স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে শিক্ষার্থীদের গবেষণাপত্র উপস্থাপন করতে হয়। গঠন ও প্রক্রিয়া ভেদে গবেষণাপত্রের ভিন্নতা থাকলেও সর্বজনস্বীকৃত কাঠামোভিত্তিক গবেষণাপত্রের বৈশিষ্ট্য জানিয়েছেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশন্যাল ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক সুব্রত ব্যানার্জী
গবেষণাপত্রের গঠন
প্রথম পাতা (শিরোনাম)
এই পাতায় গবেষণাপত্রের শিরোনাম (টাইটেল), উপ-শিরোনাম (সাবটাইটেল, যদি প্রযোজ্য হয়), গবেষকের নাম, শিক্ষার্থীর আইডি নম্বর, অ্যাকাডেমিক প্রোগ্রাম বা বিভাগের নাম, জমা দেওয়ার তারিখ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থাকে।
দ্বিতীয় পাতা (অনুমতিপত্র)
এই পাতায় সুপারভাইজার বা তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষকের স্বাক্ষর থাকে।
তৃতীয় পাতা (কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন)
এই পাতায় গবেষণায় সহযোগিতাকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো হয়। যেমন : সুপারভাইজার, গবেষণার সহযোগী, তথ্য প্রদানকারী, গবেষণার ফান্ডদাতা প্রভৃতি সহযোগীকে কৃতজ্ঞতা জানানো হয়। বিশেষ করে সুপারভাইজারদের নির্দেশনা ও সহযোগিতার ব্যাপারে ভালোভাবে
কৃতজ্ঞতা জানানো প্রয়োজন।
চতুর্থ পাতা (মূলভাব বা সারাংশ)
এই পাতায় গবেষণার সার তুলে ধরতে হয়। এর শুরুতে অবশ্যই ‘ABSTRACT’ শিরোনাম থাকবে। সারাংশে গবেষণাটির পটভূমি বা গুরুত্ব, গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে এক-দুই লাইন, ফলাফলের সারসংক্ষেপ ও গবেষণায় উপনীত সিদ্ধান্তগুলোর একটি সারাংশ থাকবে। সমগ্র ‘ABSTRACT’টি হবে অনধিক ১৫০-২৫০ শব্দের মধ্যে।
প্রধান শব্দাবলি (Keywords) ‘ABSTRACT’ এর শেষে কি-ওয়ার্ডের (গবেষণার প্রধান প্রধান শব্দ) একটি তালিকা দিতে হবে, যা চার থেকে সাত শব্দের মধ্যে হওয়া বাঞ্ছনীয়।
পঞ্চম পাতা (সূচিপত্র)
সূচিপত্রে থিসিসের সব অধ্যায়ের শিরোনাম ও পাতার নম্বর ক্রমানুসারে দিতে হয়। এটি শেষে তৈরি করে যুক্ত করতে হয়।
ষষ্ঠ পাতা (চার্ট ও টেবিলের তালিকা)
যদি থিসিসে পরিসংখ্যান, চার্ট ও টেবিল থাকে, তা এই অংশে শিরোনামসহ ও পাতার নম্বরসহ ক্রমানুসারে উল্লেখ করতে হবে। এটি সূচিপত্রের বর্ধিত অংশ।
অধ্যায় এক (সূচনা অধ্যায়)
এই অধ্যায়ে পৃথক শিরোনামে বা পৃথক শিরোনাম বাদেই গবেষণার পটভূমি, বিবৃতি, তাৎপর্য, গবেষণা প্রশ্ন এবং উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে একটি ধারণা দেওয়া হয়। তবে চাইলে গবেষণা প্রশ্ন এবং উদ্দেশ্য সূচনা অধ্যায়ে উল্লেখ না করে গবেষণা পদ্ধতি অধ্যায়েও উল্লেখ করা যায়।
সূচনা অধ্যায়ের বিভিন্ন অংশ হলো
সূচনা : গবেষণার বিষয় সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্র কেন প্রাসঙ্গিক বা গুরুত্বপূর্ণ তা লিখতে হয়। এই গবেষণা কীভাবে উল্লেখযোগ্য নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে তা উল্লেখ করা ভালো। সূচনাতে গবেষণার সমস্যার পটভূমি, লিখিত বক্তব্যের সারাংশ নিয়েও আলোচনা করতে পারেন।
স্টেটমেন্ট অব দ্য প্রবলেম : স্টেটমেন্ট অব দ্য প্রবলেমের আকার হবে সংক্ষিপ্ত কিন্তু তবে টু দ্য পয়েন্ট। এখানে গবেষক ব্যাখ্যা করবেন, কেন তিনি এই সমস্যার ব্যাপারে আগ্রহী হলেন, গবেষণায় তিনি কী প্রস্তাবনা করেছেন, প্রধান ইস্যু হিসেবে কী পেয়েছেন। এখান থেকে যেন ধারণা পাওয়া যায়, গবেষক গবেষণায় কী সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন।
তাৎপর্য : এই অংশে গবেষণার তাৎপর্য ও গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। এখানে গবেষক, কেন তার গবেষণার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কেন পাঠকদের এই সমস্যাটি সম্পর্কে জানা উচিত, গবেষণাটির সম্ভাব্য গুরুত্ব কী, কীভাবে এটি বিদ্যমান জ্ঞান ও কাজের ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারেÑ প্রভৃতি সম্পর্কে সংক্ষেপে জানাবেন।
