কবি ও শিক্ষাবিদ মাহবুবা ফারুক-এর আজ জন্মদিন। সমাজ পরিবর্তনে কবিতা গ্রুপের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা।
নাম: মাহবুবা ফারুক
জন্ম: বারহাটা নেত্রকোনা
পেশা: শিক্ষকতা
লিখেন: ছড়া কবিতা গল্প গান নাটক
এ পর্যন্ত প্রকাশিত বই ১২ টি। বাবা-মায়ের বড় সন্তান। তিনি এক সন্তানের জননী।
কবির নিজের মুখেই শুনুন লেখক হওয়ার পিছনের গল্প:
যখন আবেগকে ভালো করে বুঝিও না, ভিতরে শুধু অনুরণন হয়, প্রকাশের কোন একটা মাধ্যম খোঁজে ভিতরের আমিটা, কী কেন কীভাবে কিছুই জানি না। কোনো বিষয় নিয়ে যখন কিছু বলতে ইচ্ছে করে, কোনো ভালো লাগা বা কষ্টের কিছু- অথচ তা ঠিক সে ভাবে বলা যায় না- তখন লিখে রাখতাম । খুব ছোটবেলার কথা বলছি কষ্টেরা আমাকে অন্তর্মুখী করে তুলত । কিছুটা একাকীত্ব আর অসহায়ত্ব বোধ করতাম। যেমন বন্ধুর সাথে খেলতে গিয়ে ঝগড়া? বই পড়তে নিয়ে আর ফেরত দেয়নি? সামনে পরীক্ষা। খুব মন খারাপ হতো। সেসব কাকে বলবো? মা শুনলে আমার দোষ আগে জানতে চাইবেন । ভাই বোন ? মাকে অথবা বাবাকে বলে দিবে । কাজেই কাউকে না বলে বিছানায় শুয়ে ছটফট করতাম, ঘুম হত না রাতে। কাগজের কাছে সেসব জমা রেখে একটু ভারমুক্ত হতাম। এভাবে কোন কষ্ট বা ভালো কোনো আনন্দের বিষয় যা আমাকে স্পর্শ করত তা লিখে রাখতাম । বানিয়ে গল্প বলতে ভালো লাগতো তাও লিখে রাখতাম। কোনো স্মরণীয় বাণী কোথাও পেলেও লিখে রাখতাম। একে-ওকে তা উপহার হিসাবে দিতাম। বন্ধুরা কেউ কেউ আমাকে দিয়ে চিঠি লিখাতো। প্রথম লেখালেখির অভ্যাস এভাবেই শুরু।
পড়ার টেবিলেই থাকত সে সব লেখার খাতা । এক খাতা শেষ হলে আবার অন্য খাতায় শুরু হতো। সিনেমার নাম ,গান ,কবিতা, ধাঁধা, নতুন কোন রান্নার রেসিপি, সাংস্কৃতিক খবর, পত্রিকা থেকে কেটে রাখা কোনো ভালো লাগা লেখা, কী ছিল না! সবকিছু লিখে রাখতাম। ছবিও রাখতাম।
মুখে মুখে ছড়া বানানো খেলতাম বন্ধুদের সাথে। খেলা থেকে ফিরে এসে লিখে রাখতাম । লিখতাম শুধু স্থায়ী করার জন্যেও। যেন ভুলে না যাই। যেন এসব হারিয়ে না যায় । একদিন বৃষ্টির আকাশ দেখে কয়েক লাইনের ছড়া বানিয়ে ফেললাম। আমার সে কি আনন্দ ! কিন্তু সেটা কোন কাগজে লিখেছিলাম তা আর খুঁজে পাইনি। শুধু দুটো লাইন আজও সাথে আছে।
মেঘগুলো উড়ছে
কত দেশ ঘুরছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সবকিছুই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পুরনো বই খাতা আসবাবপত্র কোন কিছুই বাড়িতে ফিরে এসে পাইনি । যুদ্ধের সময় আমরা গ্রামে চলে গিয়েছিলাম শুধু পরার কাপড় সাথে নিয়ে। তখন আমরা ভাই-বোন খুব ছোট ছোট সবাই। অনেক কথাই আজ মনে নেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ মনে খুব দাগ কেটেছিল। ছোট একটা নৌকায় করে আম্মা, আব্বা আর আমরা ভাই-বোন যাচ্ছি এক পড়ন্ত বিকেলে মনে পড়ে। এসব ভাবলে আমি স্মৃতিকাতর হই।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরে বাড়ির দুরবস্থা দেখে ছোট্ট মনটাতে হাহাকার হচ্ছিল। পুরোনো কিছুই বাড়িতে নেই। চারপাশ খোলা, ফাঁকা। চেনা মানুষদের অনেকে নেই। বাড়ি ঘর ভাঙ্গা ,কোন জিনিস পত্র নেই। বাবা মায়ের হাতের গাছপালা সব কাটা । কোথাও আগুনে পোড়া। কেমন ভুতুড়ে পরিবেশ। সব হারিয়ে খুব মন খারাপ হলো। আবার আনন্দও হলো বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছি বলে। কত চেনা মানুষ এই যুদ্ধে মরে গেছে!
