৭১ বার পড়া হয়েছে
পাওয়েলস বুক স্টোর।
শাহনাজ পারভীন মিতা
Powell’s City of Books
পাওয়েলস বুক স্টোরের কফি শপে বসে আছি । ১৯৭১ সালে স্থাপিত একটি প্রাক্তন গাড়ির ডিলারশিপে এক পরিত্যক্ত কোণে, পাওয়েলস একটি পোর্টল্যান্ড ল্যান্ডমার্ক এবং বিশ্বের বৃহত্তম নতুন এবং ব্যবহৃত বইয়ের দোকান— এবং এর অবস্থান শহরের কেন্দ্রস্থলে, পার্ল ডিস্ট্রিক্ট, শহরের কেন্দ্রস্থল এবং পশ্চিম প্রান্তে অবস্হিত । ২০১৬ সালে সামিনের গ্রাজুয়েশনের সময় সামিন প্রথম নিয়ে এসেছিলো এই বইয়ের দোকানে । এত বিশাল বইয়ের দোকান দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম । সেই প্রথম আমেরিকার অরেগন অঙ্গরাজ্যের পোর্টলেন্ড শহর দেখেও মুগ্ধ হয়েছিলাম । সামিন আমেরিকা আন্ডারগ্রেড পড়তে যাওয়ার পর বলতো আম্মু ,খুব সুন্দর অরেগন ।কিন্তু নিজের চোখে না দেখা পর্যন্ত অনুভব করতে পারি নাই । ঢাকা শহরে জন্ম বড় হয়েছি , গ্রামের মুক্ত অবারিত পরিবেশের সাথে যোগাযোগ সেই রকম ছিলো না বললেই চলে । পাহাড় ,সমুদ্র ভালোবাসি সবসময় । পাহাড় ঘেরা সবুজ অরণ্যের মাঝে পোর্টল্যান্ড শহর তার উপর পোর্টলেন্ড থেকে মাউন্ট হুডের চূড়া দেখা যায় শহরের বিভিন্ন কোনা থেকেই । মাউন্ট হুড হলো ক্যাসকেড আগ্নেয়গিরির আর্কে একটি সুপ্ত. স্ট্রাটোভলকানো। এটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে একটি সাবডাকশন জোন দ্বারা গঠিত হয়েছিল এবং এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত একটি সুপ্ত ভলকানো । রৌদ্র আলোকে পাহাড়ের উপর রুপালী ঝিলিক চোখে মনে বিস্ময় জাগায় মহান সৃষ্টি কর্তার সৃষ্টির প্রতি ।আর উইলামেট নদী ঘিরে রয়েছে এই শহরকে ঘিরে যা গিয়ে মিলত হয়েছে নীল নদ কলোম্বিয়া রিভার গর্জে । প্রথম বঙ্গোপসাগর পাড়ে দাড়িয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম সৃষ্টির বিস্ময়ে আর আটলান্টিক ও প্রশান্ত পাড়ে যখন প্রথম দাঁড়ালাম ,তখন মনে হলো বেঁচে থাকাটাই বিস্ময় !এই সুন্দর ধরনীর বুকে ।
তখন আমার আব্বা বেঁচে ছিলেন , সামিন ওর নানার জন্য কিটস এর একটি কবিতা সমগ্র কিনে দিয়েছিলো । এরপর যত বার পোর্টলেন্ড এসেছি ,চেয়েছি পাওয়েলসে আসি , সারাদিন থাকি কিন্তু কোনো বার বেশী সময় থাকতে পারিনি । এইবার পোর্টলেন্ড আসবার পর সামিনকে বলেছিলাম ,একদিন সারাদিন থাকবো পাওয়েলসে । আমাকে সকালে নামিয়ে দিয়ে আসবে তারপর সন্ধ্যায় এসে নিয়ে যাবে তোমরা । এবার দেশ থেকে পাওয়েলস বুক শপে দিবো বলে আমার তিনটা বই আলাদা করে নিয়ে এসেছিলাম । সাথে আব্বার জীবনদ্দশায় আব্বার দুটো প্রকাশিত কাব্যগ্রনহ । গতবার আমার প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রনহ – কথামালা তুমি দিয়েছিলাম এই বুক স্টোরে । সকালে সামিন তার অপিস ও মিটিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো , অপিসে গিয়ে দুপুরে ফিরে এসে আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেলো দুপুর দেড়টার দিকে । বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে আমাদের বর্ষাকালের মতন । অরেগনে সব সময় বৃষ্টি পরে বিশেষ করে অক্টোবর থেকে পুরো শীতকাল। গাড়ী থেকে নেমে দ্রুত বইয়ের দোকানে ভিতরে ঢুকলাম । অবশ্য বৃষ্টি দেখে রেইন জ্যাকেট পড়ে বের হয়েছিলাম সাথে ক্যাপ যাতে শরীর ও মাথা না ভিজে । এখানে দেখি সবাই এই বৃষ্টির ভিতরই ঘুরে বেড়ায় । হয় মাথায় ছাতা না হয় বৃষ্টির পোশাক । এটা তাদের জীবনযাপনে কোনো বাধা সৃষ্টি করে না ।
