৭৬ বার পড়া হয়েছে
ড. ইউনূস কেন উদ্যোক্তা হতে বলেন?
কাজী জহিরুল ইসলাম
ড. ইউনূস তিন শূন্যের কথা বলেন, তার একটি হচ্ছে, বেকারত্ব-শূন্য পৃথিবী। অর্থাৎ পৃথিবীতে কর্মক্ষম কোনো মানুষ বেকার থাকবে না। সেটা কী করে সম্ভব? সাংবাদিক শফিক রেহমান বহুদিন পর দেশে ফিরে এসেছেন। ঢাকা বিমান বন্দরে নেমেই তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঘরে ঘরে চাকরি হতে হবে’ আর আমাদের সরকার প্রধান ড. ইউনূস বলেন, ‘চাকরির কথা ভুলে যাও’। তাহলে এই বিশাল বেকারত্ব ঘুচবে কী করে? লোকটা কি পাগল? এই পাগলকে সারা পৃথিবীর মানুষ এতো সম্মান করে? এতো এতো পুরস্কার দেয়?
৮৪ বছরের এই তরুণের কথা শফিক রেহমান বোঝেন না, আমি বুঝি না, কিন্তু তার যারা সতীর্থ, আজকের জেন জি, মানে জেনারেশন জেড [আমেরিকাতে জেড অক্ষরটিকে জি বলা হয়], তারা ঠিকই বুঝতে পারেন।
কীভাবে ড. ইউনূসের উদ্যোক্তা হবার কথা জেন জি বুঝতে পারে তার একটি উদাহরণ আমার নিজের ঘর থেকেই দিচ্ছি। আমার ছেলে অগ্নির জন্ম ১৯৯৭ সালে। ওর জন্মের সাল থেকেই জেনজি প্রজন্মের শুরু। পাঁচ বছর বয়সে অগ্নি আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ বিধ্বস্ত কসোভোতে যায়, সেখানে ছয় মাস থেকে ফিরে আসে দেশে, আমি এবং ওর মা মুক্তি জহির আরো কিছুকাল যুদ্ধের দ্রোহে পড়া সেইসব মানুষদের পাশে ছিলাম। অগ্নি ছিল ঢাকায়, দাদা, দাদী, ফুপু, চাচাদের সঙ্গে। ও প্রথমে টার্কিশ হোপ, পরে গ্রিন ডেল, অরণি বিদ্যালয় হয়ে সি-ব্রিজ স্কুলে পড়ে। চতুর্থ শ্রেণিতে উঠেই একদিন ওর মা আর ছোটো বোনকে নিয়ে হাজির হয় পশ্চিম আফ্রিকায়, অতলান্তিকের বুনো ঢেউ যেখানে আছড়ে পড়ে সেই উপকূলে, আইভরি কোস্টে। আমি তখন আইভরি কোস্টের রাজধানী আবিদজান শহরে কাজ করি।
ওদের বলি, দেশে যেও না, আমার সঙ্গেই থেকে যাও, এখানে যুদ্ধের ভয়াবহতা তেমন নেই। ওরা থেকে যায়। অগ্নি পঞ্চম শ্রেণি ডিঙিয়ে ভর্তি হয় ষষ্ঠ শ্রেণিতে, একটি ব্রিটিশ স্কুলে।
কন্যা জল একজন অটিস্টিক শিশু, ওর জন্য ভালো সার্ভিস পাওয়া যায়, বসবাসের জন্য আমরা এমন একটি দেশ খুঁজছিলাম। পেয়ে গেলাম, দেশটির নাম ইংল্যান্ড। ২০০৯ সালের জুন মাসে আমরা লন্ডনে চলে যাই। অগ্নি আবারও ক্লাস ডিঙোলো, সপ্তম শ্রেণি না পড়েই ভর্তি হলো অষ্টম শ্রেণিতে। ইংল্যান্ডে ১৩ বছরের স্কুল। ও যখন একাদশ শ্রেণি পার হলো তখন আমি নিউইয়র্কে একটি চাকরি পাই, ইংল্যান্ডের তল্পিতল্পা গুটিয়ে, মানে বাড়ি-ঘর বেচে দিয়ে চলে আসি নিউইয়র্কে। আমি আসি ২০১১ সালের নভেম্বরে, ওরা আসে ২০১৩ সালের জুন মাসে।
