অদ্বিতীয়া
[তসলিমা হাসান]
(১)
আজ পহেলা ফাগুন, ফাগুনের আগুন লেগেছে সবার মনে। বসন্ত আজ সমাগম। কৃষ্ণচূড়া লাল হয়ে আছে গাছের ডালে।
শিউলী ও বকুল ফুলের গন্ধ বাতাসে ভাসছে। “রেখা” বাসন্তী রং এর শাড়ী পরে পহেলা ফাগুন অনুষ্ঠানে এসেছে। রেখা ইডেন কলেজে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে বাংলা সাহিত্যে। অপরুপ সুন্দরী ও লাবণ্যময়ী এক মেয়ে সে। প্রথম দেখাতেই চোখ সরাতে পারবে এমন পুরুষ মানুষ খুব কমই আছে। রেখাকে অনেকদিন যাবত পছন্দ করে ও ভালোবাসে জাহিদ। রেখাও জাহিদকে ভালোবাসে। জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের মাস্টার্সে ছাত্র। রেখা ও জাহিদ বরিশালের একই জেলার মানুষ হলেও গ্রাম আলাদা- আলাদা। তবে একসাথে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে, কলেজ তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে তারা। জাহিদ ছেলে হিসেবে বেশ স্মার্ট ও ভদ্র, যেকোন মেয়ে আজকালকার যুগে প্রেমিক হিসেবে এমন পুরুষ মানুষ কে গ্রহণ করবে। এক কথায় পারফেক্ট ম্যান বলা চলে। জাহিদ ও রেখার এই প্রেমকাহিনী পরিচিত বন্ধু সমাজে সবাই মোটামুটি জানে।
জাহিদ হলুদ পাঞ্জাবি পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের কাছে নীলক্ষেত মোড়ে রেখার জন্য অপেক্ষা করছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় পরে রেখা সেজে গুঁজে জাহিদের সামনে এলো, রাসলে মুগ্ধ হয়ে রেখার দিকে তাকিয়ে আছে অপলকভাবে
কাজী নজরুল ইসলামের কন্ঠের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই –
” তোমারে যে চাহিয়াছে ভুলে একদিন, সে জানে তোমারে ভোলা কি কঠিন।”
রেখা : অমন করে কি দেখছ? আমাকে কি আগে কখনো দেখনি?
জাহিদঃ না, আজ সত্যি তোমাকে অন্যরকম লাগছে। বাসন্তী শাড়ীতে তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। প্রিয়া
রেখা : হয়েছে এবার ন্যাকামী রাখো, চলো রিকশা ধরো টিএসসিতে যাবো।
জাহিদ : ঠিক আছে।
অবশেষে অনেক চেষ্টার পরে একটা রিকশা পাওয়া গেলো। কারণ পাবলিক হলি ডে ও বিভিন্ন উৎসবের দিনে ঢাকা শহরে লোকজন একটু সময় কাটানোর জন্য বেশিরভাগ মানুষ বাহিরে বের হয়, তাই যানবাহনে ভিড় হয় ও রাস্তায় জ্যাম বাঁধে। এমনকি রিকশাও মিলেনা রাস্তায়। অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার পরে একটা রিকশা পেলো। রিকশায় উঠে উভয়ে চললো টিএসসিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বসন্ত উৎসবে।
(২)
টিএসসিতে এসে তারা উভয়ে পান্তা ও ইলিশ খেলো জাহিদের ডিপার্টমেন্টের সকল বন্ধু ও বান্ধবীর আয়োজনে করা ছোট অনুষ্ঠানে। তারপর তারা বিভিন্ন সংগঠন ও সাংস্কৃতিক জোটের অনুষ্ঠান দেখলো বসে বসে।
