১৫৩ বার পড়া হয়েছে
বিজ্ঞানী ও গবেষক হয়েও স্বদেশী ব্যবসায় দিশারী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র
সিদ্ধার্থ সিংহ
এ বছর তাঁর জন্মের ১৬০তম বর্ষ। না, আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা বলছি না। বলছি এমন একজনের কথা, যিনি রবীন্দ্র-আলোকে স্নান হয়ে গেলেও রবীন্দ্রনাথের চেয়ে কোনও অংশে কম ছিলেন না তিনি।
তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ। তখনকার দিনে শিক্ষাবিভাগে কোনও ভারতীয়র চাকরি হলেও তিনি মাইনে পেতেন সাহেব অধ্যাপকদের তুলনায় প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কম। বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর চাকরির জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। রীতিমত আন্দোলন শুরু করলেন। ফলে বড়লাট বাধ্য হয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশন বসালেন। কমিশন দু’ভাগে ভাগ করল ভারতের উচ্চতর শিক্ষাবিভাগকে। প্রথমটি সাহেবদের জন্য আর দ্বিতীয়টি ভারতীয়দের জন্য। ভাগ হলেও বেতম-বৈষম্য কিন্তু থেকেও গেল। ভারতীয়রা যদি একশো টাকা মাইনে পান, তা হলে ওই একই পদে, একই মর্যাদায় কাজ করে সাহেবরা পাবেন দুশো টাকারও বেশি। তবু কোনও বিরোধে না গিয়ে ১৮৮৯ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নের অস্থায়ী সহকারী অধ্যাপক হিসেবে তিনি কাজে ঢুকলেন। মাইনে ছশো ছায়ায় টাকা।
এর ক’দিন বাদেই বিভাগীয় প্রধান পেডলার সাহেব একান্ত পারিবারিক কারণে বিলেত চলে যাওয়ায় গোটা রসায়ন বিভাগের দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁর উপরে। টানা সাতাশ বছর অধ্যাপনা করেছিলেন তিনি। তাঁর বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন মেঘনাথ সাহা, নীলরতন ধর, সত্যেন বোস, রসিকলাল দত্তের মতো বিদগ্ধরা। একমাত্র তাঁরই আবেদনে সাড়া দিয়ে প্রায় আন্তর্জাতিক মানের একটি পরীক্ষাগার তৈরি করে দিয়েছিল তৎকালীন শিক্ষা দফতর।
তিনি ছিলেন রসায়নবিদ। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি এসসি পড়ার সময় বিষয় হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন পদার্থবিদ্যা, রসায়ন আর প্রাণিবিদ্যা। কয়েক দিনের মধ্যেই প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন আলেকজান্ডার ক্রামবাউন, ড. জন গিবসন বিন এবং পি ভি টেইট-এর। ১৮৮৫ সালে পাশ করলেন বি এসসি। এর পর ১৮৮৮ সালে ডক্টরেট। স্পেশ্যাল সাবজেক্ট হিসেবে নিলেন অজৈব রসায়ন। বিষয়— কনজুগেটেড সালফেটস অব কপারম্যাগনেশিয়াম গ্রুপ। আ স্টাডি অব আইসোমরফাস মিক্সচারস অ্যান্ড মলিকিউলার কমবিনেশন। ডক্টরেট করে হয়ে গেলেন রসায়নবিদ।
তিনি ছিলেন গবেষক। প্রেসিডেন্সির রসায়ন বিভাগের দায়িত্ব পাওয়ার পরেই তিনি মেতে উঠলেন গবেষণা নিয়ে। যে সব মৌলিক পদার্থ দিয়ে বিশ্বব্রহ্মান্ড তৈরি, তাদের একটা তালিকা বানিয়ে রসায়নের জগতে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন রুশ বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেন্ডেলিফ। কিন্তু সেই তালিকা তখনও সম্পূর্ণ নয়। তাতে ছিল কিন্তু ফাঁকফোকর। অর্থাৎ সবাই জানতেন, প্রকৃতিতে নিশ্চয়ই এমন কিছু মৌল আছে, যাদের খোঁজ মেন্ডেলিফ পাননি। তাঁর লক্ষ্য ছিল এমনই কিছু মৌল আবিষ্কার