বইয়ের দোকানের ভিতর নয়টি রঙ-কোডেড রুম এবং ৩,৫০০ বেশি বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে। খুচরা এবং অনলাইন বিক্রয়ের জন্য জায়গায় জায়গায় মিলিয়নেরও বেশি নতুন, ব্যবহৃত, বিরল এবং মুদ্রিত বই রয়েছে । ২০০৯ সাল পর্যন্ত, পাওয়েলস প্রতিদিন প্রায় ৩,০০০ব্যবহৃত বই কিনছিল।কবিতার বইয়ের ওখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কবিতার বই দেখলাম , কয়েকটি বই খুলে খুলে পড়লাম । বিভিন্ন বয়সি কত মানুষ এসেছে বই কিনতে ও পড়তে । আমি তাকিয়ে শুধু বয়স্ক লোকজনদের দেখি এবং তাদের আনন্দ নিয়ে সময় কাটানো দেখি এত সুন্দর পরিবেশ , যে কেউ সারাদিন এখানে সময় কাটিয়ে দিতে পারবে আনন্দে । একজন প্রিয় ছোট ভাই বাংলাদেশ থেকে দুটো বইয়ের অর্ডার দিয়েছিলো । তার একটি বইয়ের তিনটি খন্ড পেয়ে কিনলাম কিন্তু আরেকটা বই পেলাম না বুকস্টোরে ।ওরা বললো অনলাইনে দেখতে ।
আমি চে গুয়েভারার জীবনের ওপর একটা বই কিনলাম । চে গুয়েভারা ছিলেন এক বরেণ্য আর্জেন্টিনীয় মার্কসবাদী, বিপ্লবী, চিকিৎসক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবা বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব।আমার খুব প্রিয় একজন ব্যাত্তিত্ব । তিনি চিকিৎসক থেকে বিপ্লবী হয়েছিলেন । একজন মানবতাবাদী ছিলেন ।সবসময় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন যে কোনো বিপদে ।আমার খুব শখ ছিলো ডাক্তার হবার কারন আমার সব সময় মনে হতো একজন ডাক্তার ইচ্ছা করলেই কারো বিপদে পাশে থাকতে পারে তার চিকিৎসা সেবা দিয়ে । মানবতার সেবায় তারা সবচেয়ে অগ্রগামী । সারা জীবন চে কবিতার প্রতি আসক্ত ছিলেন। পাবলো নেরুদা, জন কিটস, এন্টনিও মারকাদো, ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা, গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল এবং ওয়াল্ট হুইটম্যান অনেকেই তার মনে ও মননে স্বপ্ন ও কল্পনার মায়াজাল বুনে দিয়েছিল। তিনি ভালো আবৃত্তিও পারতেন।
লাতিন আমেরিকায় ভ্রমণের সময় থেকেই তার মনে বিপ্লবের একটা অঙ্কুর জাগ্রত হতে থাকে। সেসময় তিনি মানুষের দারিদ্র্য দেখে মুষড়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারেন এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণ হলো একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এবং এর একমাত্র সমাধান বিশ্ববিপ্লব। ধীরে ধীরে এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে চে রাষ্ট্রপতি জাকোবো আরবেনজ গুজমানের নেতৃত্বাধীন গুয়াতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ক্রমে তার জীবনের গতিপথ বদলায়। আদর্শ পাল্টটায়। তিনি স্টেথো ছেড়ে বন্দুক তুলে নেন।
চে গুয়েভারাকে কিউবান ভাষায় লেখালেখিও করেছেন। লিখেছেন প্রায় ৭০টি নিবন্ধ। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত ভাষণ আর সাক্ষাৎকার দিয়েছেন প্রায় ২৫০-এর মতো। বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে লেখা তার অসংখ্য চিঠির মধ্যে ৭০টির মতো পাওয়া যায়। তার লেখালেখি নিয়ে রচনাবলিও প্রকাশিত হয়েছে।
