বাজিমাৎ
ফাহমিদা রিআ
গত রাতে ছােট ফুফু এসেছেন রাজশাহী থেকে ।কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে এসে হাজির। ঊষসী ওর ছােট বােন সমৃদ্ধিকে নিয়ে তখন পড়ায় ব্যস্ত। হঠাৎ ডিংডং ডিংডং। কে এলাে এই রাতে? ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় দশটা। এক ছুটে লুকিং গ্লাসে চোখ রেখেই ওয়াও শব্দ করে দরজা খুললাে উষসী। এবার অনেক দিন পরে এলেন ছােট ফুফু ।দাদীকে সারপ্রাইজ দিয়ে, খাওয়া দাওয়া সেরে ফুফু যখন জার্নির ক্লান্তি মেটাতে বিছানায় গা এলিয়েছেন, উষসীও ফুফুর পাশ ঘেঁসে গুটিসুটি মেরে জায়গা করে নিলাে।
ছােট ফুফুর সাথে অনেক গুলাে শর্তের মধ্যে প্রথম শর্তটাই হলাে কাল সকালে স্কুলে রেখে আসতে হবে, আনতেও।
পরদিন ভাের বেলাতেই স্কুল ড্রেসে সজ্জিত হয়ে মহানন্দে উষসী ছােট ফুফুকে এক প্রস্থ তাড়া দিয়ে বললাে, মনে আছে তাে, আমার স্কুল মর্নিং সিফটে ?চট জলদি ওঠো। অগত্যা ছােট ফুফু তাড়াহুড়াে করে শাড়ি পালটিয়ে চুলে চিরুনী বুলিয়ে দেয়ালের ঘড়িটার দিকে তাকায়। পায়ে সান্ডেল গলিয়ে ডাক দেয়
— ঊষসী আমি রেডি।
ভাগ্য প্রসন্নই বলতে হবে। বড় গেটটা পেরিয়ে রাস্তায় বেরুতেই খালি রিক্সাটা পেয়ে যায় ওরা। ক্রিং ক্রিং ক্রিং বেল বাজাতে বাজাতে ছুটে চলে রিক্সাটা গার্লস স্কুল অভিমুখে।
ফুফুর পাশে বসে উষসীর কথার তুফান ছুটে চলেছে একের পর এক
—- জানাে ফুফু আমাদের ক্লাসের রেহনুমা যা কাণ্ড করলাে সেদিন ।শুনলে তুমি হাসতে হাসতে—
হঠাৎ রিক্সাটা বায়ে মােড় নিতেই কোনের সাদা দ্বিতল বাড়িটা দেখিয়ে বললাে উষসী
—দেখ ফুফু ঐ বাড়িটা আমার বান্ধবী নওয়ালদের। ছােট ফুফু ভাল করে তাকিয়ে বিস্ময়ের সুরে বললেন – ——ধ্যাৎ ওটা তাের বান্ধবীর বাড়ি হতে যাবে কেন। ওটাতাে মীনাদের বাড়ি। আমরা একসাথে পড়তাম। ঊষসী হই হই করে ওঠে
– ছােট ফুফু দুষ্টুমি কোরােনাতাে। আমি জানি ওটা নাওয়ালদের বাড়ি। ওর জন্মদিনে আমি কদিন আগেই এসেছিলাম
— কিন্তু ওটাতাে মীনাদের নিজেদের বাড়ি। আমিওতাে কতবার গিয়েছি ওবাড়িতে।
ঊষসী গাল ফুলিয়ে বলে- তােমার চিনতে ভুল হচ্ছে। ছােটফুফু একগাল হেসে বলে– বেশ, স্কুল ছুটির পর যখন তােকে নিতে আসবাে তখন এই বাসায় গিয়ে তুই আর আমি দুজনেই জেনে আসবাে ওটা আসলে কাদের বাড়ি। মীনা নাকি নাওয়াল। যদি আমার কথা ঠিক হয় তবে তুই কিনবি দুটো চকবার। আর তাের কথা ঠিক হলে
– – – – – দুটো কোন আইসক্রীম।
চেঁচিয়ে বলে ওঠে উষসী।
এরি মধ্যে স্কুল গেটের সামনে রিক্সাটা দাঁড়িয়ে পড়ে ।উষসী কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে হাতে পানির পট ঝুলিয়ে ছােট ফুফুর কপালে টপাটপ দুটো চুমু দিয়ে নেমে এক ছুট। বড় গেট পেরিয়ে সােজা স্কুল মাঠ।