বৈশাখী উৎসবে জাহিদ রেখাকে হাত ভরে রেশমী চুড়ি কিনে দিলো। তারা উভয়ে হাওয়ার মিঠাই,ফুচকা চটপটি খেলো।
সারাদিন বসন্ত উৎসব শেষ করে যে যার রুমে ফিরলো। রুমে এসে জাহিদের হঠাৎ ফোন আসলো বাসা থেকে ফোনের ওপারে তার ছোট ভাইয়ের কান্নাজড়িত কন্ঠ। জাহিদকে তার ছোট ভাই বললো তাদের মা হঠাৎ করে খুব অসুস্থ, বরিশাল মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়েছে, ডাক্তার বলেছে হার্টের সমস্যা।
(৩)
জাহিদ ও তার এক ছোট ভাই ও মা এই নিয়ে তাদের সংসার। জাহিদ যখন ক্লাস নাইনে ও ছোট ভাই ক্লাস ফোরে পড়ে তখন জাহিদের বাবা এক সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যায়। তারপর থেকে জাহিদের মা অনেক কষ্ট ও সংগ্রাম করে জাহিদ ও তার ছোট ভাই কে বড় করেছে। জাহিদের বাবার ব্যবসা ছিল, জাহিদের বাবার মৃত্যুর পরে তার বড় খালা ও খালু তাদের সবদিক থেকে সাপোর্ট করতো। তাদের ব্যবসা জাহিদের বড় খালু দেখাশুনা করতো। জাহিদের বড় খালার শুধু দুই মেয়ে। তাদের বড় মেয়ের নাম সোনালী। রুপালি এবার কলেজে ইন্টারে ভর্তি হয়েছে। ১৬ বছরের সদ্য নতুন কৈশোর ছেড়ে যৌবনে পা রাখা ষোড়শী তরুণী রুপালি। তাদের এলাকায় রুপালি একমাত্র সুন্দরী ও ভদ্র মেয়ে হিসেবে পরিচিত। এই রুপালীকে জাহিদের বউ হিসেবে ঠিক করে রাখে জাহিদের মা ও খালা- খালু মিলে। কিন্তু এটা রুপালি জানলেও জাহিদ কিছুতেই জানে না। কারণ তারা জাহিদের পড়াশোনার ক্ষতি হবে এই ভেবে বিষয়টি গোপন রেখেছে। রুপালি তাই মনে প্রাণে জাহিদকে গ্রহণ করে নিয়েছে নিজের প্রেমিক ও বর হিসেবে। জাহিদকে ঘিরে তার স্বপ্নের দুনিয়া সাজাতে শুরু করেছে।
এইদিকে জাহিদ আর কোন কথা না বলে ব্যাগপত্র গোছাতে লাগলো এর ভিতরে সে রেখাকে ফোন করে সবকিছু বললো। ছুটির দিন হওয়াতে রাস্তায় খুব জ্যাম ছিল, কোনমতে সদরঘাট থেকে পৌঁছে রাত ৯ টায় লঞ্চে উঠলো। লঞ্চ ভোর রাতে বা সকালে গিয়ে বরিশাল পৌঁছে যাবে।
(৪)
রেখাও বরিশাল সদরের এক প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ে। রেখা ও এক ছোট বোন, মা বাবা নিয়ে তাদের সংসার। রেখার বাবা আর্মি অফিসার ছিলেন, কয়েকবছর আগে রিটার্ড করে এখন বরিশাল সদরে বড় ব্যবসা শুরু করেছে। রেখা ছোটবেলা থেকে খুব আদর যত্নে মানুষ হয়েছে। তার হাসি, আনন্দ ও চাওয়া পাওয়াকে তার মা বাবা সব সময় মূল্যায়ন করে।
এইদিকে জাহিদ লঞ্চে বসে বারবার আল্লাহকে ডাকছে মায়ের অসুখের জন্য আর অপেক্ষার প্রহর গুনছে। মাঝেমধ্যে রেখার সাথে ফোনে কথা হচ্ছে। রেখাও জাহিদের মায়ের অসুখের চিন্তায় অস্থির। জাহিদের দুঃখে সেও দুখী। জাহিদকে রেখে মনে প্রাণে ভালোবাসে। দীর্ঘ ৫-৬ বছরের সম্পর্ক তাদের। একে অপরের নিঃশ্বাসের ভাষা বুঝতে পারে।
(৫)
