অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কবি ওয়াজেদ আলী’র কবিতাগুচ্ছ:
০১) তুমিও আমাদেরই একজন
ক্রমান্বয়ে আমি অতি অমানবিক ও ক্ষুদ্র হয়ে উঠছি।
জাত্যভিমান আমাকে ঘিরে ধরে এখন
মাটির পিড়িতে স্বাচ্ছন্দ্যে বসে থাকা সেই আমি
কলারের ভাজে ময়লা এখন আমার দুচোখের বিষ।
ধন্যবাদ বলতে আমি ভুলে গেছি।
সত্যি বলছি।
এই শব্দটি মনে এলে, কে যেন আমার গলা আটকে দিয়ে বলে –
” খবরদার! এ শব্দটি আর তোমার নয়”
ভুলে যাও তুমি ” ধন্যবাদ দেয়া নয় বরং পাওয়াটাই তোমার
এখনকার অধিকার, দীনতা ভুলে যাও।
সে কেবলই তোমার অসত্য অতীত মাত্র।
ভুলে যাও তোমার কোমরে রশি দিয়ে বাঁধা কুৎসিত অতীত
তুমি এখন আমাদেরই একজন।
০২) তাঁরা এখন কোথায়
জানেন, আমার পাশে যারা ছিল আজন্ম বিশ্বাস নিয়ে
তাদের কেউ কেউ গত হয়েছেন ইতিমধ্যেই
(কোথায় আছেন?)
আছেন স্বর্গে না হয় নরকে
তাদের কাউকে আমি সচেতনভাবে স্মরণ করি না কখনও।
একজন দোলা আপা, তিনি ছিলেন আমাদের প্রতিবেশী
সময়ে অসময়ে, দুঃখের দিনে কত কাজে লেগেছেন
ঘরে চাল নেয়, নুন কিংবা ডাল নেই;
তিনি আঁচলে লুকিয়ে ওসব নিয়ে হাজির।
রাতের খাবার অনিশ্চিত ভরসা হলেন দোলা আপা।
অদ্ভুত, অপরূপা স্নিগ্ধ মুখটা ছিল তাঁর।
কোথায় আছেন এখন জানিনা, সত্যি কথা বলছি
আমার সময় নাই ওইসব কিছু জানার।
মনে আছে আমার,
একবার, আমার বিধবা বড় ভাবির মানে অন্তুর মায়ের পাশে
সারারাত জেগেছিল দোলা আপা
আমার কিংবা অন্তুর চেয়েও অধিক উৎকণ্ঠায়
আমি তাকে ধন্যবাদ বলিনি, অন্তু ও বলেনি।
কদিন আগে দেখা হয়েছিল হঠাৎ-
কেমন আছেন আপা ব্যাস এই টুকুই।
খুব তাড়া ছিল আমার, শিল্প কলাতে যেতে হবে
সাহিত্য সভা অতঃপর রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী
এদিকে আমিই ছিলাম প্রধান আলোচক
সত্যি কথাটা কাউকে বলি না-
চুপ করে এইখানে বলে রাখি-
কিছু মনে করবেন না, আমি খুব ব্যস্ত মানুষ।
০৩) ঋণের টাকা যদি না হয় শোধ
বুকে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে কাতরাচ্ছিলো
নাসিমের বাবা, আমাদেরই প্রতবেশি,
সকালে বিকালে কথা হয়, দেখা হয়
এইতো কদিন আগে ওদের ঘরে চা খেয়ে এলাম টোসট-বিসকুট দিয়ে।
ফোন করেছিল নাসিমের ফুপু, নাসিমের মা ছিল না
বৃদ্ধা ফুপুটাই ছিল যেন তাঁর মা।
আমি ফোনটা ধরিনি, মাঝরাতে এতবার ফোন
বিরক্তিকর, মানুষের সভ্যতা জ্ঞানটুকু পর্যন্ত উবে গেছে আজকাল।
দারুণ ব্যস্ত ছিলাম-
আমার ‘”রাতের কামিনী” উপন্যাসের মাশফি চরিত্রটাকে
আরও বেশি ভয়ঙ্কর করে তুলতে খুব বেগ পাচ্ছিলাম।
কাটছি আবার লিখছি, যা তা অবস্থা আমার।