এখানে এসে অগ্নি ভর্তি হয় ইউএন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। লন্ডনের বন্ধুদের হারিয়ে ওর খুব মন খারাপ। আমাদের বলে, ২ বছরের স্কুল শেষ করে আমি কিন্তু ইংল্যান্ডে ফিরে যাবো, অক্সফোর্ডে পড়বো। আমরা ছেলেকে ছাত্রাবস্থায় কিছুতেই দূর দেশে যেতে দিব না, মুখের ওপর তা না বলে, বলি, আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু ছ’মাস পরেই সে ইংল্যান্ডের কথা ভুলে যায়, নিউইয়র্কে ও গড়ে নেয় নতুন বন্ধুমহল।
যখন ইংল্যান্ডে ওরা ছিল, আমি কখনো আইভরি কোস্টে, কখনো সুদানে কাজ করতাম। প্রতি ছ’সপ্তাহ পরে দু’সপ্তাহের ছুটিতে আসতাম লন্ডনে। সেই দু’সপ্তাহ জুড়ে থাকত আমাদের উৎসব। ছেলের সঙ্গে টেবিল-টেনিস খেলা, বিভিন্ন পার্কে যাওয়া, রেস্টুরেন্টে যাওয়া, দাবা খেলা, বাগান করা, বাজার করা, প্রায় সব কিছুই আমরা চারজন একসঙ্গে করতাম। আমি ওকে দেশ বিদেশের গল্প বলতাম, বিখ্যাত মানুষদের কথা বলতাম, ও মন দিয়ে শুনত। আমাদের পরিবারের একটা ম্যাজিক ট্রিক ছিল, প্রায়শই চারজন একসঙ্গে গ্রুপ হাগ দিতাম। কারো মন খারাপ হলেই আমরা গ্রুপ হাগ দিতাম, এতে আমরা সবাই চাঙা হয়ে উঠতাম। অগ্নি খুব সেন্সেটিভ ছেলে, ও প্রায়শই ভেঙে পড়ত। ওর দাঁত অসমান ছিল, এ-নিয়ে স্কুলে কেউ কিছু বলেছে তো ওর মন খারাপ। ওর নাম নিয়ে কেউ বিকৃত উচ্চারণ করেছে তো ওর মন খারাপ। তখন আমি বলতাম আসো তোমাকে পাওয়ার দিই। বলেই একটা টাইট হাগ দিতাম। ওর মন ভালো হয়ে যেত। ও প্রায়শই বলত, আব্বু লেকচার দাও, আই ওয়ান্ট টু লার্ন সামথিং নিউ। তখন আমি নতুন কোনো বিষয়ে ওকে একটা গল্প শোনাতাম। ও খুব মন দিয়ে শুনত, আর মন খারাপ হলেই বলত, আব্বু পাওয়ার দাও। আমি বুঝতাম যে ছয় সপ্তাহ আমি ওদের কাছে থাকতাম না, সে সময়টা ছেলে তার বাবার জন্য কী অধীর প্রতীক্ষা করত কিন্তু কখনোই সে তার ইমোশন মায়ের কাছে প্রকাশ করত না। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় সে মাকে রান্নাঘরের কাজে সাহায্য করত, অল্প-স্বল্প বাজার করে আনত, নিজের খাবার নিজে তৈরি করে খেত, ডিশ ক্লিন করা ঘর ভ্যাকুয়াম করা এগুলো ছিল ওর জন্য নির্ধারিত কাজ।
যখন আমরা নিউইয়র্কে, হঠাৎ একদিন ওকে শ্রীমৎ ভগবৎ গীতার মূল দর্শন যে নিস্কাম কর্ম তা বোঝাই। বিষয়টা ওকে এতো আকর্ষণ করলো যে ও রীতিমতো এই বিষয়ে আরো জানার জন্য পাগল হয়ে গেল। আমি নিশ্চিত ও গীতা, রামায়ন, মহাভারত, বেদ পড়ে ফেলেছে, কারণ আমি ওর পরবর্তী বহু আলোচনায় এসবের প্রভাব দেখেছি।