সকালবেলা বরিশাল লঞ্চ ঘাটে নেমে জাহিদ সোজাসুজি চলে গেলো বরিশাল মেডিক্যাল হাসপাতালে। জাহিদের মা কার্ডিওলজি বিভাগে ভর্তি আছেন। ডাক্তার অনেকগুলো টেস্ট দিয়েছে, সেগুলো আজকে করতে হবে। এখন বুক ব্যথাটা কমেছে জাহিদের মা মোটামুটি সুস্থ ও কথা বলছে। জাহিদকে দেখে তার মা হাউমাউ করে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলো, জাহিদও ছোট শিশুর মতো কান্না করছে। একটু পরে পরিবেশ শান্ত হলো। জাহিদ তারপর মাথা তুলে তাকিয়ে দেখলো তার পিছনে একজন দাড়িয়ে আছে ও হাতে হাত রেখেছে, জাহিদের আর বুঝতে বাকি রইলো না এটা রুপালি। জাহিদ রুপালীর দিকে তাকিয়ে দেখলো রুপালির চোখে পানি,জাহিদের কষ্টে সেও কষ্ট পাচ্ছে। জাহিদের খালা ও খালু এসে জাহিদকে স্বান্তনা দিলে লাগলো।
এইদিকে সব টেস্ট করা হলো,ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বললো তার মায়ের ওপেন হার্ট সার্জারী করতে হবে দ্রুত। জাহিদ কথাটা শুনে আকাশ থেকে পড়লো। তার খালা ও খালু টাকার সব ব্যবস্থা করলো কিন্তু সে রাতে অপারেশন থিয়েটারে তার মা মারা গেলো। অপারেশন থিয়েটারে যাবার আগে জাহিদের হাত ধরে তার মা তাকে ওয়াদা করতে বললো যে তিনি যা চাইবেন সেটা জাহিদকে পূরণ করতে হবে। অসুস্থ মাকে খুশি করার জন্য জাহিদ তার মায়ের হাত ধরে কথা দিলো সে তার কথা রাখবে।
মা : জাহিদ, বাবা; আমার শেষ ইচ্ছে তোমার খালাতো বোন রুপালী কে তোমায় বিয়ে করে ঘরে তুলতে হবে।
জাহিদঃ মায়ের কথা শুনে জাহিদ হতভম্ব। কোন কথা না বলে মাথা নাড়লো।
(৬)
জাহিদ কিছুটা বুঝতে পারতো তার খালাতো বোন রুপালী তাকে পচ্ছন্দ করে এবং তার খালা- খালু তাদের বিয়ে দিতে চাই। কিন্তু জাহিদ কখনো এটা গভীরভাবে চিন্তা করে নি। সে রুপালিকে নিজের ছোট বোন মনে করতো। জাহিদ ভেবেছিল পড়াশোনা শেষ করে সে তার ভালোবাসার মানুষ রেখাকে বিয়ে করবে আর ততদিন রুপালি ও পড়াশোনা করে জীবন, জগৎ ও বাস্তবতা সম্পর্কে সবকিছু বুঝবে। আর তখন বিয়ের এই ব্যাপারটি সহজে কেটে যাবে, কোন ঝামেলা হবে না।
মৃত্যুর আগে মায়ের কাছে দেওয়া ওয়াদার কথা স্মরণ করে জাহিদ এখন কিছুটা বিষন্ন। এইদিকে রেখাও জাহিদের মায়ের মৃত্যুতে শোকাভিভূত। সে জাহিদকে আর আগের মতো ফোনে পাচ্ছে না, রেখা ভাবছে মায়ের মৃত্যুর জন্য হয়তো জাহিদ কিছুটা এমন হয়েছে। ঢাকায় আসলে ঠিক হয়ে যাবে
(৭)
মায়ের জানাজা,কাপড়-দাফন সব শেষ করে সব আত্মীয় স্বজন চলে গেলো যে যার বাসায় খালা,খালু, রুপালী ও বাসায় থাকলো। তিন দিন পরে মিলাদ হলো। জাহিদ তার ছোট ভাইকে খালার বাসায় রেখে ঢাকায় আসলো।
