৭২ বার পড়া হয়েছে
কবি আল মাহমুদ স্মরণে
সাঈদা আজিজ চৌধুরী
মৃত্যুর পর অক্ষরে অমর হয়ে থাকে মানুষ। কবি লেখকগণের ক্ষেত্রে তাঁদের লেখনির অক্ষরনামা দখল করে থাকে পাঠকের হৃদয় শতাব্দীর পর শতাব্দী। কবিগণ কালদর্শী মানুষ। তাঁদের থাকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি,নিবিড় পর্যবেক্ষণ শক্তি।
কবি আল মাহমুদের ছিল পাঠককে বিস্মিত করার আশ্চর্য
ক্ষমতা।
এই পর্যায়ে কবির স্মরণে তাঁরই রচিত কবিতার কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি—
“ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে,বৃষ্টি কোথায়?
বরকতের রক্ত।
প্রভাতফেরী প্রভাতফেরী আমায় নেবে সঙ্গে
বাংলা আমার বচন,আমি জন্মেছি এই বঙ্গে।—কবি আল মাহমুদের কবিতার চরণ।
শুধু হত্যাকারীদের কোনো মানচিত্র থাকে না,নেই।”—কবি আল মাহমুদের উক্তি।
দেশাত্মবোধের বিপুল চেতনায় সমৃদ্ধ লাইনগুলিতে অসীম দেশপ্রেম বিমূর্ত। ১৯৫০ দশকের কবি আল মাহমুদের কবিতার চরণগুলি দিয়ে কবির জন্মদিনে তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।
কবি আল মাহমুদ,জন্মনাম—মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ।১১ই জুলাই বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবি আল মাহমুদের ৮৯তম জন্মদিন।
পঞ্চাশের দশকে যে কয়েকজন লেখক বাংলা ভাষা আন্দোলন,জাতীয়তাবাদ,রাজনীতি,অর্থনৈতিক নিপীড়ন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি শাসনবিরোধী আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন,তাঁদের মধ্যে কবি আল মাহমুদ অন্যতম। অবিভক্ত বাংলা থেকে শুরু করে কবি আল মাহমুদের ষাট বছরের কাব্যজীবন। তাঁর কাব্যিক দর্শন স্বমহিমায় কালোত্তীর্ণ।পাঠকের কাছে কবির সব কবিতাই শ্রেষ্ঠ কবিতা।বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে তিনি এক বিরল প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিভা।আধুনিক বাংলা কবিতার নগরকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপটে ভাটি অঞ্চলের জীবনাচরণ,গ্রামীণ আবহ,নদীনির্ভর জনপদ,চরাঞ্চলের জীবন প্রবাহ,নর নারীর প্রেম-বিরহ পাঠকমহলকে আকৃষ্ট করে। ১৯৩৬ সালের ১১ই জুলাই বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোড়াইল গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা মীর আবদুর রব,মাতা রওশন আরা মীর এবং স্ত্রী সৈয়দা নাদিরা বেগম।
আল মাহমুদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ,ভারত উপমহাদেশ বিভক্তি,১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রবল প্রবাহের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাগরিক ও সাহিত্য-সংস্কৃতির আবহ,বিশেষ করে লালমোহন পাঠাগার কেন্দ্রিক বৈপ্লবিক চিন্তা চেতনা এবং তিতাস পারের নির্মল প্রকৃতির প্রভাব কবির কাব্যস্বত্ত্বাকে ধারালো করে তুলে,সৃজনশীলতার বীজ বপন করে। মার্কসবাদী সাহিত্যধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে সাহিত্যচর্চা শুরু করলেও প্রকৃতির বৈচিত্রতায় কবি-মানসে ঐশ্বরিক পত্র-পুষ্প বিস্তৃত হতে থাকে। নারী ও প্রকৃতিকে মূল উপজীব্য করে গড়ে ওঠে তাঁর কাব্যজগত।
যৌবনের শুরুতে দেখেছেন স্বাধিকারের স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশীদের তুমুল লড়াই।
আল মাহমুদের প্রথম প্রকাশিত রচনা ছিল একটি ছোট গল্প। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন নবম শ্রেণীর ছাত্র।ভাষার দাবীতে আন্দোলনরত ভাষা আন্দোলন কমিটির একটি লিফলেটে চার লাইনের একটি কবিতা ছাপা হয়। তখন তৎকালীন পুলিশের অগ্নি চক্ষুর শিকার হন। ১৯৫৪ সালে আঠার বছর বয়স থেকে ঢাকা ও কোলকাতার স্বনামধন্য পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা এবং কোলকাতার নতুন সাহিত্য,চতুষ্কোণ,ময়ূখ,কৃত্তিবাস ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে পশ্চিম বঙ্গ ও বাংলাদেশের লেখকসমাজের কাছে আলোচিত ও সমাদৃত হয়ে ওঠেন।