ইউএন স্কুল থেকে পাশ করে সে অ্যাস্ট্রো ফিজিক্স পড়তে চায়। আমি বলি, যদি তুমি সুপার-ডুপার রেজাল্ট করতে না পারো তাহলে নাসায় কাজ করার সুযোগ পাবে না। এই বিষয়ে অন্যত্র চাকরির সুযোগ কম, তুমি বরং অন্য কিছু ভাবো। ওর মন খারাপ হয়, তাহলে ফিজিক্স পড়বো, অধ্যাপনা করবো, গবেষণা করবো, আমি বিজ্ঞানী হতে চাই। আমি বলি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লে কেমন হয়? ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েও তো নানান কিছু আবিস্কার করা যায়। আমি খুব জোর করি না কিন্তু ওই যে আমার, আমাদের মাথায় আছে পড়াশোনার পরে একটা ভালো চাকরি, সেই চিন্তা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেখান থেকে কিছুতেই বের হয়ে আসতে পারি না। একই সঙ্গে এও মনে পড়ে, আমিও বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিলাম, নবম শ্রেণিতে উঠে সায়েন্স পড়তে চেয়েছিলাম। আমার বাস্তববাদী বড়ো মামা আমাকে সায়েন্সের ক্লাস থেকে তুলে এনে কমার্সের ক্লাসে ঢুকিয়ে দিয়ে বলেন, তোমার বাবার আর্থিক সঙ্গতি নেই তোমাকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বিজ্ঞানী বানাবার। কোনো রকমে বি,কম পাশ করে একটা চাকরি নাও, সংসারের হাল ধরো। আমার ছেলের তো সংসারের হাল ধরতে হবে না, কিন্তু ওর ভবিষ্যতের পথ যেন মসৃণ হয় সেটা কী আমি ভাববো না? অগ্নি রাজি হয়। বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হয়।
তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় একটি ৩০ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে ইন্টার্নিশিপ করার সুযোগ পায়। ইন্টার্নশিপের ইন্টারভিউতেও ও নিস্কাম কর্মের দর্শন বোঝায় ইন্টারভিউ বোর্ডকে। এতেই ওরা মুগ্ধ হয়ে যায়। ওয়ার্ক পারমিট জটিলতায় ও ঠিক সময়ে যোগ দিতে পারেনি। সবাই কাজ করে তিন মাস, ও কাজ করে মাত্র পাঁচ সপ্তাহ। এই কোম্পানি প্রতি বছর আগস্টের শেষ সপ্তাহে ইন্টার্নদের নিয়ে একটি কর্মশালা করে, ফ্রেশ ব্লাডের কাছ থেকে পরামর্শ আহ্বান করে। কর্মশালা হয় আটলান্টায়। ও যেহেতু মাত্র পাঁচ সপ্তাহ কাজ করেছে, ওকে আলোচক হিসেবে তালিকায় রাখেনি কিন্তু অগ্নি নাছোড়বান্দা, ওর কাছে দারুণ সব আইডিয়া আছে, সেগুলো বলতে চায়। ওর অতি আগ্রহে কর্তৃপক্ষ জানায়, ঠিক আছে শুক্রবার সকালে নাশতার টেবিলে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় তোমার আইডিয়াগুলো শুনব। কিন্তু বৃহস্পতিবার বিকেলেই, ফর্মাল সেশনে কিছুটা সময় বেঁচে যাওয়ায় ওর ডাক পরে। অগ্নির বক্তৃতা শুনে কম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট উঠে এসে ওকে হাগ দেয় এবং সকলের সামনেই ওকে ৯০ হাজার ডলারের চাকরি অফার করে। শর্ত হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে কাজে যোগ দিতে হবে। অগ্নি আমাদের সঙ্গে আলাপ করে প্রস্তাব গ্রহণ করে। আমরা তো মহাখুশি।
