
ওদের বাবা বেঁচে থাকতে খুব বন্ধু সুলভ ছিলেন । আর বুঝাতেন পিতা মাতার পায়ের নীচে সন্তানের বেহেস্ত । কখনো তাদের অবাধ্য হওয়া যাবে না ।
তা হলে মরার পর বেহেস্ত পাওয়া যাবে না ।
রফিক বেলাল বাবার সেই কথাতেই বিশ্বাসী হয়ে বড় হচ্ছিল । ওদের বাবা ছিলো পোষাক কর্মী । হাইওয়ের ধারেই
ওদের টিন সেডের ছোট্ট একটি বাড়ী । ওরা কখনো কল্পনাও করেনি আল্লাহতালা ওদের এমন পরীক্ষায় ফেলবেন ।
পরিবার টি ভীষন ধার্মিক । তাই ভাগ্যে তাদের ভীষন আস্হা ।
মা আমেনা বেগম বিশ্বাস করেন আল্লাহ তার বান্দা কে সব দিক থেকে বঞ্চিত করেন না । এক দিক কেড়ে নিলে অন্য দিক টা ঠিকই গড়ে দেন ।
সন্তানদের বিষাদগ্রস্ত থেকে রক্ষায় সর্বদা আশার বাণী শোনাতেন যেন তারা হতাশাগ্রস্ত
হয়ে লেখাপড়া থেকে ছিটকে না পড়ে । মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ রোজায় অভ্যস্ত করে গড়ে তুলেন । আর পিতার জন্য বেশী বেশী রাব্বের হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি ছাগিড়া পাঠ করতে বলতেন ।
বর্ষা ঋতুতে একদিন রাতে সন্তানদের খাইয়ে ঘুমাতে পাঠালেন । আর তিনি সেলাইয়ের কাজ শেষ করতে করতে অনেক রাত জেগে রইলেন । ভাবলেন তাহাজ্জুদ নামাজ টা পড়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে ফজর শেষ করে তিনিও ঘুমাতে যাবেন । আর তখনই শুরু হলো প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি ।
মাঝে মাঝে বজ্রপাতের শব্দও শোনা যাচ্ছিলো । বাচ্চারা গভীর ঘুমে অচেতন । টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ বেড়েই চলছে । আর এ অবস্হায় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলো । মোমবাতির আলো জ্বালিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ শেষ করা মাত্র দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলেন । বৃষ্টির চাপও একটু কমে এসেছে । থেমে থেমে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ আসতেই লাগলো ।
মনে মনে দৃঢ় চিত্তের মানুষটি একটু ভয়ও পেলেন । এই ভোর রাতে কে হতে পারে এই ভেবে ।
আমেনা বেগম মোমবাতির আলোতে জানালা দিয়ে দেখলেন সাদা দাঁড়িওয়ালা এক বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছে ।
এতো রাতে কি চাই জানতে চাইলে আগুন্তুুক লোকটি বলে আমার গাড়ীটি রাস্তায় নষ্ট হয়ে গেছে । চট্রগ্রাম থেকে ঢাকা যাচ্ছিলাম । ওয়াশ রুমের দরকার হয়েছে আর পিপাসাও পেয়েছে । দয়া করে কি আমাকে একটু সাহায্য করবেন । এতো রাতে অপরিচিত অচেনা লোক কে ঘরে নিতে আমেনা বেগম অস্বস্তি বোধ করলেন ।
ইতিমধ্যে ঝড় বৃষ্টিও থেমে গেছে । ভাবলেন লোকটির হয়তো প্রকৃতির ডাক পেয়েছে । তাকে কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না ।
তিনি ছেলেদের ডেকে তুললেন । ছেলেরা ঘুম থেকে ওঠা মাত্র বিদ্যুৎ চলে এলো । আমেনা বেগম আল্লাহর নিকট শুকরিয়া জানালেন ঘরে আলো আসাতে । ছেলেরা ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে জানতে চাইলো কি হয়েছে মা । ফজরের আজান কি হয়ে গেছে ? আমেনা বেগম
ভদ্র লোকটি কে দেখিয়ে বলে ওনি ওয়াশ রুমে যাবেন । তোমরা তাকে সাহায্য করো ।
ওনি কে মা ? এতো রাতে কোত্থেকে এলেন ? রফিকের প্রশ্নে মা জানালেন ওনি বিপদে পেড়েছেন । ওনার গাড়ী রাস্তায় নষ্ট হয়ে আছে । ওনার পিপাসা পেয়েছে । বেলাল জানতে চায় চাচা আপনার পরিচয় কি ?