এইদিকে জাহিদের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হলো।রেখার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হলো। জাহিদ ঢাকায় আসার পর থেকে রেখার সাথে আগের মতো আর কথা বলতে পারে না মনখুলে, দেখাও করে না। জাহিদ তার মায়ের কাছে করা ওয়াদার জন্য রেখার সামনে নিজেকে অপরাধী মনে করে। পরীক্ষা শেষ হলে ৩৯ দিনের মাথায় জাহিদ তার মায়ের কবর জিয়ারতের জন্য বাসায় ফিরলো। তার মায়ের মৃত্যুর পর থেকে খালা,খালু ও রুপালী আগের চেয়ে আরো বেশি জাহিদের খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করলো। সেদিন সকালে লঞ্চ ঘাটে নেমে জাহিদ দেখলো তার খালু ও রুপালী জাহিদকে বাসায় নেওয়ার জন্য গাড়ী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জাহিদ তার খালুকে সালাম বিনিময় করে রুপালির সাথে পিছনে গিয়ে বসলো। তার খালু গাড়ী ড্রাইভ করতে লাগলেন।
জাহিদের মামা- মামী, চাচারা সহ বেশ কিছু আত্মীয় স্বজন আসলো খালার বাসায়।সেই রাতের সবাই একসাথে বসে তার মায়ের শেষ ইচ্ছে ও ওয়াদার কথা উত্থাপন করলো।
(৮)
উপস্থিত সকলের পক্ষ থেকে জাহিদের বড় মামা কথা শুরু করলেন।
বড় মামা : দেখো বাবা জাহিদ, তোমার পড়াশোনা এখন প্রায় শেষ, শুনলাম তুমি বিভিন্ন জবের চেষ্টা করছ ও পরীক্ষা দিতেছ?
জাহিদ : হ্যাঁ বড় মামা। আমি বিভিন্ন সরকারি জবের পরীক্ষা দিচ্ছি ও বিসিএস দিচ্ছি এবার ৩৮ তম বিসিএস এর আবেদন করেছি,সামনে মাসে প্রিলিমিনারী পরীক্ষা হবে।
বড় মামা: তোমার অনার্সের রেজাল্ট শুনেছি ফাস্ট ক্লাস, মাস্টার্সের রেজাল্ট কেমন হবে?
জাহিদ : আশা করি মামা মাস্টার্সে ফাস্ট ক্লাস হবে।
বড় মামা :- আলহামদুলিল্লাহ বাবা,শুনে খুশি হলাম। এখন ভালো একটা জব হলেই হয়।
(৯)
বড় মামা : জাহিদ হাসপাতালে তোমার হাত ধরে তোমার মা যে ওয়াদা করেছিল সেটা আমরা এখন বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছি। এ ব্যাপারে তোমার কি মতামত?
মামার কথার সাথে উপস্থিত সকলে সুর মেলালেন। জাহিদের তখন চোখের সামনে ভেসে উঠলো রেখার মুখটি। একদিকে মায়ের সাথে করাশেষ ওয়াদা কথার ও নিজের এতদিনের প্রেম। জাহিদ দ্বিধান্বিত হয়ে গেলো।
জাহিদ: হ্যাঁ মামা আমি মায়ের ওয়াদাটা পালন করবো।
উপস্থিত সকলের মুখে হাসি ফুটলো। আর বিয়ের ব্যাপারে কথা শুনে লজ্জায় সেখান থেকে রুপালী অন্য ঘরে চলে গেলো।
এইদিকে রুপালী নিজের রুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। এতদিন যাকে মনে প্রাণে চেয়েছে আজ তাকে বাস্তবে স্বামী হিসেবে পেতে যাচ্ছে। রুপালীর সমস্ত শরীর কামনা বাসনা ও আনন্দে উৎফুল্ল হলো। সে বার বার নিজেকে আয়নার দেখতে লাগলো আর ভাবলো আমার এই ষোড়শী নবযৌবন, আমার শরীর ও মন শুধু তোমার জাহিদ। জাহিদকে সে মনে মনে আলিঙ্গন করলো।
জাহিদের বড় মামা তখন জাহিদকে বললো তোমার পড়াশোনা শেষ আমরা চাচ্ছি তোমাদের বিয়েটা দিয়ে রাখতে। রুপালীকে বউ করে ঘরে রাখলে তোমার ছোট ভাইয়ের খাওয়া দাওয়া ও থাকার আর সমস্যা হবে না। তোমাদের সংসারটা আবার নতুন করে শুরু হবে।
