বন্ধন
সৈয়দা রুখসানা জামান শানু
না আমি যাব না-
আমার ময়না পাখি চল্না-
বলছি তো যাব না-।
তুই রাগ করেছিস আমার ওপর?
নাতো- রাগ করব কেনো?
তোর কাছে কী মনে হচ্ছে আমার মুডটা রাগের
না, তা মনে হচ্ছে না-
তবে না যাওয়ার কারণ?
এখন ইচ্ছে করছে না বলতে।
–চল না আমার লহ্মী বোনটি। তোকে আমি তোর পছন্দমত শাড়ি কিনে দেব। শাড়ির সাথে ম্যাচিং জুয়েলারি আর স্যান্ডেলও।
–নারে ইচ্ছে করছে না। মনে হয় আর কখনও এমন গিফ্ট তোর কাছ থেকে নেয়া হবে না।
–এমন কথা বলছিস কেনো বোন? তুই যদি চাস, তোর জন্য আমি বাজেট বাড়িয়ে দেব।
–বাজেট নিয়ে চিন্তা করিস না। আসলে আমি এখন থেকে এ বিষয়ে আর গিফ্ট-টিফ্ট নেব না।
— আমরা জমজ ভাই-বোন। এক সঙ্গে একি ক্লাসে পড়েছি। একসঙ্গে মাঠে খেলা করেছি। আমাদের মধ্যে খুব কম কথা কাটা-কাটি বা খুনসুটি হয়েছে। কখনও আমাকে বাবা যদি কোথাও অল্প সময়ের জন্য নিয়ে যেতেন আর আমার বাড়ি ফিরতে দেরি হলে,তখন তুই সারা বাড়ি কেঁদেকুটে জলে ভাসিয়ে দিতিস। মনে পড়ে তোর?
— হ্যা দাদা, খু-উ-ব মনে পড়ে। কত মধুর স্মৃতি এখনও চারপাশ আমাদের নিবীড় বন্ধনের কথা জানান দেয়। এইতো বছর কয়েক হবে, আমাদের পাশের বাড়ির খালাম্মা
তাঁর দুই রুপবতী কন্যা বেলী-চামেলীর সারাদিন দুষ্টুমির জন্য কতনা ধমকাধমকি করতেন আর বলতেন শর্মিষ্ঠা এবং শাউনের কাছ থেকে তোদের শিক্ষা নিতে হবে। গিয়ে দেখ তারা দুভাই-বোন কত মিলে-মিশে থাকে। সারাদিন একটা টু-শব্দ পর্যন্ত হয় না। আর তোরা কীনা আমার মান-সম্মান ডুবিয়ে দিলি।
আরো মনে পড়ে দাদা, দিনের সূর্য যখন সন্ধ্যার আকাশে মিশে গোধূলি ছড়িয়ে দেয় তখন আমরা দু’জন খোলা মাঠে বসে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। মা আমাদের জন্য সন্ধ্যার নাস্তা ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে সদর দরজায় অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমরা বাড়ি ফিরে তড়ি-ঘড়ি করে হাত-মুখ পরিস্কার করে খেয়ে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে টেবিলে পড়তে বসতাম। হাল্কা শীতে মায়ের বিছানার সিথানে রাখা বালি রঙের নরম শালখানা আমরা দুজনেই জড়িয়ে পাশা-পাশি চেয়ারে বসে পড়তাম। মা এ দৃশ্য দেখে আমাদের দুজনকে দুটো আলাদা শাল দিয়ে গায়ে জড়িয়ে দিয়ে রান্না ঘরে চলে যেতেন। কত আনন্দঘন স্মৃতি আমাদের পুরো জীবন জুড়েই রয়েছে দাদা।