করে রসায়নের জগতে তাক লাগিয়ে দেওয়া। সে জন্য ভারতীয় ভূতাত্ত্বিকদের কাছ থেকে দুষ্প্রাপ্য খনিজ সংগ্রহ করে সে সব বিশ্লেষণ করছিলেন তিনি। প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজের ল্যাবরেটরিতে ক্যালোমেল নামে এক রাসায়নিক তৈরিক চেষ্টা করছিলেন। ক্যালোমেল হল মারকিউরাস ক্লোরাইড। সেটা বানাতে গেলে দরকার মারকিউরাস নাইট্রেট নামে একটা পদার্থ। তো, সেটা আগে তৈরি করতে হবে। সেই জন্য তিনি ইডিওমিটারে ব্যবহার করার পারদকে শীতল অবস্থায় লঘু নাইট্রিক অ্যাসিডে ধীরে ধীরে ফেলছিলেন। লম্বা নলে রাখা অ্যাসিডে পারদ বিন্দুগুলি নীচে নামতে নামতে পরিশ্রুত হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু উনি দেখলেন, তেরো থেকে চোদ্দো শতাংশ ফসফরাস পেন্টঅক্সাইড সমৃদ্ধ শীতল ও লঘু নাইট্রিক অ্যাসিড যদি পারদের সঙ্গে বিক্রিয়া করে, তা হলে পারদ, মানে মারকারির উপরে একটা হলুদ আস্তরন পড়ে। তিনি দেখলেন, সেটা শত্রু, খানিকটা কেলাসিত লবণ আকৃতির। প্রথমে ভেবেছিলেন, ওটা ক্ষারীয় পদার্থ। কিন্তু পরে ভেবে দেখলেন, তীর নাইট্রিক অ্যাসিডে জাড়িত হয়ে আসা কোনও কিছুতে ক্ষারীয় লবণ থাকা সম্ভব নয়। ফলে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেন তিনি। দেখলেন, ওটা মারফিউরিক নয়, মারফিউরাস। আর লবণটিও নাইট্রেট নয়, নাইট্রাইট।
মারকিউরাস জিনিসটা অস্থায়ী। নাইট্রাইটও অস্থায়ী। ফলে দুটো অস্থায়ী জিনিস একত্রিত হয়ে যে একটা স্থায়ী যৌগ তৈরি হতে পারে, এমনটা বিশ্বাস করতেন না গবেষকেরা। তিনি প্রামাণ করলেন, তাদের ধারণা ভুল। কলকাতায় বসে তাঁর এই সাফল্যের খবর রটে গেল সারা বিশ্বে।
ওই পদার্থ ছাড়া আরও যে সব শ্রেণির যৌগ তৈরির লক্ষ্যে তিনি সফল হন, সেগুলি হল অ্যামোনিয়াম নাইট্রাইট, অ্যালকাইল অ্যামোনিয়াম নাইট্রাইড, সালফার-ঘটিত জৈব পদার্থ এবং প্লাটিনাম, ইরিডিয়ামের কিংবা সোনা সংবলিত জৈব রাসায়নিক। নতুন পদার্থের সংশ্লেষণ ছাড়া ঘি, মাখন, তেলের রাসায়নিক বিশ্লেষণ নিয়েও গবেষণা করেছেন তিনি। উদ্দেশ্য, ও সবে ভেজাল ধরা। এ ছাড়াও আবিষ্কার করেছেন নতুন নতুন এক একটা যৌগ এবং তা নিয়ে লিখেও ফেলেছেন একশো চল্লিশটি গবেষণালব্ধ পেপার। যেগুলি ছাপা হয়েছিল বেশ-বিদেশের নানান জার্নালে।
শুধু রসায়ন কেন? উনি গবেষণা করেছেন ইতিহাস, জ্যোতির্বিদ্যা, পাটীগণিক, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, জ্যামিতি, চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে শুরু করে চরক, সুশ্রুত, ভগভট, বৃন্দ, চক্রপাণি, নাগার্জুন নিয়েও।
তিনি ছিলেন লেখক। তাঁর বিখ্যাত বইগুলির মধ্যে রয়েছে— সরল প্রাণি বিজ্ঞান / নব্য রসায়নী বিদ্যা ও তার উৎপত্তি / রাসায়নিক পরিভাষা / বাঙালির মস্তিষ্ক ও তার অপব্যবহার / আত্মচরিত। বাংলার পাশাপাশি ইংরাজিতে লিখেছেন— হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিষ্টি (দু’টি খণ্ড) / লাইফ অ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্সেস অব আ বেঙ্গলি কেমিস্ট (দু’টি খণ্ড) / ম্যাগনাম ওপাস / মেকার্স অব মর্ডান কেমিষ্টি/ দ্য ডিসকভারি অব অক্সিজেন।