কিছুদিনের মধ্যেই আস্তে আস্তে অনেকে ফিরে এলো। তখনো অনেকেই ফিরে আসে নি। একটু একটু করে আবার নতুন করে জীবন শুরু হলো ।আবার বই খাতা, আবার লেখার জন্য কাগজ কলম। আবার বন্ধুদের সাথে খেলা । আবার স্কুলে পড়তে যাওয়া।
ক্লাসের বাংলা ইংরেজি রচনাগুলো আব্বা লিখে দিতেন সুন্দর ভাষায় । সেসব মুখস্থ করে লিখে নম্বর বেশি পেতাম। তখন থেকে নিজেও চেষ্টা করি ভাল কিছু লিখতে। তখন আমি পদ্ধতিটা শিখে নিয়েছিলাম আব্বার কাছে কি করে ভালো লিখতে হয়। কি করে হাতের লেখা সুন্দর হবে, ভাষা সুন্দর হবে।
খুব ছোটবেলায় দেখেছি আমার খালাতো বোন মুনিরা আপা নেত্রকোনার একটা পত্রিকায় গল্প লিখে পাঠাতো। তার গল্প ছাপা হতো । এটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য ও অদ্ভূত একটা ভালোলাগার বিষয় ছিল। আমার প্রিয় খালাতো বোন আনোয়ারা- আমার আনু আপা খুব গল্পের বই পড়তো। বড় বড় কবিতা মুখস্থ করত । যেমন ‘কবর’ কবিতাটা ক্লাস টুতেই মুখস্থ করে ফেলেছিল। সুন্দর আবৃত্তি করে শোনাতো ।আমাদের পরিবারের সবাই একসঙ্গে যখন বসতাম তখন। প্রায়ই খেলতে না গিয়ে অথবা খেলা শেষ করে গোল হয়ে তাকে ঘেরাও করে বসতাম। তার গল্প শুনতাম নতুন কোন গল্পের বই পড়েছে সে। কবিতা আবৃত্তি শুনতাম। আমার মনে হতো আমিও কবিতা লিখবো । এভাবে আবৃত্তি করব।
ক্লাসের বন্ধুরা অবাক হতো যদি দু-এক লাইন ছড়া শোনাতাম । তখন আরো লিখতে ইচ্ছে করতো। তাই পড়া ফাঁকি দিয়ে কখনোবা খেলা বাদ দিয়ে কাগজ কলম নিয়ে বসে যেতাম । লেখা না হলে ছবি আঁকতাম। টেবিলের সামনে সেই ছবি আটকে রাখতাম । স্কুলের ড্রয়িং স্যারের হাতের বাঁশ-বেত, কাগজ, কাঠ, মোম , সাবানের বিভিন্ন কাজ দেখে ভাবতাম এসবের মধ্যে কোথায় যেন ছন্দ, ছড়া-কবিতা লুকিয়ে আছে। সেখানে কারো বানানো একটা ছোট কাঠের চেয়ার দেখে খুব ভাল লেগেছিল । সেই চেয়ারটায় বড়রা বসতে পারবে না । তাই আমার মনে হলো আমার পুতুলটা যদি ওখানে বসাতে পারতাম ! কিন্তু সেই চেয়ার তো আমি পাব না । তাই বাসায় ফিরে একটা ছড়া লিখলাম —
ও কাঠের চেয়ার এত ছোট তুমি
তোমার পিঠে বসতে পারে
আমার পুতুল ছাড়া কে আর ?
বড় ক্লাসের আপা দিদিদের পরদিন এই লেখা দেখালাম।ওরা বলল, ‘এত ছোট তুমি’ অংশটুকু বাদ দাও। কেউ বললো শেষ লাইন দাও, ‘আমার পুতুল ঝুমঝুমি।’ শেষ পর্যন্ত কী করেছিলাম মনে নেই।
এগুলো কৈশোর কালের কথা । ক্লাস সিক্স সেভেন হবে। শুধু দেখার বিস্ময় । লিখে শুধু বন্ধুদের দেখানো। সেসব লেখা পড়ার টেবিল গুছাতে গিয়ে আম্মা কখনো দেখে ফেলতেন। আম্মার কথায় কখনো বোঝা যেত।
খুব মধুর , বিচিত্র, দুরন্ত শৈশব কৈশোর কাটিয়েছি আমি। ঘুড়ি ওড়ানো, ভেলায় চড়া, গাছে চড়া, পাখির ডিম পেড়ে নিয়ে আসা , বাগান করা, যখন-তখন পুকুরে সাঁতার কাটা, ভাই-বোন মিলে রান্না করা, পুতুল বিয়ে দেয়া, রেল লাইন ধরে দূরে কোথাও হেঁটে চলে যাওয়া, পুকুরে বরশি দিয়ে মাছ ধরা, সাপুড়ের সাপ ধরা ও সাপের খেলা দেখা, বোষ্টমীর গান শোনা,কি ছিল না সেই সময়টায়!
এক স্থানীয় ছোট কাগজের জন্য আব্বার কাছে একবার কেউ এসেছিল আমার লেখা চাইতে । সেটি হবে সুকান্ত সংখ্যা। তখন আব্বা আমাকে বললেন কবিতা লিখতে। তেমন কিছু জানি না সুকান্ত সম্পর্কে তবুও বই ঘেঁটে তারপর নিজের যা ভালো মনে হয় লিখলাম। লিখে আব্বাকে দেখালাম । কি লিখেছিলাম তার কিছুই আজ মনে নেই । আব্বা পড়লেন মন দিয়
১ Comment
অসাধারণ।