আমি একজন শিল্পপতি । আমার নাম বাহার । মা ছেলেদের বাঁধা দিয়ে বলেন ভদ্র লোকটি কে ঘরে আনো এবং ওয়াশ রুম দেখিয়ে দাও ।
বাহার সাহেব ঘরে প্রবেশ করলেন এবং দ্রুত ওয়াশ রুমে চলে গেলেন ।
ঠিক ঐ সময় মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসতে লাগলো । আজান শুনে মা ছেলেদের নামাজের প্রস্তুুতি নিতে বললেন ।
বাহার সাহেবও ওয়াশ রুম থেকে অজু করে বের হলেন ।
সেও জায়নামাজ চাইলেন ।
রফিক বললো চাচা আসুন আমরা একত্রে নামাজ পড়ি ।
এ কথা শুনে বাহার সাহেব ভীষন খুশী হলেন । বেলাল নতুন চাচার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে এলেন । বাহার সাহেব পানি পান করে রফিক ও বেলাল কে নিয়ে নিজে ঈমামতি করে ফজরের নামাজ শেষ করলেন ।
নামাজ শেষে বাহার সাহেব রফিক কে তার বাবা কোথায় জানতে চাইলেন । রফিকের জবান থেকে তার বাবার মৃত্যুর সব কাহিনী শুনে ভিতরে ভিতরে
চমকে গেলেন ।
তার স্মৃতিপটে সব ভেসে উঠলো । ঠিক দু বছর আগে এই হাইওয়েতে তার গাড়ীর সাথে এক লোক আঘাত প্রাপ্ত হয় । ড্রাইভার দ্রুত গাড়ী নিয়ে রাতের আঁধারে তাকে নিয়ে মিশে যায় । তাহলে এই সেই লোকের পরিবার ।
বাহার সাহেব আশ্চর্য হলেন এবং মনে মনে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইলেন । তার দু চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো ।
পর্দার আড়াল থেকে আমেনা বেগম সব দেখলেন । বাহার সাহেব রফিক আর বেলালের লেখা পড়ার খোঁজ খবর নিলেন । সব শুনে বাহার সাহেব ভাবলেন আরে এরা যে গোবরে পদ্ম ফুল । এই ফুলের যত্ন করে প্রায়শ্চিত্ত করা দরকার ।
রফিক কে ডেকে তার মা চা বিস্কুট পাঠালেন । ছেলেদের নিয়ে চা খেয়ে ওঠার সময় বাহার সাহেব রফিক আর বেলালের হাতে দশ হাজার টাকা দিতে চাইলেন । ভাইদ্বয় সেই টাকা গ্রহনে অপারগতা জানালো । তাদের মাও অস্বীকৃতি জানালো । অনেক জোড়াজুড়ি এবং বুঝিয়ে বাহার সাহেব টাকা দিতে সক্ষম হলেন । শুধু তাই নয় । দুই ভাইর লেখাপড়ার সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন ।
আমেনা বেগম ভাবলেন মধ্য রাতে আল্লাহ তার ঘরে রহমতের ফেরেস্তা পাঠিয়েছেন । বাহার সাহেব তার প্রতি ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বের হওয়ার অনুমতি চাইলেন ।
আমেনা বেগম ছেলেদের পাঠালেন মেহমান কে এগিয়ে দেওয়ার জন্য । গাড়ীর নিকট সবাই এসে দেখে ড্রাইভার ভিতরে ঘুমাচ্ছে ।
বাহার সাহেব ড্রাইভার কে প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন গাড়ী ঠিক হয়েছে কিনা । জ্বি স্যার ঠিক হয়েছে । ড্রাইভারের কথায় বাহার সাহেব খুশী হলেন এবং আল্লাহর নিকট শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন ।