জাহিদ কোন কথা না বলে চুপ করে থাকলো। জাহিদের বড় মামা আগামী শুক্রবার বাদ জুম্মা জাহিদ ও রুপালীর বিয়ে ঠিক করলো।
(১০)
রেখার বিভিন্ন জায়গা থেকে বিয়ে এসেছে এতদিন,রেখা পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করবে এই বাহনায় এতদিন পার করেছে। রেখা এখন মাস্টার্সে। রেখার মা বাবা চায় রেখাকে ভালো একটা পাত্রের হাতে তুলে দিতে। রেখার সাথে আর আগের মতো কথা বলে না জাহিদ,বিভিন্ন অজুহাত ও জবের প্রস্তুতি ও পড়াশোনা চাপ এসব বলে এড়িয়ে যায়।
অবশেষে শুক্রবার বাদ জুম্মা জাহিদ ও রুপালীর বিয়ে হলো।বিয়ের পর একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান হলো। অনুষ্ঠানে নিকটতম আত্মীয় স্বজনকে দাওয়াত করা হয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে সব আত্মীয় স্বজন চলে গেলো। রুপালী অনেক আনন্দে বিয়ের পিড়িতে বসেছিল ও কনের সাজে সেজেছিল।বাসের ঘরে রুপালী অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছে জাহিদের জন্য। জাহিদ এখন বিষন্ন মনে চুপচাপ বসে আছে বাড়ির পাশে পুকুড়পাড়ে। নির্জন রাতে শান্ত পুকুড়ের জল ও আশেপাশের সব গাছপালা যেন জাহিদের কষ্টে কষ্ট পাচ্ছে। জাহিদ মনে-মনে মরে যাচ্ছে। এইদিকে জাহিদকে রেখা আজ সারাদিন ফোন করেছে ৬-৭ বার, জাহিদ শুধু একবার ফোনটা রিসিভ করে বলেছে সে একটা অনুষ্ঠানে বিজি আছে, এই বলে ফোন কেটে দিয়েছে।
আজ রেখাকে জাহিদের বারবার মনে পড়ছে। রেখার পবিত্র মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে, রেখার সাথে ক্যাম্পাসে কাটানো সময় ও স্মৃতিগুলো আজ তার চোখের সামনে ভাসছে। ক্যাম্পাসে একসাথে ঘোরা, চা খাওয়া, আড্ডা ও বিভিন্ন সময় হুটতোলা রিকশায় ঢাকা শহরে দাপিয়ে চলা স্মৃতিগুলো আজ জাহিদকে ভীষণভাবে পিছনে নিয়ে যাচ্ছে।
অপরাধ বোধে ও লজ্জায় জাহিদ যেন মাটির সাথে বিলিয়ে যাচ্ছে।
এইদিকে নতুন বউ তার জন্য অপেক্ষা করছে বাসর ঘরে। কর্তব্যের কথা চিন্তা করে জাহিদ রুমে ফিরে আসলো। শালী ও ভাবি সম্পর্কিত কিছু মেয়ে মানুষেরা জাহিদকে বাসর ঘরে রুপালীর কাছে রেখে চলে আসলো।
(১১)
বাসর ঘর প্রতিটি প্রাপ্ত বয়স্ক নারী পুরুষের জীবনে একটা কাঙ্ক্ষিত রাত। এই রাতের অপেক্ষায় থাকতে হয় দীর্ঘ বছরের। যৌবনপ্রাপ্ত ছেলে মেয়েরা দীর্ঘ দিন,মাস,বছর পেরিয়ে এই মহা রাত পায়। বিবাহিত নারী পুরুষ তথা স্বামী স্ত্রী এইরাতে তাদের জীবনের নতুন অধ্যায় রচনা করে,একসাথে সারাটা জীবন থাকার শপথ নেয়।
