নৌকা বাইচ ও বাইচের গান
হারুনুর রশীদ
আমাদের দেশ নদীমাতৃক দেশ। শুধু এদেশের নয়, সারা পৃথিবীর জনবসতিগুলো গড়ে উঠেছে মূলত নদীকেন্দ্রিক। ইতিহাসের ভাষায় বলা হয় সভ্যতা। যেমন সিন্ধু সভ্যতা, পাঞ্জাব সভ্যতা, আরব সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা, চৈনিক সভ্যতা। এই সভ্যতার আড়ালে বহু অসভ্যতা যেমন অত্যাচার, জুলুম, লুটপাট, ডাকাতি, হত্যাযজ্ঞ, জবরদখল এসব অধিকাংশই নদীকেন্দ্রিক হয়ে থাকতো। অসভ্যতায় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও দুর্ধর্ষ ছিলো জলদস্যুরা।
ভারতবর্ষে আগমণের কাল থেকেই মুঘলদের রণকৌশল ছিলো বৈচিত্র্যময় ও নতুনত্বে অনন্য। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে বাংলা সুবা (প্রশাসনিক অঞ্চল/প্রদেশ)-র রাজধানী মুঙ্গের হইতে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সেনাপতি ইসলাম খাঁ তখন অত্যাচারী মগ জলদস্যুদের দমন করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সেনাপতি ইসলাম খাঁ বিশাল ক্ষমতাধর নৌ-বাহিনী গঠন করেন। সেই আমলে অন্যান্য নৌকা থেকে অনেকটাই আলাদা ধরনের এক প্রকার নৌকা তৈরি করেন। যা দৈর্ঘ্যে একশত গজ পর্যন্ত এবং প্রস্থে মাত্র দুই-তিন গজ ছিলো। নৌকার দুই ধারে সারি বেঁধে সেখানে সশস্ত্র মাঝি তথা নৌসেনা থাকতো। এ ধরনের নৌকা দিয়ে অত্যন্ত ক্ষীপ্র গতিতে শত্রুদের ওপর আক্রমণ করতে পারতো। শত্রুপক্ষ পালাবার সুযোগ পর্যন্ত পেতো না। আবার অভিযান শেষ করে অতি দ্রুত ফেরত আসতে পারতো।
যুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের জন্য এসব নৌকা চালাতে হতো। যুদ্ধ ছাড়াও বিভিন্ন উৎসব আয়োজনে কখনও প্রদর্শনী, আবার কখনও প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। এসব দেখে জনসাধারণ যেমন আনন্দ উপভোগ করতো। তেমনই দেশের সামর্থ্য ও সক্ষমতা দেখে গর্ববোধ করতো। এই প্রদর্শনী থেকেই ক্রমে ক্রমে নৌকা বাইচের প্রচলন শুরু হয়।
এই নৌকার দুই ধারে সারিবদ্ধভাবে মাঝিরা বৈঠা নিয়ে বসে। মূল বাদ্যযন্ত্র হলো ডঙ্কা। একজন ডঙ্কা বাজায়, আর সেই ডঙ্কার তালে তালে তাল মিলিয়ে সবাই বৈঠা চালাতে থাকে। পেছনে নৌকার গলুইতে একজন হাল ধরে থাকে, নৌকার ভারসাম্য রক্ষা করে এবং প্রয়োজনীয় দিক পরিবর্তন করে। অনেক সময় নৌকার সামনের অংশে একজন মাঝি তার বৈঠা দিয়েই মাঝে মাঝে দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। কাজে একাগ্রতা ও মনোবল বৃদ্ধি এবং গায়ে জোস আনতে ডঙ্কা ও বৈঠার তালে তালে নানা ধরনের গান গাওয়া হয়। সারিবদ্ধভাবে সবাই মিলে গান গাওয়া হয় বলেই এই ধরনের গানগুলোকে বলা হয় সারি গান। বলা বাহুল্য যখন বাইচের মূল প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তখন গান গাওয়ার তর সয়না। ডঙ্কার তালে তালে দ্রুত বৈঠা চালাতে থাকে। সাধারণত ধর্মীয় অনুভূতিতে স্রষ্টাকে স্মরণ করে সূচনা সঙ্গীত শুরু হয়।
মুসলমানগন শুরু করে এভাবে —
নারায়ে তাকবীর —- আল্লাহু আকবার।
নারায়ে তাকবীর —- আল্লাহু আকবার।
আল্লাহ বলি সামনে চলি শোনো মা বোন ভাই। হো-ও-ও—-
পায়ে ধরে সেলাম করে বাইচ খেলাতে যাই।
আহা বেশ বেশ বেশ।….