আমি ফোন বন্ধ করে দিলাম।
সকাল দশটার ঘুম ভেঙেছে, কাজের ছুকরিটা চা দিয়ে গেল
কালো চামড়ার মেয়ে, আজ তার কালো শাড়িতে কমলা রঙের পাড়
কি যে দারুণ লাগছিল মেয়েটাকে
একবার কিংবা দুবার তাকিয়ে ছিলাম লুকিয়ে লুকিয়ে
টোস্ট দিতে এসে বলে গেলো
“নাসিমের বাপে মইরা গেছে, ইষ্টক নাকি হার্ট ফেল কইরা”
আহারে! মইরা যে গেছে মনে হয় না,
মুখের উপরে আল্লাপাকের নুর পরছে, এক্কেরে ধবধব করতাছে।
বিদায় না বলেই চলে গেল নাসিমের বাবা,
অনেকটা বন্ধুজন ছিলেন নাসিমের বাপে,
বন্ধুই বলতে পারেন। চারটা বাড়ি পরেই তাঁর পুরনো বাড়িটা।
দয়ালু ছিলেন ভারী, কথা বলতেন কম এই একটাই দোষ ছিল তার।
বছর খানেক আগে দুশ টাকা ধার নিয়েছিলাম তাঁর কাছে,
দিয়ে দেবো ক্ষণ নাসিমের হাতে
ঠিকই দিয়ে দেবো, এখন হাত এক্কেবারেই খালি।
শুনুন বলে রাখি, মৃতদের টাকা পয়সা ফিরিয়ে না দেয়া খুবই অন্যায়,
পরকালে আমার দারুণ ভয়।
পরকালে আল্লাহ এইতা মাফ করবে তো?
০৪) স্বাপ্নিক জীবন
বুড়িগঙ্গার ওপারের যে ছোকরাটা তার প্রথমা স্ত্রীকে
দ্বিতীয়বার ডিভোরস করে ফেলে গেল,
তার ব্যপারে আমার খুব দুঃখ হয়।
স্বাপ্নিক যুবতি তিনি, দুচোখ ভরা লাল নীল স্বপ্ন তার
প্রথম ঘর ভেঙেছিল বয়স যখন তার সবে মাত্র উনিশ
তারপর, পুনে একযুগ একা একা সংগ্রাম।
এইসব শুনে, কেরানীগঞ্জের ছোকরাটাকে
ফোন করে বলেছিলাম বলেছিলাম একদিন
“নিয়ে যাওনা মেয়েটিকে ঘরে”
উত্তরে সে বলল-
ছিঃ, “পারলে নিয়ে যান না আপনি, আপনার ঘর দুয়ার খাবার
সবই তো আছে, সেইখানে রেখে দিন”।
“খেতে দেবেন, পরতে দেবেন, হয়ে গেল” !
“ওই ছুকরিটা খুব স্বাপ্নিক, রাত দিন শুধু এখানে চল সেখানে চল”
” চল না গো হাটি দুজনে বুড়িগঙ্গার তীরে দুজ দুজনার হাট ধরাধরি করে”
বলুন তো বাপু! – ইসলামপুরের কাপড়ের দোকানের চাকরি আমার
চাইলেই কি ওরা আমাকে ছাড়বে?
লোকের কোন অভাব আছে, আমি থাকলেই কি আর না থাকলেই কি
কতজন দাঁড়িয়ে আছে লাইন দিয়ে, আমারে পছন্দ না হলেই আরেকজন।
আর শুনুন আমি এত কিছু করতে পারমু না-
ন’ হাজার টাকা বেতন, দুই ঘণ্টার ওভার টাইমে আরও বড়জোর আটশ
‘এর থিকা ঘরের ভাড়া পাঁচ হাজার, মায়ের ওষুধ আছে ডাক্তার আছে
আমাদের খাবার দাবার- এরপর বুড়িগঙ্গা, মনে আমার কিযে কয় !”
বরং আপনি তারে নিয়া যান,
“সকাল বিকাল স্বপ্ন খাবেন, স্বপ্ন পরবেন, স্বপ্নও মেখে লিখতে বসবেন।
অনেক মজা হবে আপনার।”
রাগে, ক্ষোভে ফোনটাকে ছুঁড়ে ফেলেছিলাম
(অবশ্য মিনিট দুয়েক পর, আবার কুড়িয়ে নিয়েছি)
ছোকরাটা আরও কি বলেছিল জানেন- “আমি অন্ন জলে বাঁচি
স্বপ্ন আমার ক্ষুধার অন্ন নয়।”