জাহিদ বাসর ঘরে ঢুকে দেখলো বাসর ঘর হরেক রকম ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। বিছানার ওপরে বকুল, রজনীগন্ধা ও গাদা ফুল ছিটানো হয়েছে। জাহিদ ঘরে প্রবেশের পরে মেয়েরা সব চলে গেলে রুপালী জাহিদের পা ছুঁয়ে সালাম করলো, তারপর তার হাতে রাখা ফুলের মালা জাহিদের গলার দিলো। মেয়েরা রুমের বাহিরে যাওয়ার আগে জাহিদের হাতেও একটা ফুলের মালা দিয়ে গিয়েছিল। জাহিদও কর্তব্যের কথা মনে করে মালাটি রুপালীর গলায় পরিয়ে দিলো। রুপালী কোন কথা না বলে জাহিদকে জাপটে ধরলো। ষোড়শী যৌবনে পা রাখা একটা মেয়ে জাহিদের বুকের মধ্যে, জাহিদের সারা শরীর উষ্ণ হয়ে গেলো। রেখার কথা তার মনে পড়ছে। কিন্তু একইসাথে জাহিদের মনে পড়ে গেলো অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ” শেষের কবিতা” উপন্যাস।
জাহিদ এখন নিজেকে সেই উপন্যাসের নায়ক অমিত ও রুপালীকে কেতকী ভাবতে লাগলো।
(১২)
জাহিদের বুকে মাথা রেখে রুপালী বলতে লাগলো আমি আপনাকে ছোটবেলা থেকে ভালোবেসেছি, আপনি শহরে থেকেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন, আপনার রুচি ও মনন আলাদ, আমি হয়তো আপনার যোগ্য না কিংবা পচ্ছন্দের মানুষ না।
জাহিদ তখন রুপালীকে বললো অামার একটা অতীত আছে রুপালী, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রেখা নামের একটি মেয়েকে ভালোবাসতাম, তোমাকে ছোট বোনের মতো দেখেছি সারাজীবন, তোমাকে বিয়ে করবো এটা স্বপ্নে ভাবি নি। মায়ের কথায় তোমাকে বিয়ে করেছি কিন্তু কখনো বউ হিসেবে অবহেলা করবো না, কথা দিলাম। আমার জীবনের সত্যটা তোমাকে জানানো উচিত বলে আমি জানালাম।
অল্প বয়সী রুপালী প্রথমে কথাটা শুনে একটু বিব্রত হলো,তারপর জাহিদের কথার পরে বললো সেটা তোমার অতীত, আমি তোমার বর্তমান। আপনি আমাকে সত্য কথা গোপন না করে সোজাসাপটা সবকিছু খুলে বলেছেন, এতে আমি খুশি হয়েছি,আমার মনে আর কোন সন্দেহ নেয়। আমি আপনাকে নিয়ে সুখে থাকতে চাই। এই কথা বলে জাহিদের বুকে আমার নিজেকে সঁপে দিলো রুপালী।
কথায় আছে নারী হলো আগুন আর পুরুষ মানুষ মোমবাতি, দুটা একহলে সব আলোকিত হয় ও অবশেষে সব পুড়িয়ে যায়। বাসরঘরেও তাই হলো। এমন যৌবনবতী মেয়েকে বুকের মধ্যে পেয়ে জাহিদ আর নিজেকে সামলাতে পারলো না, তার আদিম ক্ষুধা ও পৌরুষত্ব জেগে উঠেছে, দেহের সব লোমকূপ শিহরণ জেগেছে। জাহিদ রুপালী মুখটা দুই হাত দিয়ে ধরে কপালে চুমে একে দিলো,তারপর রুপালী ঠোঁট ও গলার নিচে চুমু এঁকে দিলো। এইদিকে উষ্ণ আলিঙ্গনে প্রথম পুরুষের ছুঁয়াতে রুপালীর শরীর ও মন জেগে উঠলো। সে আরো দৃঢ়ভাবে জাহিদকে আঁকড়ে ধরলো। ধীরে ধীরে সমস্ত ঘর জুড়ে তাদের উভয়ের নিঃশ্বাসের শব্দে বাতাস ভারী হয়ে গেলো। সেই রাতে পূর্ণিমার চাঁদ ছিল আকাশে। আর রুপালী ও জাহিদের নতুন জীবনকে সেই পূর্ণিমা চাঁদ আরো আলোকিত করেছে।
(১৩)
বাসর রাত শেষে সকালে তারা উভয়ে বরিশাল সদরে গেলো মার্কেট করতে। এইদিকে রেখাও সেদিন মার্কেটে বের হয়েছে তার মা বাবার সাথে কেনাকাটা করতে। রেখা বহুবার চেয়েছিল জাহিদকে তার মা-বাবার সাথে পরিচয় করে দিতে। কিন্তু জাহিদ বলেছিল জবের পরে সে পরিচিত হবে।