তিনি ছিলেন ভাষাবিদ। ক্লাস সেভেনেই দাদা জ্ঞানেলচন্দ্রের এনে দেওয়া ‘প্রিন্সিপিয়া ল্যাটিন’ বইটি পড়ে ওই বয়সেই তিনি আয়ত্ব করে ফেলেছিলেন ফরাসি ভাষা। কৈশোর পেরোনোর আগেই শিখে ফেলেছিলেন ইংরাজি, গ্রিক, সংস্কৃত, ফ্রেঞ্চ, জার্মানি। যা তাঁকে এক চান্সে গিলক্রাইস্ট স্কলারশিপ পেতে সাহায্য করেছিল। ১৮৮২ সালে বৃত্তি পেয়েছিলেন সাত হাজার টাকা। সুযোগ পেয়েছিলেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। সেই সুযোগে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল আর এক কৃতী ভারতীয় জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে।
তিনি ছিলেন উদ্যোগপতি। প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগদানের তিন বছরের মধ্যে নিজের জমানো মাত্র আটশো টাকা দিয়ে মানিকতলার কাছে ১১, আপার সার্কুলার রোডের একটা ছোট্ট ঘরে গড়ে তুলছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড। ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়া মেনে তৈরি করতে শুরু করেছিলেন নানা ধরনের ওষুধ, গ্লিসারিন সাবান, ট্যালকম পাউডার, টুথপেস্ট, ফিনাইল, কার্বলিক অ্যাসিড, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, সার্জিকাল এবং হাসপাতালের নানান জিনিসপত্র। এই কাজে তাঁর পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ড. বিধানচন্দ্র রায়, ড. আর জি কর, ড. নীলরতন সরকার, জওহরলাল নেহরু, মহাত্মা গান্ধীর মতো স্ব স্ব ক্ষেত্রে কৃর্তী বাঙালিরা।
তিনি ছিলেন সফল ব্যবসায়ী। তিনি শুধু প্ল্যান্টে ওষুধ তৈরির নকশা নির্ধারণই করতেন না, সেগুলি বিক্রির জন্য যাবতীয় পরিকল্পনাও করতেন। ফলে খুব অল্প দিনের মধ্যেই তা ফুলেফেঁপে বড় হয়ে ওঠে। এত বড় হয়ে যায় যে, ১৯০১ সালের ১২ এপ্রিল সরকার সেটি অধিগ্রহণ করে নেয়। তখন তার নাম হয় বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড। তখন তার শাখা পানিহাটিতে, মুম্বইতে এবং কানপুরে। সে ব্যবসা এখনও রমরমিয়ে চলছে।
তিনি ছিলেন সমাজসেবী। দারিদ্রতা কাকে বলে তিনি তা জানতেন না। কিন্তু তা বলে তাঁর কোনও বিলাসিতাও ছিল না। হাজারখানেক টাকা জমলেই তিনি অস্থির হয়ে উঠতেন টাকাটা কাকে দেওয়া যায় এবং দিয়েও দিতেন। ডান হাত দিলে বাঁ হাত টের পেত না। একবার যে-ই দেখলেন, তার ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে ১১১২ টাকা জমে গিয়েছে, তিনি তখন একে ওকে তাকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, এই টাকাটা কাকে দেওয়া যায়। অবশেষে যতক্ষণ না ওই টাকাটা উনি ব্রাহ্মসমাজের হাতে তুলে দিলেন, ততক্ষণ তাঁর মাথায় যেন পাহাড় চেপে বসে ছিল।
তিনি ছিলেন দেশপ্রেমী। তিনি যখন বি এসসি-র ছাত্র, তখন এসে অন ইন্ডিয়া’ নামে একটি ছোট্ট চটি বই লিখে জনে জনে বিলি করেছিলেন। তাতে ছিল ব্রিটিশদের প্রতি সতর্কবাণী— সময় থাকতে অত্যাচারী শাসননীতি পাল্টাও, নইলে সমূহ বিপদ।
ব্রিটেনের বিশিষ্ট লোকদের কাছেও পাঠানো হল সেই পুস্তিকা। রাতারাতি শোড়গোল পড়ে গেল চারদিকে। সংবাদপত্রের শিরোনাম হলে গেলেন ভারতীয় এই তরুণ ছাত্র। তিনি সরাসরি কখনও সে ভাবে রাজনীতিতে না জড়ালেও মনেপ্রাণে ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী।
অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অপরাধে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ গ্রেফতার হওয়ার পরে তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে তিনি চিঠি লিখেছিলেন— আমি যখন বিজ্ঞান চর্চা করি, তখন বিজ্ঞানের মধ্যে দিয়েই দেশকে সেবা করি।