পরের বছর, যখন সে ফাইন্যাল ইয়ারে পড়ছে, একদিন বস্টন থেকে ফোন করে ওর মাকে বলে, আম্মু আমি জব অফারটা ফিরিয়ে দিচ্ছি। শুনে তো আমার মাথা খারাপ। বলে কী এই ছেলে। এতো ভালো চাকরির অফার। সবচেয়ে বড়ো কথা গ্রিন কার্ডের জন্য ওর একটা ভালো জব স্পন্সরও লাগবে। ও বলে, আমি এটা চিন্তাই করতে পারছি না, আমার মেধা ও শ্রম অন্য একজনের জন্য বিনিয়োগ করবো। আমার শ্রম ও মেধায় লাভবান হবে অন্যজনের কম্পানি। আমি বলি, তুমি আসলে কী করতে চাও? ও বলে, আমি মানুষের জীবন বদলে দিতে চাই। আমি মানুষের ক্ষমতাকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই, তখন সে যা করেত চায় তাই করতে পারবে। বিষয়টা ইন্টারেস্টিং কিন্তু এই কাজ করে তোমার কাছে টাকা আসবে কী করে? ও আমাকে ওর ব্যবসায়ের ধরণটা বোঝায়। আমার কাছে মনে হয়, এসব সাস্টেইনেবল হবে না, এর চেয়ে নাইন টু ফাইভ চাকরিই ভালো। কিন্তু ও কিছুতেই শুনবে না। আমাদের বাপ বেটা বেশ তর্কাতর্কি হয়, উত্তেজিত তর্ক হয়। ওর মা ছেলের পক্ষ নেয়। আমি এক পর্যায়ে বলি, ঠিক আছে, তোমাকে দুই মাস সময় দিলাম। এই দুই মাসে তুমি যদি পাঁচ হাজার ডলায় আয় করে দেখাতে পারো তাহলে বুঝবো তুমি পারবে। ও চ্যালেঞ্জটা নেয় এবং দুই মাসে কুড়ি হাজার ডলার আয় করে দেখায়। আমি বলি, গো অ্যাহেড। অগ্নি পড়াশোনা শেষ করে নিউইয়র্কে ফিরে আসে। পূর্ণ মেধা ও শ্রম ঢেলে ওর কম্পানি সাজায়। দোতলায় অফিস সাজায় এবং অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রতি মাসে আমাকে আড়াই হাজার ডলার অফিস ভাড়াও দেয়।
এখন অগ্নির মাসিক আয় মাসে প্রায় দুই লক্ষ ডলার। ওর কম্পানিতে কাজ করে অনেকেই বছরে এক লক্ষ বিশ হাজার ডলায় আয় করছে।
ড. ইউনূস সময়ের চেয়ে কত বেশি এগিয়ে থাকেন তা আমরা না বুঝলেও বুঝেছে সারা পৃথিবী। জাপানের একটি বিখ্যাত কম্পানির সিইও [সম্ভবত টয়োটার] তার সঙ্গে এক ঘন্টা কথা বলার জন্য অনেক অনেক দিন অপেক্ষা করে অবশেষে প্লেনে তার পাশের সীটে বসার সুযোগ পান। সেখানেই তার কথা সারেন। তিনি শুধুমাত্র ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করার জন্যই প্লেনে চড়েছিলেন।
ড. ইউনূস এখন একটি প্লেনের ককপিটে বসে আছেন, প্লেনটির নাম বাংলাদেশ, আমরা সবাই এই প্লেনের যাত্রী। এই প্লেনের জ্বালানীর নাম স্বপ্ন। দেখি না তিনি প্লেনটিকে কোথায় নিয়ে যান।
________________________________________________________________
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৮ আগস্ট ২০২৪।