জাহিদকে দেখে চাঁদ দেখার মতো অবস্থা রেখার। কিন্তু জাহিদের সাথে শাড়ীপরা সুন্দরী এক তরুণীকে দেখে রেখা হতভম্ব হলো। সে জাহিদকে তার মা-বাবার সঙ্গে পরিচয় করে দিলো। জাহিদ চুপ করে ছিল,কোন কথা বলতে পারছিল না,লজ্জায় মাথাটা তুলতে পারছিল না। রেখা জাহিদকে বললো মেয়েটা কে?
রুপালি তখন রেখাকে বললো সে তার ওয়াইফ ও কাজিন।
কথাটা শুনে রেখার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো, রেখা কোনমনে নিজেকে কন্ট্রোল করলো,ভিতরে-ভিতরে তার হৃদয় ভেঙে গেলো। সে আর কোন কথা না বলে চলে গেলো।রুপালি বুঝতে পারলো এই সেই মেয়েটি যে তার স্বামীর প্রাক্তন প্রেমিকা।
(১৪)
নতুন বউ ও বর বাসার সকলের জন্য নতুন কাপড় চোপড় ও গিফট কিনে বাসায় ফিরে এলো।
এইদিকে রেখা বাসায় ফিরে জাহিদকে কয়েকবার ফোন করলো কিন্তু লজ্জায় জাহিদ ফোন উঠাতে পারছিল না, অবশেষে সে একবার ফোনটা রিসিভ করে রেখাকে সব কথা খুলে বললো। তখন রেখা বুকের মধ্যে নিজের কান্না ও কষ্ট চেপে জাহিদের জন্য শুভকামনা জানালো।
কিছুদিন পরে জাহিদ ঢাকায় ফিরলো, রেখার আগের নাম্বার সব বন্ধ। রেখাকে এখনও ক্যাম্পাসে খুব মিস করে জাহিদ। রেখা যেন জাহিদের জীবনে অদ্বিতীয়া এক নারী,যে তার পাশে নেয় কিন্তু ছায়া হয়ে রয়ে গেছে।
এভাবে প্রায় ৩ বছর বছর কেটে গেলো। এর মধ্যে জাহিদের মাস্টার্সের রেজাল্ট হয়েছে।
জাহিদ ৩৮ তম বিসিএস দিয়ে বরিশাল সরকারি কলেজে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে। রুপালী এখন অনার্স ২য় বর্ষে পড়ে ও সন্তানসম্ভবা।
ওইদিকে রেখাও বিয়ে হয়েছে, বর ডাক্তার, বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে আছেন। রেখাও বরিশাল সদরে প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার হিসেবে জয়েন করেছে। রেখার ৬ মাসের একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে, তার নাম রেখে অদ্বিতীয়া। জাহিদ রেখাকে সব সময় বলতো তাদের বিয়ের পরে মেয়ে হলে তার নাম রাখবে অদ্বিতীয়া। সেই স্মৃতি স্মরণে রেখা নিজের মেয়ের এই নাম রেখেছে। কয়েক বছর হয়ে গেলো তাদের আর কোন যোগাযোগ নেয়। কিন্তু রেখা ও জাহিদ উভয়ে উভয়ের সম্পর্কে অল্পস্বল্প জানতো বন্ধুদের মাধ্যমে।
(১৫)
এভাবে আরো ২ বছর কেটে গেলো। প্রমোশন পেয়ে রেকা জেলা চিফ প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার হয়েছে আর জাহিদ কলেজের সহকারী অধ্যাপক হয়েছে। বরিশাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে শিক্ষা বিষয়ক এক কর্মশালায় উভয়ে দেখা হলো। প্রথম দেখায় একে অপরকে চিনে ফেললো, সাথে সাথে তাদের উভয়ের মনে বিগত দিনের স্মৃতি জেগে উঠলো।
রেখা : কেমন আছ?