ছােট ফুফু ঐ রিক্সাতেই বাড়ি ফেরত।
ছুটির ঠিক আগে আগেই আবারো স্কুল গেটে হাজির ।ঢং ঢং ঢং ছুটির ঘন্টা বাজতেই বড় গেটটার পুরােটাই খুলে দেওয়া হলো।
অভিভাবক কর্নারের এক পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন ছােট ফুফু। চোখে ভেসে উঠলাে সেই বাগান, মাঠে ছুটাছুটি আর কাঁধের দুপাশে দুটো বেনি ঝুলিয়ে স্কুল ড্রেস পরা সেদিনগুলির কথা। মনে হয় যেন এখুনি গেটে এসে জড়াে হবে আইরিন, মীনা, জুই, রেজিনারা। গেটে এসে ঝালমুড়ি চালতার আচার নিয়ে হল্লা করতে করতে বাড়ি মুখাে সবাই।
“ছােট ফুফু-উ উ”।
ডাক শুনে ভাবনায় ছেদ পড়ে ।চার পাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঊষসীকে খুঁজতে থাকেন ছােট ফুফু। একই রকম ড্রেস পরা সবাইকেই উষসীর মত লাগে। সনাক্ত করতে বার বার ভুল হয়ে যায়।
– এই যে ফুফু আমি।
চমকে সামনে তাকায় ছােট ফুফু । উষসী আকৰ্ণবিস্তৃত হাসি দিয়ে আর একটি মেয়ের হাত বগলদাবা করে সামনে এসে দাঁড়ায় ।
—– বলােতাে ফুফু আমরা এখন কোথায় যাবাে?
ফুফুও তেমনি হেসে মাথা নেড়ে বলেন
——- মীনাদের বাড়ি।
সজোরে মাথা দোলায় উষসী।
—— না না হলো না। আমরা যাবাে নাওয়ালদের বাড়ি। এই দেখাে নাওয়ালকে আমি সাথে এনেছি।
ছােট ফুফু অবাক চোখে নাওয়ালকে দেখেন, বলেন
—— তােমরা কতদিন আগে এ বাড়িতে এসেছাে? এ বাড়িতাে আগে মীনাদের ছিল।
দুচোখে কৌতুহল নিয়ে নাওয়াল জিজ্ঞেস করে
——আপনি আমার ফুফুকে চিনেন ?
——- তােমার ফুফু ?কে?
——–ঐ যে বললেন মীনা।
——– মীনা আমার বান্ধবী , এক সাথেই পড়তাম।
——— ফুফুতাে এখন শ্বশুর বাড়িতে , ঢাকায়।
ছােট ফুফু হেসে উঠলেন হা হা করে।
নাওয়ালের চিবুক তুলে বললেন
–——- এই ব্যাপার! তুমি মীনার ভাস্তি? আমার ভাস্তি ঊষসীর বান্ধবী? অতএব বাজি ডিসমিস।
উষসী চেঁচিয়ে ওঠে।
–—- না হবে না। আমিতাে ঠিকই বলেছি। ওটা নাওয়ালদের বাড়ি , দেখলেতো।
ছােটফুফুও তুড়ি বাজিয়ে বলেন
—- ওটা মীনাদেরও বাড়ি, শুনলিতাে।
নাওয়াল এগিয়ে যায় সামনে, বড় গেট পেরিয়ে চোখের আড়াল মুহূর্তেই।
ঊষসী আর কিছু না বলে বড় বড় পা ফেলে এগুতে থাকে রিক্সার উদ্দেশ্যে। পিছু পিছু এগিয়ে যান ছােট ফুফুও। একটা রিক্সা ঠিক করতেই উষসীকে টেনে থামায় ছােট ফুফু।
—আর একটু সামনে কনফেকশনারীতে। কোন্ আইসক্রিম নাকি চকবার?
ঊষসী মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে বলে
——– তবে যে বললে বাজি ডিসমিস।
——— আরে না। তুইও ঠিক, আমিও ঠিক। জিতে গেছি দুজনেই। ডবল বাজিমাৎ, ডবল আইসক্রীম। চকবার আর কোন্ আইসক্রিম দুটোই চলবে।
ছােট ফুফুর উচ্ছ্বল হাসির সাথে উষসীর বাঁধভাঙ্গা হাসিটাও যােগ হলাে, হি হি হি হি হি হি হি হি…………