রফিক বেলাল কে বুকে জড়িয়ে বাহার সাহেব বিদায় নিলেন ।
ওরাও যথারীতি বাড়িতে ফিরে এলো ।
এমনিভাবে বাহার সাহেবের সাথে রফিক ও বেলালদের একটা আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠলো ।
বাহার সাহেবের সহায়তায় রফিকদের টিন সেড ঘরটি একতলা বিল্ডিং এ রূপান্তর হলো । আর ওরা ক্রমান্বয়ে ভালো রেজাল্টে লেখা পড়া করতে লাগলো ।
হঠাৎ একদিন বাহার সাহেব তার স্ত্রী কে নিয়ে আমেনা বেগমের বাড়ীতে উপস্হিত হলেন । আমেনা বেগম উৎফুল্ল চিত্তে মেহমান কে বরন করলেন এবং সাধ্যমত আপ্যায়ন করলেন ।
বাহার সাহেবের স্ত্রী খুব মুগ্ধ হলেন । দুপুরের খাবার পর বিদায় বেলায় বাহার সাহেবের স্ত্রী সব কাহিনী খুলে বললেন । এবং রফিকের বাবার মৃত্যুর জন্য ক্ষমা চাইলেন ।
বিস্তরীত জেনে আমেনা বেগম চোখের পানি ফেলে বললেন সবই আল্লাহ ইচ্ছা । আপনাদের কোন দোষ নেই । রফিকের বাবার মৃত্যু আল্লাহ হয়তো এই ভাবেই নির্ধারন করে রেখছিলেন । আপনারাতো কম করছেন না । কেউ কি এভাবে প্রায়শ্চিত করে । আমার স্বামী হয়তো ঐদিন দেখে শুনে রাস্তা পাড় হননি । তারও গাফিলতি
ছিল । তাই সন্তানদের বলি সর্বদা সাবধানে রাস্তা পাড় হতে । আমেনা বেগমের কথায় বাহার সাহেবের স্ত্রী জুলেখা বেগম যারপর নাই খুশী হলেন।
পরস্পরের প্রতি পরস্পর কৃতজ্ঞতা জানালেন এবং পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বিদায় নিলেন ।
আমেনা বেগম ভাবলেন আল্লাহ এমনিভাবেই ধৈর্যের প্রতিদান দিয়ে থাকেন । এক দিক কেড়ে নিলে আরেক দিক ঠিকই ফিরিয়ে দেন ।
আলহামদুলিল্লাহ বলে ছেলেদের নিয়ে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন আল্লাহর দরবারে । আর ছেলেদের প্রতি নির্দেশ রাখলেন উপকারীর উপকার স্বীকার করে কৃতজ্ঞ থাকতে ।
শিশুতোষ গল্প
শিরোনাম : প্রতিদান
লেখায় : আব্দুস সালাম
আশির দশকের একটি ঘটনা। জীবন তখন এতো আধুনিক ছিলো না । হাতে হাতে মোবাইল ফোন দেখা যেতো না ।
রফিক আর বেলাল পরস্পর দুই সহোদর ভাই । ওরা উভয়ে বেশ মেধাবী ছিল । রফিক নবম আর বেলাল সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র । উভয়েই সরকারী বৃত্তি প্রাপ্ত ।
কিন্তুু দুঃখের বিষয় হলো ওরা এতিম । বছর দুয়েক আগে ওদের প্রাণ প্রিয় বাবা রাস্তা পাড়াপাড়ের সময় চলন্ত এক গাড়ীর সাথে প্রচন্ড ধাক্কা খেয়ে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্হায় মারা যান ।
সংসারের হাল ধরার মত কেউ না থাকায় ওরা ভীষন অসহায় হয়ে পড়ে । বাবার অভাবে ওরা দিশেহারা হয়ে যায় । ওদের মা আমেনা বেগম সব থেকে বেশী শোকগ্রস্তা হয়ে পড়েন । স্বামীর অকাল মৃত্যুতে জীবনে আসে ছন্দ পতন ।
চোয়াল শক্ত করে বাচ্চাদের নিয়ে শুরু করেন জীবনের লড়াই । উচ্চ মাধ্যমিক পাশ হওয়ায় পার্শ্ববর্তী বাচ্চাদের পড়াতে লাগলেন । সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন খলিফার কাজ । যাতে সন্তানদের লেখা পড়ায় বিঘ্ন না ঘটে । একই সাথে বাড়ীর আঙ্গিনায় হাঁস মুরগী পালনে সচেষ্ট হন ।
সন্তান দুটি মায়ের ভীষন ভক্ত এবং বাধ্যগত । ওরাও মাকে সাধ্যমত সাহায্য করে ।
ওদের বাবা বেঁচে থাকতে খুব বন্ধু সুলভ ছিলেন । আর বুঝাতেন পিতা মাতার পায়ের নীচে সন্তানের বেহেস্ত । কখনো তাদের অবাধ্য হওয়া যাবে না ।
তা হলে মরার পর বেহেস্ত পাওয়া যাবে না ।
রফিক বেলাল বাবার সেই কথাতেই বিশ্বাসী হয়ে বড় হচ্ছিল । ওদের বাবা ছিলো পোষাক কর্মী । হাইওয়ের ধারেই
ওদের টিন সেডের ছোট্ট একটি বাড়ী । ওরা কখনো কল্পনাও করেনি আল্লাহতালা ওদের এমন পরীক্ষায় ফেলবেন ।
পরিবার টি ভীষন ধার্মিক । তাই ভাগ্যে তাদের ভীষন আস্হা ।
মা আমেনা বেগম বিশ্বাস করেন আল্লাহ তার বান্দা কে সব দিক থেকে বঞ্চিত করেন না । এক দিক কেড়ে নিলে অন্য দিক টা ঠিকই গড়ে দেন ।
সন্তানদের বিষাদগ্রস্ত থেকে রক্ষায় সর্বদা আশার বাণী শোনাতেন যেন তারা হতাশাগ্রস্ত
হয়ে লেখাপড়া থেকে ছিটকে না পড়ে । মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ রোজায় অভ্যস্ত করে গড়ে তুলেন । আর পিতার জন্য বেশী বেশী রাব্বের হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি ছাগিড়া পাঠ করতে বলতেন ।
বর্ষা ঋতুতে একদিন রাতে সন্তানদের খাইয়ে ঘুমাতে পাঠালেন । আর তিনি সেলাইয়ের কাজ শেষ করতে করতে অনেক রাত জেগে রইলেন । ভাবলেন তাহাজ্জুদ নামাজ টা পড়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে ফজর শেষ করে তিনিও ঘুমাতে যাবেন । আর তখনই শুরু হলো প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি ।
মাঝে মাঝে বজ্রপাতের শব্দও শোনা যাচ্ছিলো । বাচ্চারা গভীর ঘুমে অচেতন । টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ বেড়েই চলছে । আর এ অবস্হায় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলো । মোমবাতির আলো জ্বালিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ শেষ করা মাত্র দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলেন । বৃষ্টির চাপও একটু কমে এসেছে । থেমে থেমে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ আসতেই লাগলো ।
মনে মনে দৃঢ় চিত্তের মানুষটি একটু ভয়ও পেলেন । এই ভোর রাতে কে হতে পারে এই ভেবে ।
আমেনা বেগম মোমবাতির আলোতে জানালা দিয়ে দেখলেন সাদা দাঁড়িওয়ালা এক বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছে ।
এতো রাতে কি চাই জানতে চাইলে আগুন্তুুক লোকটি বলে আমার গাড়ীটি রাস্তায় নষ্ট হয়ে গেছে । চট্রগ্রাম থেকে ঢাকা যাচ্ছিলাম । ওয়াশ রুমের দরকার হয়েছে আর পিপাসাও পেয়েছে । দয়া করে কি আমাকে একটু সাহায্য করবেন । এতো রাতে অপরিচিত অচেনা লোক কে ঘরে নিতে আমেনা বেগম অস্বস্তি বোধ করলেন ।
ইতিমধ্যে ঝড় বৃষ্টিও থেমে গেছে । ভাবলেন লোকটির হয়তো প্রকৃতির ডাক পেয়েছে । তাকে কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না ।
তিনি ছেলেদের ডেকে তুললেন । ছেলেরা ঘুম থেকে ওঠা মাত্র বিদ্যুৎ চলে এলো । আমেনা বেগম আল্লাহর নিকট শুকরিয়া জানালেন ঘরে আলো আসাতে । ছেলেরা ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে জানতে চাইলো কি হয়েছে মা । ফজরের আজান কি হয়ে গেছে ? আমেনা বেগম
ভদ্র লোকটি কে দেখিয়ে বলে ওনি ওয়াশ রুমে যাবেন । তোমরা তাকে সাহায্য করো ।
ওনি কে মা ? এতো রাতে কোত্থেকে এলেন ? রফিকের প্রশ্নে মা জানালেন ওনি বিপদে পেড়েছেন । ওনার গাড়ী রাস্তায় নষ্ট হয়ে আছে । ওনার পিপাসা পেয়েছে । বেলাল জানতে চায় চাচা আপনার পরিচয় কি ?
আমি একজন শিল্পপতি । আমার নাম বাহার । মা ছেলেদের বাঁধা দিয়ে বলেন ভদ্র লোকটি কে ঘরে আনো এবং ওয়াশ রুম দেখিয়ে দাও ।
বাহার সাহেব ঘরে প্রবেশ করলেন এবং দ্রুত ওয়াশ রুমে চলে গেলেন ।
ঠিক ঐ সময় মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসতে লাগলো । আজান শুনে মা ছেলেদের নামাজের প্রস্তুুতি নিতে বললেন ।
বাহার সাহেবও ওয়াশ রুম থেকে অজু করে বের হলেন ।
সেও জায়নামাজ চাইলেন ।
রফিক বললো চাচা আসুন আমরা একত্রে নামাজ পড়ি ।
এ কথা শুনে বাহার সাহেব ভীষন খুশী হলেন । বেলাল নতুন চাচার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে এলেন । বাহার সাহেব পানি পান করে রফিক ও বেলাল কে নিয়ে নিজে ঈমামতি করে ফজরের নামাজ শেষ করলেন ।
নামাজ শেষে বাহার সাহেব রফিক কে তার বাবা কোথায় জানতে চাইলেন । রফিকের জবান থেকে তার বাবার মৃত্যুর সব কাহিনী শুনে ভিতরে ভিতরে
চমকে গেলেন ।
তার স্মৃতিপটে সব ভেসে উঠলো । ঠিক দু বছর আগে এই হাইওয়েতে তার গাড়ীর সাথে এক লোক আঘাত প্রাপ্ত হয় । ড্রাইভার দ্রুত গাড়ী নিয়ে রাতের আঁধারে তাকে নিয়ে মিশে যায় । তাহলে এই সেই লোকের পরিবার ।
বাহার সাহেব আশ্চর্য হলেন এবং মনে মনে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইলেন । তার দু চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো ।
পর্দার আড়াল থেকে আমেনা বেগম সব দেখলেন । বাহার সাহেব রফিক আর বেলালের লেখা পড়ার খোঁজ খবর নিলেন । সব শুনে বাহার সাহেব ভাবলেন আরে এরা যে গোবরে পদ্ম ফুল । এই ফুলের যত্ন করে প্রায়শ্চিত্ত করা দরকার ।