বলিভিয়ার সেনাবাহিনীর চে-কে ১৯৬৭ সালের ৭ অক্টোবর গ্রেফতার করে এবং তার মৃত্যু হয় ৯ অক্টোবর দুপুর ১.১০টার দিকে। মৃত্যুর সময়কাল ও ধরন নিয়ে রয়েছে মতভেদ ও রহস্য। ধারণা করা হয়, ১৯৬৭ সালের কোনো একদিন লা হিগুয়েরা নামক স্থানে নিরস্ত্র অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয় বন্দি চে গুয়েভারাকে।
তার মৃত্যুর খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে: আবার চে গুয়েভারার মৃত্যু হয়েছে এবং সত্যিই তাই ঘটেছে বলে মনে করে সবাই। এর কারণ তার মৃত্যু নিয়ে নানান ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল। গুলি করে হত্যা করার পরের দিন ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ একটি নিবন্ধের তৃতীয় লাইনটি ছিল এমন, ‘৩৯ বছর বয়সী মি. গুয়েভারা এর আগেও মারা গিয়েছিলেন বা বন্দি হয়েছিলেন বলে জানা গিয়েছিল।’ মৃত্যুর পর বলিভিয়ায় চে গুয়েভারার মৃতদেহ প্রদর্শন করা হয়েছিল। এরপর গোপনে একটি গণকবরে সমাধিস্থ করা হয়।এর ঠিক ৩০ বছর পর, জন লি অ্যান্ডারসন যখন গুয়েভারার জীবনী লেখবেন বলে ঠিক করলেন, তার কবরটি কোথায় সেটা জানা তার জন্য জরুরি হয়ে যায়। তখনই খুঁজে বের করা হয় তার কবর এবং দ্বিতীয়বারের মতো কিউবায় পূর্ণ সম্মানের সঙ্গে তার সমাহিতকরণের কাজ সম্পন্ন করা হয়।
বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠেন চে গুয়েভারা। তার বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমা, নাটক। ২০০৮ সালের ৪ ডিসেম্বরে মায়ামি বিচে আর্ট ব্যাসল চলচ্চিত্র উৎসবে চে পার্ট ওয়ান চলচ্চিত্রের প্রথম প্রদর্শনী হয়। একই সঙ্গে ২০০৯ সালে ২৪ জানুয়ারি জীবনী, নাটক, ইতিহাস এবং যুদ্ধনির্ভর এ চলচ্চিত্র মুক্তি পায় আমেরিকাতে। স্টিভেন সোডারবার্গ পরিচালিত এ মুভিটিতে অভিনয় করেন চে এর ভূমিকায় ছিলেন বেনেসিও ডেল টরো। এ পর্যন্ত ছবিটি বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে তিনটি পুরস্কার ও আটটি মনোনয়ন পেয়েছে।এই মহান বিপ্লবী সবসময় আমার স্বপ্নের নায়ক ।
এরপর এবার আমার অমর একুশে বইমেলায় পান্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রনহ , প্রজাপতি হওয়ার অপেক্ষায় ও আমার বাবা কবি মোহম্মদ আব্দুল মান্নানের জীবনদ্দশায় প্রকাশিত কাব্যগ্রনহ ,মৃত্যুর আড়ালে প্রেম , কবিতা তোমাকে খুঁজি , বুকস্টোরে জমা দিলাম । আজ সকালে শুধু চা বিস্কুট ও ডিম খেয়ে বাসা থেকে বের হয়েছিলাম তাই বিকাল ৫টা বাজতেই একটু ক্ষুধা লাগা শুরু হলো তখন Coffe রুমে গিয়ে ঢুকলাম। লাইনে দাড়িয়ে একটা ক্রোসান ও লাতে নিয়ে এককোনায় বসে বসে বই পড়লাম ও খেলাম । এ এক অন্য পরিবেশ জীবন আনন্দের । বই জীবনের কথা বলে , বই পড়ে যারা জীবনের আনন্দ আহরন করতে পারে তাদের জীবন সত্যিই আনন্দময় হয় । সেই আনন্দ জীবনের এক অপার ভালোবাসা । যারা এই ভালোবাসার সন্ধ্যান পান জীবনের ক্ষুদ্রতা ,অপ্রাপ্তি ও নীচতা তাদের ছুঁয়ে যেতে পারে না । জীবন সত্যিই সুন্দর যদি আমরা চাই , তাই এই লেখক জীবনে এই বয়সে বই পড়া ও লেখা আমার ক্ষুদ্র জীবনের এক পরম প্রাপ্তি ।
১ Comment
শাহনাজ পারভীন মিতার লেখা নিবন্ধটি পাঠ করে অনেক কিছু জানতে পারলাম। লেখিকাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই।