ছাতার ফি।
বিপ্লব মৈত্র
ছোট বেলার বন্ধু আজাদ। মোটাসোটা গড়ন। খুব আনন্দ প্রিয় ছিল। ওর বাবা দাউদ তখন একটা বেসরকারি কলেজের পিয়ন। কলেজটা আমাদের উপজেলা সেমি শহরে। অল্প বেতন।পায়ে হেটে ছয় মাইল পথ যায় ও আসে।তিনিও বেঁটে, মোটা গড়নের। চাচা বেশ জোরে হাঁটতে পারতেন। হাঁটার সময় ভূরি টা বেশ সুন্দর দুলতো। বছর পাঁচেক হলো চাচা গত হয়েছেন। ছোট বেলার অনেক স্মৃতি আছে তার সাথে। তিনি আমার বাবার ছাত্র ছিলেন।সে হিসাবে আমাকে একটু বেশিই আদর করতো।
চাচা রোজ একটা পুরাতন ছাতি (শত ছিদ্র) মাথায় দিয়ে কলেজে যেতেন। দূর থেকে মনে হতো একটা ছাতাই যেন সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। একদিন দেখি চাচার মাথায় নতুন ছাতা। মুখ টাও বেশ হাসি হাসি।সামনে যেতেই চাচা বলল, বাবা কেমন আছো, স্যার ভালো আছেন তো। আমি বললাম ভালো আছি চাচা। জিজ্ঞেস করলাম,ছাতাটাতো বেশ সুন্দর চাচা।চাচা বলল, হা বাবা,আজিই কলেজ থেকে দিয়েছে।সাব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে ব্যবস্থা হলো।চলতি পথে চাচার বয়সি একজন বলল, ঐ অফিসে তোমার চাকরি না কি ভাই।চাচা হেসে বলল, কলেজের উন্নয়নের জন্য প্রতি দলিল রেজিস্টি করণের সময় একটা ফি নেয়া হয়,সেই সাখে এখন ছাতার ফি হিসাবে দশ টাকা ধার্য করা হয়েছে, তাই দিয়েই এই ব্যবস্থা।আর আমি নিজে ওখানে টুল পেতে বসে দলিল গুনে ফি এর টাকা নিয়ে কলেজে জমা দেই। পথচারি চাচার নামটা মনে করতে পারছি না, উভয়েই এবার হাসতে লাগলাম। আমিও না বুঝে ঐ দলে ভিরলাম।বাজারের ভেতর ঢুকতেই চাচা আমার ও আজাদের জন্য এক প্যাকেট নাবিস্ক বিস্কুট কিনে দিলেন। আমরা দুজন খেতে খেতে ফুটবল মাঠের দিকে চলে গেলাম।
চাচা এখন অবসরে। শুনলাম কলেজটাও সরকারি করণ হয়েছে।আজাদও এখন সংসারী মানুষ। আমিও পড়ালেখা শেষ করে শহরে থাকি আর একটা সরকারি ব্যাংকে চাকরি করি। গ্রামে খুব একটা যাওয়া হয় না, সময় অভাবে। তাছাড়া গ্রামে আর বাবা মাও থাকেন না।
একবার ঈদের সময় গ্রামের ছেলেরা নাটক করবে, তা আবার আমারই লেখা।আমি না হলে তাদের মন ভরছে না। এক সময় আমিও নাটক করতাম। আমাদের সময়ের অভিনেতারাই অভিনয় করবে। কুতুব, ফজলু, হাই, বদিয়ার, মজনু, মমিন,আজিজুল, সোহেল জামান, জয়নাল, খলিল, বিল্লাল সবাই আছে। যত কাজই থাক, যাবো ঠিক করলাম। নাটক হবে রাতে।সকাল বেলায় মটর বাইকটা নিয়ে বের হলাম নির্ধারিত দিনে। সকাল সাতটায় রওনা দিয়ে সাড়ে আটটায় পৌছালাম।সবাই তো আমাকে পেয়ে যেন হাতে চাদ পেলো এমন অবস্থা। অনেক স্মৃতি অনেক জায়গায় জড়ানো ছিল, সেগুলো গায়ে মাখলাম পরম যত্নে।কোন বাড়ি খাব, সেটাই সমস্যা হলো, সবাই বাড়ি নিয়ে যেতে চায়।
হঠাৎ দেখি আজাদের বাবা দাউদ চাচা, হাত ধরে তার বাড়ি নিয়ে চলল, সংগে আজাদও। কেউ না করলো না। চাচা, আমার বাড়ির সবার খোঁজ নিলেন। আমার বাবার সাথে তার স্মৃতিগুলো বলে যেতে লাগলেন।
অবশেষে খাওয়ার টেবিলে বসলাম। আজাদ বলল, শোন খেলার মাঠের পূবে একটা জমি কিনলাম।সাত লাখ টাকা দিয়ে। চাচা বলল,রেজিষ্টি খরচ যা বাড়ছে বাবা। অনেক খরচ। আমি বললাম,বেশি কি কি ফি? চাচা খেতে খেতে উঠে গিয়ে খরচের লিষ্টটা এনে বলল এই দেখো বাবা। আমার ছোট বেলার ছাতার ফি এর কথা মনে হলো আগ্রহী হয়ে দেখতে নিলাম ও পেয়ে গেলাম। এবার চাচাকে বললাম, চাচা, এখানে ছা তার ফি লেখা,বুঝলাম না।আপনি কিছু জানেন, যদিও মাত্র দশ টাকা। চাচা বলল, কোন সরকারি ফি হবে হয়তো, জানি বাপু। আমি আর মন্তব্য করলাম না, শুধু বুঝলাম, ছাতার ফিই হলো ছা তার ফি।কেউ এটা রদ করে নাই।
খাওয়া শেষ করলাম।অপূর্ব ডাল ভাত,আলু ভর্তা আর ডিম ভাজি।আথিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম।চির দিন মনে থাকবে।চাচীকে ও আজাদের বউকে সুন্দর খাবারের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে নাটক দেখতে আসতে বললাম, যদিও তারা পরিবার শুদ্ধ সবাই যাবে বলে মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছল।
অনেক আনন্দ নিয়ে নাটক দেখলাম, সবার অনুরোধে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ও করলাম। মনে হলো গ্রামের মানুষ আমাকে, আমার পরিবারকে কত ভালোবাসে।কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতি আমাকে যেন বলছে, আমরা তোমায় উজার করে ভালবাসা দিলাম। নাটক শেষে পরদিন বাড়ি ফেরার সময় নির্ধারণ করলাম, সকলের ঘুম ভাঙার আগে কারণ আমি এদের জন্য কিছুই করতে পারলাম।
ক্ষমা করে দিয়ো প্রিয় গ্রামবাসী।
বাড়ি এসে পৌছালাম। আজাদের ফোন পেলাম, বন্ধু, আমার বাবা আজ ভোরে হার্ট ষ্ট্রোকে মারা গেছে। তোর কথা যাবার আগেও বলল, কান্নার শব্দে আমার চোখটাও ভিজে গেলো।