বিদায় কবি আফতাব আহমদ, আফতাব আহমদকে নিয়ে যা লিখলেন নুহাশ হুমায়ূন:
কবি আফতাব আহমদ মারা গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন নবীন–প্রবীণ অনেক কবি–সাহিত্যিক। তাঁকে নিয়ে মর্মস্পর্শী স্ট্যাটাস দিয়েছেন নুহাশ হুমায়ূন।
কবি আফতাব আহমদ মারা গেছেন। ৩ জুলাই সোমবার রাত পৌনে ৯টার দিকে রাজধানীর বনানীর একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান। ৪ জুলাই মঙ্গলবার তাঁকে সমাহিত করা হয়। তিন মাস ধরে আফতাব আহমদ হৃদ্রোগ ও কিডনিজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। তিনি ছিলেন অভিনেত্রী আয়েশা আখতারের ছেলে।
আফতাব আহমদ ২০১৯ সালে হুমায়ূন আহমেদের সাবেক স্ত্রী গুলতেকিন খানের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর মৃত্যুতে কবি–সাহিত্যিকদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাঁকে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ ও গুলতেকিন খানের ছেলে এক আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন, এটি ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাঁকে নিয়ে কবিরা লিখেছেন কবিতা ও শোকগাথা।
পেশাজীবনে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করলেও আফতাব আহমদের প্রথম পরিচয় ছিল, তিনি ছিলেন কবি। ‘তুমি নও কখনো আঁধারে’ (১৯৯১), ‘যা কিছু স্বর্গীয় ছিলো’ (২০১৬) তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। কবিতায় রোমান্টিকতার এক অন্য তরঙ্গ স্পর্শ করেছিলেন তিনি। তাঁর কবিতায় যেমন প্রতিভাত হয়েছে সহজ এক আবেগ, তেমনি ছিল প্রজ্ঞার ছোঁয়াও। ‘তোমাকে দেখি না’ নামে তাঁর একটি কবিতায়ও বিষয়টি ধরা দিয়েছে। পাঠকের জন্য আফতাব আহমদের সেই কবিতাটি এখানে তুলে দিচ্ছি:
‘পড়ে জল, নড়ে পাতা
সারা রাত
বেজে যায় বীণা
শত মুখ
দিনমান
ভাসে চারিদিকে
নেচে ফেরে
মাতাল দখিনা
আমি শুধু তোমাকে
দেখি না।’
এই কবিতার মধ্যে রোমান্টিসিজম আছে, পাশাপাশি রয়েছে আবহমান বাংলা কবিতার সৌন্দর্য। এই কবিতার মতো তাঁর অন্য কবিতায়ও পাওয়া যায় একধরণের ধ্রুপদি আবহ।
কবিতা লেখার পাশাপাশি গুলতেকিন খানের সঙ্গে মিলে ‘মধুরেণ’ (২০১৭) নামে একটি কাব্যনাট্যও লিখেছিলেন আফতাব আহমদ। আবার গুলতেকিন খানও আফতাব আহমদের এক জন্মদিনে তাঁকে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন কবিতা। ‘তোমার জন্যে মাত্রাবৃত্তে’ নামে সেই কবিতায় তিনি আফতাবকে উদ্দেশ করে গাঁথেন বিচিত্র উপমার মালা:
‘তোমার জন্যে মাত্রা বৃত্তে লিখব বলে যখন ভাবি
ছিপের তিন মাল্লা মিলে হারিয়ে ফেলে নাকের ছাবি
যখন ভাবি তোমায় নিয়ে উঠবো গিয়ে নতুন তীরে
শ্যাওলা জলে নোলক খুঁজে পানকৌড়ি যায় না ফিরে।
এমন একটা ছন্দ পেতাম তোমায় নিয়ে মুখ ঢাকা যায়
বৈঠা হেনে ছিপটি টেনে হয়ে গেছি আজ অসহায়
ঝড়ে ডোবার জাহাজ তুমি নও যে সেটা সবাই জানে
তোমার কিছু যায় আসে না মানে কিংবা অসম্মানে।
তোমার জন্যে মাত্রা বৃত্তে লিখব বলে ভাবতে থাকি
নাগরদোলায় একটু সময়, আর কিছুটা থাকুক বাকি।’
কবিতা–সাহিত্যের এক নান্দনিক ভুবনে সব সময়ই নিমজ্জিত ছিলেন আফতাব আহমদ। এ কবির মৃত্যুতে তাঁর সতীর্থ কবি–লেখকেরা বেদনাহত হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই বেদনার কথা জানিয়েছেন তাঁরা। তাঁর বন্ধু কবি তুষার দাশ প্রথমে একটি স্ট্যাটাস লেখেন আফতাব আহমদের মৃত্যুর পর। এরপর সদ্য মৃত এই কবিকে নিয়ে তিনি লিখেছেন হৃদয়ছেঁড়া একটি কবিতাও, যাতে ধ্বনিত হয়েছে বন্ধুর প্রতি বন্ধুর আবেগ ও অনুরাগ। ‘না, কোন এলিজি নয়’ শিরোনামে তুষার দাশের সেই কবিতাটি পড়া যাক:
না, কোন এলিজি নয়
তুষার দাশ
(বনানীর গোরস্থানে আফতাব শেষ ঘুমে চলে গেলে)
আপনাকে কবরে শুইয়ে দেয়ার পর আপনাকে নিয়ে কবিতা লেখার কোনো মানেই হয় না।
আজ রাত থেকে আপনার কোনো বন্ধু নেই, পরিবার নেই, দায় নেই, দয়া ও মমতা আপনার চারপাশ ঘুরঘুর করলেও আর স্পর্শ করতে পারবে না কিছুতেই।
হ্যাঁ মশাই, আপনাকে।
আপনার স্পর্শ পাওয়া ল্যাপটপ, কিন্ডেল, সেলফোন, আইপ্যাড—ভেতরের অজস্র জমানো বই, গানগুলো—ওরা অপেক্ষায় থাকবে অনন্তকাল।
ধুলো জমে জমে বইগুলো আরও কালো হয়ে উঠবে।
বুঝি, এই মনে হবে তাদের,
নিশ্চিন্তে সিগারেট ধরিয়ে আপনি তাদের কাউকে স্পর্শ করে ডুব দেবেন প্রকৃত ট্র্যাজিক হিরোর সন্ধানে।
(গত ৪০ বছরের সন্ধান কিছুতেই ব্যর্থ হতে পারে না।)
কিন্তু, তারা আর কোনো দিন আপনার সিগারেটপোড়া আঙুলগুলোর চুম্বন-স্পর্শ পাবে না।
আলোকিত বন্ধুদের সমস্ত আলো জড়ো হলেও আপনার মাটিচাপা দেওয়া ভয়ংকর, জীবিতদের অনাস্বাদিত অন্ধকার দূর করতে তা একান্ত অক্ষম।
এই গহ্বরিত অন্ধকারে নিশ্চিন্তে ঘুমানো সম্ভব?
৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঝলসানো আলোও কি আপনার এই ঘুম ভাঙাতে সক্ষম?
জানাবেন প্লিজ!!
কবিতায় প্রবীণ কবি তুষার দাশ যেভাবে বেদনার্ত বোধ করেছেন, আফতাব আহমদের প্রয়াণে একইভাবে শোকাহত হয়েছেন তরুণ কবিরাও। কারণ, তিনি সব সময় তরুণদের উৎসাহিত করতেন। যেমন, তরুণ কবি নওশাদ জামিল লিখেছেন, ‘প্রিয় আফতাব ভাই, আপনার সাথে ও গুলতেকিন আপার সাথে কাটানো সময়গুলো ছিল সত্যিই আনন্দের। বইমেলায় আপনারা দুজনই আমার অজান্তে বই কিনেছিলেন, তারপর ছবি পাঠিয়েছিলেন। আমার বিভিন্ন লেখা আপনার কেন এত ভালো লাগত, কেন এত পছন্দ করতেন, কে জানে! আপনার সাথে কত আড্ডা, কত মজার ঘটনা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনালাপ, সবকিছু স্মৃতি হয়ে গেল আজ। আল্লাহ পাক আপনাকে বেহেশত নসিব করুন। আমিন।’
এ ছাড়া আফতাব আহমেদের মৃত্যুতে ইংরেজিতে মর্মস্পর্শী এক স্ট্যাটাস লিখেছেন গুলতেকিন খানের ছেলে নুহাশ হুমায়ূন।
আফতাব আহমদের মৃত্যুর পরপর নিজের ফেসবুকে সেই শোকবার্তায় নুহাশ তাঁকে নিজের পরিবারের একজন উল্লেখ করে লেখেন, ‘আমার কাছে তিনি ছিলেন পরিবার, একজন প্রিয় বন্ধু আর একই সঙ্গে আমার সৃষ্টিশীল কাজের সহযোগী।’
কবির পাশাপাশি আফতাব আহমদ কেমন মানুষ ছিলেন, তা বোঝানোর জন্যই নুহাশ হুমায়ূনের স্ট্যাটাসটি বাংলায় অনুবাদ করে এখানে প্রকাশ করা হলো।
নুহাশ হুমায়ূনের সেই স্ট্যাটাস
‘…চার মাসেরও বেশি আগে তিনি একাধিক স্ট্রোকের শিকার হন। এরপর তিনি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখান থেকে বাইরে এসেছেন, আবার আইসিইউতে গেছেন। তিনি কথা বলার ক্ষমতাও হারিয়েছিলেন। নড়াচড়ার ক্ষমতাও পুরোপুরি ঠিক ছিল না। শেষ পর্যন্ত তিনি কিছুটা শান্তি পেয়েছেন, এই আশা করি।
আফতাব চাচা ও আমার মা বিবাহিত ছিলেন চার বছরেরও বেশি সময় ধরে। তবে তাঁকে “সৎবাবা” বললে আমাদের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক বোঝা যাবে না। আমার কাছে তিনি ছিলেন পরিবার, একজন প্রিয় বন্ধু আর একই সঙ্গে আমার সৃষ্টিশীল কাজের সহযোগী। টেলিভিশনে প্রচারিত আমার প্রথম কাজের তিনি ছিলেন গীতিকার। আমার সদ্য প্রচারিত ধারাবাহিক “ষ”তে তিনি ছিলেন আমার সহলেখক। গত কয়েক মাসে আমি হাসপাতালের অনেক ফরম পূরণ করেছি। সেখানে সম্পর্কের জায়গায় লিখেছি “পুত্র”। আর তা লিখেছি সরাসরি হৃদয় থেকে। একজন কবি, একজন পারিবারিক মানুষ, ব্যক্তি আর পেশাজীবনে তিনি বহু ভূমিকা পালন করেছেন।
ইউএনডিপির তাঁর একজন সহকর্মী তাঁর পরিচয় তুলে ধরেছেন এভাবে: “সৎ, বিচক্ষণ, কথায় রসিকতার ঝলক ও কবিতা ও জীবন উভয় ক্ষেত্রেই বাঙালী রোমান্টিকতা ছোঁয়া একজন শেকস্পিয়ারীয়।” তাঁর জন্য প্রার্থনা করবেন। তাঁর সব শুভাকাঙ্ক্ষী, তাঁর পরিবার এবং তাঁর অসাধারণ ছেলে আবরারকে ভালোবাসা জানাই।’