রফিক কে ডেকে তার মা চা বিস্কুট পাঠালেন । ছেলেদের নিয়ে চা খেয়ে ওঠার সময় বাহার সাহেব রফিক আর বেলালের হাতে দশ হাজার টাকা দিতে চাইলেন । ভাইদ্বয় সেই টাকা গ্রহনে অপারগতা জানালো । তাদের মাও অস্বীকৃতি জানালো । অনেক জোড়াজুড়ি এবং বুঝিয়ে বাহার সাহেব টাকা দিতে সক্ষম হলেন । শুধু তাই নয় । দুই ভাইর লেখাপড়ার সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন ।
আমেনা বেগম ভাবলেন মধ্য রাতে আল্লাহ তার ঘরে রহমতের ফেরেস্তা পাঠিয়েছেন । বাহার সাহেব তার প্রতি ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বের হওয়ার অনুমতি চাইলেন ।
আমেনা বেগম ছেলেদের পাঠালেন মেহমান কে এগিয়ে দেওয়ার জন্য । গাড়ীর নিকট সবাই এসে দেখে ড্রাইভার ভিতরে ঘুমাচ্ছে ।
বাহার সাহেব ড্রাইভার কে প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন গাড়ী ঠিক হয়েছে কিনা । জ্বি স্যার ঠিক হয়েছে । ড্রাইভারের কথায় বাহার সাহেব খুশী হলেন এবং আল্লাহর নিকট শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন ।
রফিক বেলাল কে বুকে জড়িয়ে বাহার সাহেব বিদায় নিলেন ।
ওরাও যথারীতি বাড়িতে ফিরে এলো ।
এমনিভাবে বাহার সাহেবের সাথে রফিক ও বেলালদের একটা আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠলো ।
বাহার সাহেবের সহায়তায় রফিকদের টিন সেড ঘরটি একতলা বিল্ডিং এ রূপান্তর হলো । আর ওরা ক্রমান্বয়ে ভালো রেজাল্টে লেখা পড়া করতে লাগলো ।
হঠাৎ একদিন বাহার সাহেব তার স্ত্রী কে নিয়ে আমেনা বেগমের বাড়ীতে উপস্হিত হলেন । আমেনা বেগম উৎফুল্ল চিত্তে মেহমান কে বরন করলেন এবং সাধ্যমত আপ্যায়ন করলেন ।
বাহার সাহেবের স্ত্রী খুব মুগ্ধ হলেন । দুপুরের খাবার পর বিদায় বেলায় বাহার সাহেবের স্ত্রী সব কাহিনী খুলে বললেন । এবং রফিকের বাবার মৃত্যুর জন্য ক্ষমা চাইলেন ।
বিস্তরীত জেনে আমেনা বেগম চোখের পানি ফেলে বললেন সবই আল্লাহ ইচ্ছা । আপনাদের কোন দোষ নেই । রফিকের বাবার মৃত্যু আল্লাহ হয়তো এই ভাবেই নির্ধারন করে রেখছিলেন । আপনারাতো কম করছেন না । কেউ কি এভাবে প্রায়শ্চিত করে । আমার স্বামী হয়তো ঐদিন দেখে শুনে রাস্তা পাড় হননি । তারও গাফিলতি
ছিল । তাই সন্তানদের বলি সর্বদা সাবধানে রাস্তা পাড় হতে । আমেনা বেগমের কথায় বাহার সাহেবের স্ত্রী জুলেখা বেগম যারপর নাই খুশী হলেন।
পরস্পরের প্রতি পরস্পর কৃতজ্ঞতা জানালেন এবং পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বিদায় নিলেন ।
আমেনা বেগম ভাবলেন আল্লাহ এমনিভাবেই ধৈর্যের প্রতিদান দিয়ে থাকেন । এক দিক কেড়ে নিলে আরেক দিক ঠিকই ফিরিয়ে দেন ।
আলহামদুলিল্লাহ বলে ছেলেদের নিয়ে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন আল্লাহর দরবারে । আর ছেলেদের প্রতি নির্দেশ রাখলেন উপকারীর উপকার স্বীকার করে কৃতজ্ঞ থাকতে ।