জাহিদ: বেশ ভালো, তুমি?
রেখা : আমিও ভালো আছি, রুপালি কেমন আছে? শুনলাম তোমার নাকি ছেলে হয়েছে? কি নাম রেখেছ?
জাহিদ : রুপালি ভালো আছে, সে এখন পড়াশোনা শেষ করেছে।পুরোদমে সংসারী। আর ছেলের নাম অর্ণব, ২ বছর বয়স।
রেখা :- তুমি কি আমাকে মিস করো? এখনো। আমি তোমাকে খুব মিস করি তবে রাগ,অভিমান ও অভিযোগ এখনো মন থেকে মুছে ফেলতে পারি নি তোমার ওপর থেকে।
জাহিদ : আমি এখনো তোমাকে মিস করি, তুমি আমার জীবনে রবি ঠাকুরের লাবন্য। তুমি আমার অদ্বিতীয়া।
কথা বলতে বলতে দুজনে নিজের মনের অজান্তে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করেছে।
কিছুক্ষণ পরে তারা অনুভব করলো যে তারা বহুদূরে চলে এসেছে।
জাহিদঃ তোমার বর এখন কোথায় আছে? শুনেছিলাম বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে ছিল?
রেখা : হ্যাঁ, এখন ঢাকা সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজে ট্রান্সফার হয়েছে।
জাহিদ হঠাৎ রাস্তার পাশে আইসক্রিমের দোকান থেকে ২ টা আইসক্রিম কিনলো, রেখাকে একটা আইসক্রিম দিলো। তারপর তারা একটা দোকানে বসে ফুচকা খেলো। বহুদিন পরে কিছু সময়ের জন্য দুজনে অতীত জীবনে ফিরে গিয়েছিল।
বিদায় দেওয়ার আগের রেখাকে রিকশাতে তুলে দিলো জাহিদ, রেখা জাহিদকে বললো রুপালি নিয়ে তার বাসায় বেড়াতে আসতে।
শ্বাশত প্রেম মনে হয় এমন সুন্দর ও স্বাভাবিক হয়, যেখানে মনের অজান্তে বিরহ রয়ে যায়।
(১৬)
জাহিদ ও রেখা এখন দুজন দুই জগতের মানুষ, তাদের আলাদা কর্মস্থল, আলাদা সংসার ও পরিবার। জাহিদ ঘুমায় তার সুন্দরী অপরুপা বউ রুপালীর উষ্ণ বুকে। সব অতীত ভুলে রুপালীকে সে নিজের থেকেও এখন বেশি উজাড় করে ভালোবাসে। এইদিকে রেখাও স্বামী হিসেবে যোগ্য এক ডাক্তারকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে।
এতকিছুর পরেও উভয় মনের অজান্তে একশূন্যতা অনুভব করে, এটাই হয়তো শাশ্বত প্রেম। রেখার জীবনে জাহিদ একমাত্র অদ্বিতীয় পুরুষ আর জাহিদের জীবনে রেখাই একমাত্র অদ্বিতীয়া নারী।
নিয়তি ও বাস্তবতাকে মেনে হাসি মুখে সামনে চলার নামই জীবন। আর জীবনের এই বাঁক বদল কে মেনে নিতে হয়।
১ Comment
congratulations