কবির রচিত সোনালি কাবিন কাব্যগ্রন্থে তাঁর প্রেমিক স্বত্ত্বার সঙ্গে পাঠক পরিচিত হন।
ভুলো না কেন ভুলতে পারো যদি/চাঁদের সাথে হাঁটার রাতগুলি/নিয়াজ মাঠে শিশির-লাগা ঘাস/পকেটে কার ঠান্ডা অঙ্গুলি/ঢুকিয়ে হেসে বলতে,অভ্যাস/

অথবা যদি নিম্নে বর্ণিত লাইনগুলির দিকে আলোকপাত করি—
“ঈভের শরীর যত কেলি করে প্যসিফিকে,ভূমধ্য সাগরে/নুনের দাহিকা হয়ে জ্বলে তারা অধরে নধরে”/—কবির রচিত এই লাইনগুলি তরুণ কবির প্রেমিকস্বত্ত্বা যৌবনের উত্তাপ ছড়ায়।
তিনি একাধারে কবি,ঔপন্যাসিক,প্রাবন্ধিক,গল্পকার,শিশু সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে তিনি আধুনিক কবিতার জগতকে নতুন আঙ্গিক,চেতনা,শিল্পিত রচনাশৈলি দ্বারা সমৃদ্ধ করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন প্রবাসী সরকারের দ্বায়িত্ব পালনের মাধ্যমে।
কবির রচনার কয়েকটি লাইন এখানে উদ্বৃত করছি।
“আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে/হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে/এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন,ফের বাড়ালাম পা/আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।” দেশপ্রেমের চেতনা সমৃদ্ধ কয়েকটি লাইন।
লোক লোকান্তর,কালের কলস,মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো ইত্যাদি কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। তাঁর রচিত উপন্যাসের মধ্যে কবি ও কোলাহল,মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা কাবিলের বোন বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রা সংযোজন করে। লোক লোকান্তর ও কালের কলস কাব্যগ্রন্থের জন্য তাঁকে ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদান করা হয়। সাহিত্য প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি একুশে পদকসহ বেশ কিছু সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। এর মধ্যে জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি পুরস্কার,ফররুখ আহমদ স্মৃতি পুরস্কার,ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার,অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ “ সোনালি কাবিন” কবি-জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা। বাঁধা-বিঘ্ন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ফেরারি জীবনের মধ্যেও কবি সাহিত্যজগতে নতুন অধ্যায়ের জন্ম দিতে সক্ষম হন।কবির ভাষায়—“আমার মনে আদিম মানুষের মতো অতিশয় প্রাথমিক এক দার্শনিক জিজ্ঞাসা জাগে—কে তুমি আয়োজক? তুমিও কি কবি,না কবির নির্মাতা? তবে তুমি যে অনিঃশেষ সুন্দর,আমি তা সাক্ষ্য দিচ্ছি।আমার সাক্ষ্য গ্রহণ করো প্রভু।”
কবি আল মাহমুদের কবিসত্ত্বা তাঁর রচিত অক্ষরনামায় সৃষ্টির ইতিহাসে অমর হয়ে আছে পাঠকের হৃদয়ে।শব্দের আনন্দে তিনি কবিতার যে প্রাসাদ নির্মাণ করেছেন নিঃসন্দেহে তার কাঠামো দৃঢ়, মজবুত।সাহিত্য জগতে সৃষ্টির উপাদানের নিরিখে কবির কবিস্বত্ত্বা কালোত্তীর্ণ।
পরিশেষে কবিকে শ্রদ্ধা জানাই তাঁরই রচিত কয়েকটি লাইন উদ্বৃত করে—
“ডাকছে আমাকে হাঁকছে আমাকে,আমিই শেষের লোক/শ্লোক শেষ হলো,অন্ত-মিলেরও শেষ,কাঁপছে নায়ের পাটাতন/বুঝি ছেড়ে যেতে উৎসুক।”
কবি যেনো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সৃষ্টিকর্তার অনন্ত নির্দেশে অসীমের পথে পা রাখলেন। কবির পারলৌকিক শান্তি কামনা করি।
শুভ জন্ম জয়ন্তী।জয় হোক কবিতার।