গবেষণা প্রশ্ন : সম্পূর্ণ গবেষণা পরিচালনা করার জন্য কিছু নির্দিষ্ট গবেষণা প্রশ্ন প্রণয়ন করতে হয়। যার অন্বেষণের মাধ্যমে গবেষণাটি লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়।
নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য : গবেষণা প্রশ্নগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়। গবেষণার মাধ্যমে গবেষণা প্রশ্নের সমাধান খুঁজে পাওয়ায় গবেষণা লক্ষ্য। এই অংশে গবেষণার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য পয়েন্ট আকারে লিখতে হবে। বর্ণনামূলকভাবে লিখলেও সংক্ষেপে লিখতে হবে।
দ্বিতীয় অধ্যায় (লিখিত বক্তব্য পর্যালোচনা)
লিখিত বক্তব্য পর্যালোচনা অংশে গবেষণার ওই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে গবেষকের সক্ষমতাকে নির্দেশ করে। ওই ক্ষেত্রে কী কী কাজ হয়েছে, গবেষক কোন কোন অভাব অনুভব করার ফলে এই নির্দিষ্ট বিষয়ে গবেষক গবেষণা করার সিদ্ধান্ত নিলেন, এ বিষয়ে কী কী গবেষণা আছে, তাদের গুরুত্ব কী, গবেষকের গবেষণা পরিচালনা ও নির্বাচিত পদ্ধতির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক গবেষণাপত্রের গুরুত্ব কী, গবেষকের ভাবনার সঙ্গে অন্য গবেষকদের গবেষণাপত্রের মিল-অমিল প্রভৃতি নির্দেশ করা এবং তার গবেষণা এই পার্থক্য কীভাবে পূরণ করবে গবেষক তা এখানে বিস্তারিত উল্লেখ করেন।
তৃতীয় অধ্যায় (তাত্ত্বিক কাঠামো)
যে একবা একাধিক তত্ত্বের আলোকে গবেষণাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে তা এই অংশে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে হয়। এই তত্ত্বটি বেছে নেওয়ার কারণ, এই তত্ত্ব নিয়ে আগে যারা গবেষণা করেছেন তাদের উপলব্ধি বা ফলাফল, গবেষণার জন্য এই তত্ত্বটি কেন সংগতিপূর্ণ ও অপরিহার্য তা এখানে তুলে ধরতে হয়। অনেক সময় তাত্ত্বিক কাঠামো অংশ অধ্যায় আকারে না উল্লেখ করে মেথডলজি অধ্যায়েও অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে।
চতুর্থ অধ্যায় (গবেষণা পদ্ধতি) : গবেষণা পদ্ধতি গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। সমগ্র গবেষণাটি কোন পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়েছে তা এই অংশে বর্ণিত হয়। গবেষণার পদ্ধতি কী, তথ্যসূত্র কোন পর্যায়ের, পপুলেশন কারা, কেস বা রেসপন্ডেন্ট কারা, স্যাম্পলিং পদ্ধতি, রেসপন্ডেন্ট নির্বাচনের পদ্ধতি, গবেষণাক্ষেত্রে প্রবেশের পদ্ধতি, গবেষণার সময়কাল, ক্ষেত্র, তথ্য সংরক্ষণ পদ্ধতি, তথ্য সংশোধন পদ্ধতি, তথ্য বিশ্লেষণ পদ্ধতি, গবেষণায় মান্য নৈতিকতা ও সীমাবদ্ধতা প্রভৃতি এখানে উল্লেখ করতে হবে।
পঞ্চম অধ্যায় (ফলাফল)
তথ্য বিশ্লেষণের পর ফলাফল অধ্যায়ে গবেষণার ফলাফল নিয়ে আলোচনা করা হয়। ফলাফল লেখার ধরন গুণগত এবং পরিমাণগত গবেষণার জন্য ভিন্ন হয়ে থাকে। ফলাফল একটি মূল অধ্যায়ে বা দুই-তিনটি অধ্যায়ে লেখা যায়। ফলাফল অধ্যায়ের বর্ণনা ব্যাপ্তি সাধারণত মূল গবেষণাপত্রের শতকরা পঞ্চাশ থেকে ষাট শতাংশ হয়ে থাকে।
ষষ্ঠ অধ্যায় (সারাংশ ও উপসংহার) গবেষণার মূল ফলাফলগুলো একত্র করে গবেষক এই বিভাগে সংক্ষেপে উপস্থাপন ও আলোচনা করেন। গবেষণার উল্লেখযোগ্য আর্গুমেন্ট, উপসংহার, সুপারিশ ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনাও এখানে তুলে ধরা হয়।
রেফারেন্স
অ্যাকাডেমিক গবেষণাপত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো রেফারেন্স তালিকা। গবেষণাপত্রে উল্লিখিত তথ্যগুলোর সূত্র রেফারেন্স তালিকায় উল্লেখ করতে হয়। বিভিন্ন রেফারেন্স শৈলী প্রচলিত আছে। যেকোনো একটি অনুসরণ করলেই হবে, খেয়াল রাখতে হবে একাধিক পদ্ধতির মিশ্রণ যেন না ঘটে।
পরিশিষ্ট
পরিশিষ্ট গবেষণার মূল লেখার অপরিহার্য অংশ নয়, তবে প্রয়োজন হলে দিতে হবে। এখানে গবেষণার সহায়ক উপাদান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেমন, একটি সামাজিক গবেষণার থিসিসের প্রশ্নাবলি, বিশেষ ক্ষেত্রে ছবি বা ম্যাপ, উপাত্ত, প্রয়োজনীয় চিঠি বা অনুমতিপত্র এই অংশে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও অনুলিখন
শাহ বিলিয়া জুলফিকার