আবার হিন্দু প্রথা অনুযায়ী এভাবে শুরু করে —
(একজন) — প্রথমে বন্দনা করি নিত্যানন্দ গৌরহরি
(সমবেত) — নিত্যানন্দ গৌরহরি, নিত্যানন্দ গৌরহরি ….
তার পরপরই গায় নিজেদের পরিচিতি মূলক গান, সামাজিক বন্ধনের গান। যেমন —
** আমাদের নাও সেরা, বলে দেশ-বিদেশের লোক।
অন্তরেতে শান্তি লাগে গর্বে ভরে বুক।
আহা বেশ বেশ বেশ।
** এই নৌকা বানাইয়াছে যেই কারিগরে
তার মত মিস্তরি নাই এই ভব সংসারে।
** হেঁইয়া রে হেঁইয়া, হেঁইয়া রে হেঁইয়া।
ডঙ ডঙা ডঙ ডঙ।
ঘন্টা টা বাজে ডঙ।
কাশি বাজে ডঙ।
ময়ূরপঙ্খী ছুইটা চলে মনে লাগে রঙ রে
দেলে লাগে রঙ।
** বৈঠা নিয়ে ছুইটা চলি আমরা শতেক ভাই।
নায়ের মাঝি আবুল গাজি তুলনা তার নাই।
আহা বেশ বেশ বেশ।
** আঁকাবাঁকা হয় না যেন সোনার মাঝি ভাই ও রে।
লম্বা কইরা খাড়া বৈঠা মারো সোনার ভাই ও রে।
ধীরে চালাও সোনার তরী রে।
কখনও রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার গান। কখনও নর-নারীর প্রেম বিরহের গান ভেসে ওঠে মাঝিদের গলায়।
** পূবালী বাতাসে শাড়ি ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে।
আইজ আমার বন্ধু নাই ঘরে।
হো -ও-ও-ও–
বন্ধু থাকে বিদেশেতে আমি থাকি দেশে রে।
(ও কি ময়নারে) আইজ আমার বন্ধু নাই ঘরে।
প্রেম পিরিতের গানের কথার গভীরতা অনেক সময় এতটা ভিতরে ঢুকে যায় যে ভদ্র সমাজ তাকে অশ্লীল বলতেই পারেন।
** তারাগঞ্জের বাজারেতে নয়া নাকফুল নাইমাছে।
ভাগনি জামাই নাকফুল কিন্যা দে।
** আমার রশিক ভাগিনা।
অসুখ বেসুখ কিছুই মানে না।
হো-ও-ও-ও–
স্বামী আমার যেমন তেমন,
ভাগ্নে মনের মতন।
হো-ও-ও-ও–
রঙ্গ রসের কথা বলে, শরম ভরম রাখে না।
অসুখ কিছুই মানে না।
হো-ও-ও-ও–
** খাটের উপর শীতলপাটি তবুও মামীর গাও ঘামে!
এই মামিরে রাখবো কেমনে ?
আহা বেশ বেশ বেশ।
মুখরোচক এসব গান শুনে দর্শক-শ্রোতাগণ খুব আনন্দিত হয়। পর্দাশীলা মহিলারাও শাড়ির আঁচল টেনে মুখ লুকিয়ে হাসতে থাকে। তখন কেউ অশ্লীল বলে না। বরং এ ধরনের আরও কিছু গানের অনুরোধ করতে থাকে।
আবার কখনও জীবন কাহিনী ভিত্তিক পালা গানের মত সারি গান গাইতে থাকে।
** ফুলমালারে পড়তে দিলো গ্রামের পাঠশালায়।
বই, পেন্সিল, সিলেট নিয়ে পড়া পড়তে যায়।
ও -রে ঢেউ তুলিয়া বান্দে খোঁপা ,
হাতে লাগায় ঘড়ি রে।
নামটি তাহার সুরেন বাবু বড়ই ভাগ্যবান।
সিন্দুক ভরা টাকা তাহার, গোলা ভরা ধান।
ও-রে ঢেউ তুলিয়া বান্ধে খোঁপা,
হাতে লাগায় ঘড়ি রে।
বাইচে জয়লাভ করে এলাকাবাসীকে কৃতিত্বের ভাগিদার করতে ভুল করে না নৌকার মাঝিরা। তখন গায় —
** আশ-পড়শি ছোট বড় সবার দোয়া নিয়াছি।
নাও খেলাইয়া মেডেল/টিভি/সাইকেল পাইয়াছি।
আহা বেশ বেশ বেশ।
গাঁয়ের মোড়ল আক্কাস আলীর টেকা পয়সা খাইয়াছি।
নাও খেলাইয়া মেডেল পাইয়াছি।
আহা বেশ বেশ বেশ।