তিনি ছিলেন নানান সম্মানে ভূষিত। ১৮৮৭ সালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল সোসাইটির সহ-সভাপতি। ১৯১২ সালে ভারত সরকারের সিআইআই পুরস্কারে সম্মানিত। ওই বছরেই ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট এবং রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে রসায়নের পালিত অধ্যাপকের পদ গ্রহণ। ১৯১৭ সালে নাইটহুড। ১৯২০ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি। ১৯২৪ সালে ইণ্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৩১ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি। ১৯৩৪ সালে লন্ডনের কেমিক্যাল সোসাইটির ফেলো। ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ।
শুধু স্মারক বা সার্টিফিকেটেই নয়, তাঁর স্বীকৃতি ছিল অনেক বিখ্যাত লোকের কথাতেও। তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে কেমিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডন-এর প্রেসিডেন্ট হেনরি এডওয়ার্ড আর্মস্ট্রং একবার তাঁকে চিহ্নিত করেছিলেন— ‘মাস্টার অব নাইট্রাইটস’ বলে।
১৯৩২ সালে তাঁর ৭০তম জম্মদিন পূর্তি উপলক্ষে যে সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল, তার সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি সেখানে বলেছিলেন— আমরা দু’জনে সহযাত্রী। কালের তরীতে আমরা প্রায় ঘাটে এসে পৌঁচেছি। কর্ম্মের ব্রতেও বিধাতা আমাদের কিছু মিল ঘটিয়েছেন। আমি তাঁকে তাঁর সেই আসনে অভিবাদন জানাই, যে আসনে প্রতিষ্ঠিত থেকে তিনি তাঁর ছাত্রের চিত্তকে উদ্বোধিত করেছেন, কেবলমাত্র তাকে জ্ঞান দেননি, নিজেকে দিয়েছেন, যে দানের প্রভাবে সে নিজেকেই পেয়েছে…
….উপনিষদে কথিত আছে, যিনি এক তিনি বললেন, আমি বহু হব। সৃষ্টির মূলে এই আত্মবিসর্জনের ইচ্ছা। তাঁর সৃষ্টিও সেই ইচ্ছার নিয়মে। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে তিনি বহু হয়েছেন, নিজের চিত্তকে সঞ্জীবিত করেছেন বহু চিত্তের মধ্যে।
তিনি ছিলেন আপাদমস্তক বাঙালি। জীবনে প্রথম বিদেশ যাওয়ার আগে প্রায় এক মাস ধরে কোট-প্যান্ট-টাই পরে চলাফেরা এবং কাঁটা-চামচে খাওয়ার অভ্যাস রপ্ত করেছিলেন তিনি। অথচ দেশে ফিরে, জাহাজ থেকে কোনও রকমে নেমেই উনি প্রথম যে কাজটি করলেন, সেটি হল— শার্ট-প্যান্ট ছেড়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে নিলেন।
তিনি ছিলেন সত্যিকারের ছাত্র। যখন তাঁর বয়স এগারো কি বারো, কাউকে ডাকতে হত না, তিনি নিজেই ভোর তিনটে-সাড়ে তিনটের সময় উঠে শুধু স্কুলের পাঠ্য বই-ই নয়, বেশির ভাগ সময়েই প্রিয় কোনও লেখকের বই নিয়ে বসে পড়তেন। এর কিছু দিন পরেই এক মারাত্মক ধরনের আমাশায় আক্রান্ত হন তিনি। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় দু’বছর। এই সময় তিনি পড়ে ফেললেন নিউটন, গ্যালিলিও, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, স্যার উইলিয়ম জোনস ও জন লিডেন এর জীবনবৃত্তান্ত। পড়ে ফেললেন শেক্সপিয়রের ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’, ‘জুলিয়াস সিজার’। সে সময় বঙ্গদর্শন মাসিক পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাস। ওই বয়সে উনি সেটিও গোগ্রাসে পড়ে ফেললেন। তখন যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত ‘আর্যদর্শন’-এ বিশ্বখ্যাত দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল-এর জীবনী বাংলায় অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হচ্ছিল। তার সব ক’টি কিস্তিই তিনি পড়া ফেললেন। মনে ধরল জন-এর জীবনী। দার্শনিক জনও ছোটবেলায় অসুস্থ হয়ে অনেক দিন বাড়িতে বসে ছিলেন। তখন তাঁর বাবা, জনকে নাকি দেশ-বিদেশের বহু বই এনে দিতেন পড়ার জন্য। উনিও তাঁর বাবাকে বললেন। আনানো হল ইংল্যান্ড, স্পেন, রোমের ইতিহাস। পাশাপাশি চলল, ‘সোমপ্রকাশ’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ আর ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকার নিয়মিত পাঠ।
কলেজ জীবনেও এর অন্যথা হয়নি। তখন এফ এ পরীক্ষায় পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন পাঠ বাধ্যতামূলক থাকলেও তাঁদের কলেজ মেট্রোপলিটনে ওগুলো পড়ানো হত না। তাই তিনি পাশের প্রেসিডেন্সি কলেজে গিয়ে রসায়নের অধ্যাপক পেডলার সাহেবের বক্তৃতা শুনতেন। নিয়মিত ক্লাসও করতেন।
তিনি ছিলেন স্বর্ণযুগের অন্যতম রত্ন। তিনি যখন জন্মান তার আগে-পিছে দু’চার বছরের মধ্যে জন্মেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও স্বামী বিবেকানন্দ, মোহনদাস করমচন্দ গান্ধী, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, মোতিলাল নেহরু, লালা লাজপৎ রায়, মদনমোহন মালব্য, শ্রীনিবাস শস্ত্রীর মতো শতাব্দীখ্যাত ব্যক্তিত্বরা।
তিনি জন্মেছিলেন ১৮৬১ সালের ২ অগস্ট। অবিভক্ত বাংলার খুলনা জেলার কপোতাক্ষ নদীর তীরে বাঙুলি গ্রামের কাটিপাড়ায়। এক জমিদার পরিবারে। বাবা হরিশচন্দ্র রায়। মা ভুবনমোহিনী। তাঁদের পাঁচ ছেলে তিন মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় সন্তান। ডাকনাম ফনু। চার বছর বয়সে হাতেখড়ির পরে গ্রামের পাঠশালায় তিনি ভর্তি হন। কিন্তু বাবা মায়ের হাচ্ছে, তাঁদের সব ক’টা সন্তানই উচ্চশিক্ষিত হোক। তাই শুধুমাত্র সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর জন্যই তাঁর বাবা মা জমিদারির দায়িত্ব অন্যের উপরে ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। ভাড়া নেন ১৩২ নম্বর আর্মহাস্ট স্ট্রিটের একটি বাড়িতে। ছেলেকে ভর্তি করেন হেয়ার স্কুলে। কিছু দিনের মধ্যেই শিক্ষকদের নজর কাড়েন তিনি। পরে ভর্তি হন অ্যালবার্ট স্কুলে। ১৮৭৯ সালে এখান থেকেই প্রথম বিভাগে পাশ করেন এন্ট্রান্স পরীক্ষা। তার পর এফ এ। পরতে গেলেন বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে। তাঁর প্রিয় বাদ্যযন্ত্র ছিল বেহালা। উনি তা বাজাতেনও।
অজস্র গুণের অধিকারী, পণ্ডিত, বিদ্বান, বিচক্ষণ, সজ্জন, অকৃতদার, সমাজদরদি এই ব্যক্তি ১৯৪৪ সালের ১৬ জুন ৮৩ বছর বয়সে কলকাতার রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের পালিত বিল্ডিংয়ের দোতলার ৩৬ নম্বর ঘরে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ওই বাড়ির পাশ দিয়ে যে বিশাল চওড়া রাস্তাটি ও দিকে শ্যামবাজার আর এ দিকে শিয়ালদহ পর্যন্ত বিস্তৃত, ওই রাস্তাটি এখন তাঁর নামেই চিহ্নিত। এর পরেও কি বলতে হবে, তাঁর নাম কী? তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়।