তোমার মনে পড়ে দাদা, একদিন আমি তোমার প্যান্ট-শার্ট পড়ে সন্ধ্যায় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি, এমন সময় অঞ্জলি আপুর আম্মু তাড়াহুড়া করে হাতে ব্যাগ নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন, আমি আন্টির গায়ে হাত দিয়ে বললাম আন্টি কৈ যাচ্ছেন? আন্টিতো একেবারে বোমা ফাটানো গরম হয়ে উঠলেন আমার ওপর যা ইচ্ছে তাই গালা-গালি শুরু করলেন-। তাঁর দুএকটি গালাগালি এখনও মনে আছে। অই আন্টিতো যেসব গালি মুখে দিলেন তা ভাষায় প্রকাশ করলে আমিও লজ্জা পাব। তাই শোভন গালটি বলি তোকে, তিনি আমায় বলেলন এই ছেলে তোর মা-বোন নেই? তোর এত্ত বড় সাহস আমার গায়ে হাত দিয়েছিস? ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি তখন দিব্য বুঝতে পারলাম ওনি আমাকে ছেলের পোশাকে চিনতে পারেননি। নিজেকে প্রাণপনে বাঁচানোর জন্য আমি তো বাড়িতে না ঢুকে মাঠে পালিয়ে গেলাম। এরপর তার চিৎকার আর চেচামেচিতে দ্রæত রাস্তায় লোকজনের ভিড়। আন্টি গালাগালির সাথে বলতে থাকলেন ছেলেটি অইদিক দিয়ে পালিয়ে গেলো। এরই মধ্যে আমি মাঠের দক্ষিণ দিক দিয়ে বাড়ির পিছন দেয়াল টপকিয়ে বাড়িতে ঢুকে পোশাকটি পরিবর্তন করে জানালা দিয়ে দেখি তখনও ভিড় কমেনি। কিছুক্ষণের মধ্যে তুই বাজার থেকে ফিরলি। বিষয়টি তখন তোকে জানায়নি।
–হ্যারে বোন, দিদি বলে কখনও ডাকিনি তোকে। এ পাড়ায় কেউ তোকে দিদি বলে ডাকে না। সবাই আপা বলে,আবার কেউ কেউ শর্মিষ্ঠা আপা বলে ডাকে। আমাকেও শাউন ভাইয়া বলে ডাকে। আমাদের মহল্লায় হিন্দু-মুসলিম বাইরে থেকে চেনার উপায় নেই। শর্মি প্লিজ চল রাত হয়ে যাচ্ছে, তোর গিফ্টা কিনে দি। কালতো তুই ঠিকই শিক্ষক দিবসে তোর সব কলিগদের জন্য গিফ্ট নিয়ে যাবি। শিক্ষক দিবসের র্যালিতে
আনন্দ উৎসব করবি। সকল শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবি। ক্যামেরায় ছবি তুলবি আবার আনন্দ চিত্তে ফেসবুকে আপলোড করবি। শুধু আমার বেলায় এমন করছিস কেনো? এর আগের বছরগুলোতে কখনও তুই এমন করিসনি?
— হ্যাঁ করি নাই, কারণ একটি। তখন বিষয়টি গভীরভাবে আমার মনে রেখাপাত করেনি। এখন করেছে। আর তুই শিক্ষক দিবসের কথা বলছিস, তবে শোন্- কারণ মেয়ে এবং ছেলে শিক্ষক বলে কোনো তফাৎ নেই। দিবসটি উভয়ের জন্য। তাই আমি এটি পালন করব। কিন্তু আমাকে বিস্তরভাবে বুঝিয়ে বলতে পারবি বোনেরাই শুধু ডাকবে সব ভাইদের ফোঁটা দিতে। ¯েœহ মায়া-মমতা আর ভালোবাসা এসবিতো থাকবেই তোর জন্য। কিন্তু শুধু ভাইয়ের মঙ্গল ও দীর্ঘায়ু কামনা করে তোর কপালে ফোঁটা দিয়ে একচোখা অনুষ্ঠান নয় কী? এ ক্যামন বন্ধন তুই বল্? নারী না থাকলে কে দেবে ভাইয়ের কপালে আয়ুর জন্য ভাই ফোঁটা? আর যমের দুয়ারে পড়বে কাঁটা? পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে হোক না আবদ্ধ ভাই-বোন। বোনের কপালে ফোঁটা দিয়ে ভাই বলুক, ‘বোনের ভালো বোনের ফোঁটা বাড়তে থাকুক তোর আয়ুটা।