চিকিৎসক আল-রাযি।
(আয়াজ আহমদ মাঝারভূঁইয়া)
হাইলাকান্দি, আসাম।
মুসলিমদের সোনালি অতীতের অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব আবু বকর মোহাম্মাদ ইবন যাকারিয়া আল রাযি বা আল-রাযি (৮৬৫-৯২৫)। আল-রাযি একজন দক্ষ চিকিৎসক ছিলেন। পারস্য বা ইরানের লোক ছিলেন। দার্শনিক পরিচিতিও ছিলো।চিকিৎসাবিজ্ঞান, দর্শন, পদার্থবিজ্ঞান , রসায়ন ও অন্যান্য বিষয়ে প্রায় ২০০ বৈ লিখেছেন।
আজকের মুসলিম প্রজন্মের একাংশ চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করতে চায়। তবে আল-রাযির মতো চিকিৎসক হতে চায় না। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, চিকিৎসাবিজ্ঞানে পূর্বতন মুসলিম চিকিৎসকের নানা রকম দান-অবদান , বলিষ্ঠ ভূমিকা।
ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি , অর্থোপার্জনের নেশা আর বিলাসিতা মুসলিম চিকিৎসকের পরিচায়ক হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের কাছে চিকিৎসকের মূল্য অনেক। কিন্তু একপ্রকার প্রতারক ও স্বার্থপর চিকিৎসকের অন্যায় আচরণ, প্রতারণামূলক চিকিৎসা ও নির্দয়তা আর নিম্নমানের চিকিৎসা চিকিৎসকের মূল্য তলানিতে নিয়ে এসেছে।
আল্লাহ ও পয়গম্বরদের পরে চিকিৎসকের স্থান-মান। এই কথাটার পরিলক্ষিত রূপে গরমিল রয়েছে। পিছিয়ে থাকা এলাকায় পিছিয়ে থাকা চিকিৎসকেরা কসাইয়ের মাসতুতো ভাই রূপে জনমনে জায়গা পেয়েছেন। মূলতঃ ভালো ভালো চিকিৎসকেরা নামীদামী এলাকায়, হাসপাতালে অবস্থান করেন। ফলতঃ অনুন্নত এলাকায় ভালো ডাক্তারের অভাব। এই অভাব পূরণে যখন নকল চিকিৎসক, ভুঁয়া চিকিৎসক, নামধারী চিকিৎসক, প্রাইভেটে পড়া এমবিবিএস, এমডিরা অবতীর্ণ হয় সাধারণের সর্বস্বান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। যাই হোক, আল-রাযি চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর ছোট বড় ১৪১ টি বই লেখেন। দশ খন্ডে রচিত তাঁর বই ” আল-মনসুরি’র একটি খন্ডে বসন্ত ও হাম নিয়ে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনিই প্রথম বসন্ত ও হামের ওপর নির্ভরশীল অনুসন্ধান ও গবেষণা কর্ম উপস্থাপন করেন। ১২৭৯ খ্রীঃ তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ-“আল-হাওয়া বা আল-হাবী” (২০ খন্ডে রচিত) ইহুদি চিকিৎসাবিদ ফারাজ বিন সেলিম ল্যাটিনে ভাষান্তর করেন। বৈটির ১০ খন্ড হারিয়ে গেছে। ১৫৪২ এ বইটির পঞ্চম সংস্করণ পাওয়া যায়।
আল-রাযিই প্রথম যিনি ক্লিনিক্যালি গুটিবসন্ত এবং হামের মধ্যে পার্থক্য করেন। এডওয়ার্ড গ্র্যানভিল ব্রাউন তাঁকে মুসলিম চিকিৎসকদের মধ্যে সবচেয়ে মৌলিক, সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ক্ষুরধার লেখনীর প্রশংসা করেছেন। আল-রাযিকে শিশুরোগবিদ্যার জনক বলা হয়। প্রসূতি ও চক্ষুবিদ্যার পথিকৃৎ হিসেবেও পরিচিতি আছে । তিনিই প্রথম চিকিৎসক হিসেবে চোখের কূট এর আলোর প্রতিক্রিয়া চিহ্নিত করতে সক্ষম হন। ‘অন সার্জারি’ ও ‘এ জেনারেল বুক অন থেরাপি’ নামে তাঁর রচনা (আল-মানসুরির কিছু খন্ড) পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চিকিৎসা পাঠ্যক্রমে ঢুকানো হয়েছে। আল-রাযির পর্যবেক্ষণ ও আবিষ্কার চিকিৎসাবিদ্যায় অনেক গতি আনে। আল-রাযি একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, পরীক্ষামূলক ওষুধের প্রবক্তা, প্রধান চিকিৎসক, রোগীর প্রতি সহানুভূতিশীল, নিবেদিত, সফল ডাক্তার রূপে মধ্যযুগীয় চিকিৎসাজগতে পাকাপোক্ত জায়গা করে নেন।
আল-রাযি সালফিউরিক এসিডের আবিষ্কারক। ইথানল উৎপাদন, বিশোধন ও চিকিৎসায় ব্যবহার আল-রাযিই আবিষ্কার করেন। ইরাকের রাজধানী বাগদাদে তাঁর একটি ল্যাব্রটরী ছিলো। তাঁর স্মরণেই ইরানে রাযি ইনস্টিটিউট, রাযি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশেও আল-রাযি হাসপাতাল রয়েছে। প্রতিবছর আগস্টের ২৭ তারিখটি আল-রাযি দিবস রূপে ইরানে পালন করা হয়।
আল-রাযির মতো অগণিত মুসলিম চিকিৎসকের অবিস্মরণীয় কালজয়ী সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বর্তমান মুসলিম চিকিৎসকদের এগিয়ে আসা উচিত। হাতুড়ে চিকিৎসকের মতো চিকিৎসা করলে কোনোভাবেই স্কলারের শিরোপা পাবেন না। অর্থ উপার্জনের জন্য চিকিৎসক না হয়ে বরং রোগের সঠিক ওষুধ আবিষ্কারের মাধ্যমে চিকিৎসাশাস্ত্রে অবদান রাখুন। ভিজিটের পরিমাণ কমান। মানুষের আর্থিক অবস্থা জেনে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার সুমহান আদর্শ স্থাপন করুন। সুন্দর ব্যবহার, কল্যাণকর চিকিৎসার প্রসার ঘটান। সহানুভূতিশীল, সমাজসেবী হোন। রোগীর প্রতি দরদের শীতল ছায়া বা মাথা গোঁজার ঠাঁই রূপে পরিচিত হোন। আশা করি মুসলিম সমাজের চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট ও নার্সদের পথভ্রষ্টতায় অতীতের অবিস্মরণীয় মুসলিম চিকিৎসকের কর্ম, আদর্শ ও অনুশীলন উপশমের অব্যর্থ ওষুধ হবে। মরিচা ধরা মনোলোকে সুপ্ত প্রতিভার অবাধ বিকাশ আনবে।