শব্দ সৈনিকের করুণ অপেক্ষা
দিলু রোকিবা
১০জুলাই,১৯৭১ সন।
বর্ষায় সব কিছু পানিতে ভিজে গেছে,
কিন্তু জীবন থেমে থাকার না।
মনে মনে বুঝতে পারছে কমল সে সত্যিকার অর্থেই একজন প্রতিবাদী লড়াকু সৈনিক হয়ে উঠছে মনের অজান্তেই সীমান্তের ওপারে পৌঁছানোর ঠিক শেষ মুহূর্তে কমল কেন যেন ফিরে আসতে চাইলো!! মনে কু ডেকে উঠছে কেন জানি!
হঠাৎ মমতাময়ী মার আকুতি ভরা অনুরোধ এই পথে আসার বাঁধা ছিল ঐ মুহূর্তে।
বড়ো আপুর শক্ত দুটি হাত দিয়ে কমলের দূটি হাত ধরে রেখেছিল,তুই যাসনে কমল।
এমনিতেই বাবাকে হারানোর আতঙ্ক ও ভয় ওকে প্রতিনিয়ত তাড়িত করছে।
এই অদৃশ্য ভয়কে কমল আর বাড়িয়ে তুলতে চায়না কখনোই।
একমাত্র ছোট্ট বোন ও ভাইটির শূন্য হাহাকার দৃষ্টিও কমলকে রুখতে পারলোনা।
সব বন্ধন ছিঁড়ে সে যশোরের চৌকরগাছা উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি গ্রামে শুরু হলো কমলের যুদ্ধ জীবন।
যার নাম শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।
কমলের বাবাও একটি বাসনা ও আকাঙ্ক্ষা মেটানোর উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে স্বাধীনতার পথে পা বাড়িয়েছিল।
বাবাও নিশ্চয় ওর মতোই এক তৃপ্তিকর নিঃশ্বাস ফেলছে।
–কিন্তু বাবা তুমি এখন কোথায় আছো?
দিন- রাত যুদ্ধের রণকৌশলের সাথে সাথে তার আর একটি মনোযুদ্ধ চলতো, আর তা হলো বাবাকে খোঁজার।
কমল যেখানেই গেছে ,সেখানেই তার বাবাকে খুঁজেছে পই পই করে•••কিন্তু পাইনি ,এমনকি আজো না••••।
কমল একজন শ্রেষ্ট শব্দ সৈনিক। প্রতি দিন তার কলমে বেরিয়ে আসে অগ্নিঝরা ,ক্ষুরধার রাজনৈতিক, সামাজিক ভাষা,বর্ণ।
সাংবাদিকতা পেশা এক ঝুঁকিপূর্ণ পেশা জেনেও কমল চঞ্চলময় হয়ে ঐ চোখে মৃত্যুভয়হীন এই জীবনে বাবাকেই খুঁজে বেড়াতো!
— পট পরিবর্তন
৩০ নভেম্বর ১৯৮০ সনের সকাল সাড়ে আটটা।
হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠলো।
হ্যালো, আস সালামু আলায় কুম, আপনি কি কমল সাহেব?
জ্বী কেন?
আপনি কে?
আরে চারটি নবজাতকের লাশ পাওয়া গেছে আগারগাঁ ডাস্টবিনে।
টেবিলে নাশতা ফেলে ঝটপট রেডি হয়ে তখুনি পৌঁছে গেল বাইক চালিয়ে যেখানে লাশগুলিকে ঘিরে শত শত মানুষ ভীড় করেছে।
কমল ভীড় ঠেলে কাঁধে ক্যামেরা, ব্যাগ নিয়ে ডাস্টবিনের কাছে যেতেই সে দেখলো ,কতোগুলো সরু কোমল হাত। লাল- নীল স্পঞ্জের স্যান্ডেল পড়া তুলতুলে পা পাশাপাশি জড়িয়ে আছে।
মুখগুলো ময়লার সাথে মেখে বিকৃত অবস্থায় আছে।
লাশের তীব্র গন্ধ নাকে এলো কমলের। এতোটা তীব্র যে সে এতক্ষণ টের ই পায়নি।
বহু বছর ধরে পেশার স্বার্থে ওকে কতো,লাশের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে,এরকম কখনোই মনে হয়নি।
মুহূর্তেই মনে হলো এই ঘটনার ভয়াবহতা জন যুদ্ধের চেয়েও কি অধিক কিছু?
এই আতঙ্ক কি বাবাকে না পাওয়ার চেয়ে বেশি?
হ্যালুসুলেশন হচ্ছে না কি!! কেননা ঐ লাশগুলোর বিকৃত চেহারার মধ্যে কমল তার বাবার অবয়ব খোঁজার নিস্ফল চেষ্টা করলো।
হাজারো ট্রাজেডির মাঝে সে তার জন্মদাতা বাবাকে ভুলতেই পারছেনা!
— না থাক আর বাবাকে বৃথা খুঁজে লাভ নেই, আমার এখন এই লাশগুলিকে পৌঁছে দিতে হবে আপনজনদের কাছে।
যা ভাবা তাই হলো;
স্বজনদের কান্নার রোল দেখে ফিরে আসার সময় এক বুক চাপা কান্না অনুভব করলো কমল।
কিন্তু কার জন্য কাঁদবে সে? তার বাবার লাশ উদ্ধার করা যাইনি এতোটা বছর পার হয়ে গেছে—উনি বেঁচে আছেন কি না এই পৃথিবীর বুকে ,সেই আশঙ্কা ও আকাঙ্খা কমলকে আচ্ছন্ন করে তুলেছে,
—- কমল কেবল স্মৃতির মলাটে বদ্ধ হওয়া শব্দগুলিকে অপেক্ষার এই প্রহরে আর কতোকাল বন্দী রাখবে?
এই শব্দ সৈনিকের করুণ অপেক্ষা আর কখনো