একটি প্রকাশনা উৎসব : একটি মিলনমেলা
তসলিমা হাসান (টরন্টো/কানাডা)
একটি প্রকাশনা উৎসবে মুগ্ধতায় কাটালাম সুন্দর বিকেলের কিছু সময়। টরন্টোতে এখন সামার চলছে। গায়ে মৃদু বাতাসের ছোঁয়া আর গাছে গাছে নতুন পাতার সমাগমের দৃশ্য মনটাকে ভালো করে দেয়। এমন দিনে সাহিত্য-সভার আমন্ত্রণ অন্তত আমার জন্য সুখবর বটে। ‘কানাডা : বিবিধ প্রসঙ্গ’ নামে একটি বইয়ের প্রকাশনা উপলক্ষে ১১ মে টরন্টোর বার্চমাউন্ট কনভেনশন হলে বসেছিল এক মিলনমেলা। কানাডার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গ্রন্থের ৩০ জন লেখকের মধ্যে ২৭ জন উপস্থিত ছিলেন এখানে। অন্য তিনজন ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি। গ্রন্থভুক্ত লেখক ছাড়াও টরন্টো শহর ও আশপাশের এলাকা থেকে লেখক-সাহিত্যিকরা হাজির হয়েছিলেন এই সভায়। মিডিয়া পার্টনার হিসেবে গোটা অনুষ্ঠানের ভিডিও ধারণ ও প্রচারের ব্যবস্থা করেছে এনআরবি টিভি। সাহিত্যামোদিদের এই আনন্দমেলায় উপস্থিত থাকতে পেরে খুবই ভালো লেগেছে আমার।
আগেই বলে রাখি, সুব্রত কুমার দাস মানে আমার প্রিয় সুব্রত দা আর শহিদুল ইসলাম মিন্টু অর্থাৎ আমার কাছের মানুষ মিন্টু ভাইয়ের কোনো অনুষ্ঠান আমি সহজে মিস করতে চাই না। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা আর যে যা-ই বলি না কেন, তা সবসময় আমি অনুভব করি। তাঁরা দুজনেই আমার পরিবারের সদস্যের মতো। অতি আপনজন। মাত্র কয়েকদিন আগে আমি দ্বিতীয় চোখের সার্জারি করেছি। এখনও আমার অফিসের ছুটি শেষ হয়নি। কিন্তু সুব্রত দা’র আমন্ত্রণে না করতে পারিনি। তবে অনুষ্ঠানে গিয়ে অনেকের সাথে দেখা হয়েছে। খুব ভালো লেগেছে আমার। না গেলে মিস করতাম।
ফারজানা বেবীর চমৎকার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানটি আরম্ভ হয়ে সন্ধ্যা ৬টায়। শুরুর আগেই যথাসময়ে সকল আমন্ত্রিত অতিথি ও বিশিষ্টজনরা হলরুমে উপস্থিত হন। আনন্দ-আলাপ আর কোলাহলে ভরে ওঠে পুরো অনুষ্ঠানস্থল। আলোচনা, ডিনার, ফটোসেশন, আড্ডা মিলিয়ে অনুষ্ঠান চলে ৮টা পর্যন্ত। ৮০-৮৫ জনের উপস্থিতি হলরুমের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছিল। বক্তব্য চলাকালে পিনপতন নিরবতা ছিল দেখবার মতো। গোটা অনুষ্ঠান শ্রোতা-দর্শক উপভোগ করেছেন মনোযোগের সাথে।
বইটির সম্পাদক টরন্টোর বিশিষ্ট বাঙালি সাহিত্যিক ও গবেষক সুব্রত কুমার দাস অনুষ্ঠানের শুরুতে সকল লেখককে মঞ্চে ডেকে নেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ও সভাপতির মাধ্যমে প্রত্যেকের হাতে তুলে দেওয়া হয় নতুন এই বই-এর কপি। আয়োজনের এই পর্বটি ছিল খুবই আকর্ষণীয় আর আনন্দেভরা। লেখকদের পরিবার-পরিজনেরা সামনে বসে উপভোগ করেছে দৃশ্যটি। আমি যেহেতু সামান্য লেখালিখি করি, তাই লেখকদের এই আনন্দে আমিও পুলক অনুভব করেছি। সম্পাদক তাঁর গ্রন্থটির তালিকাভুক্ত লেখকদের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহের যে সংগ্রাম, সে গল্প শোনালেন। বললেন এই বইটির পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের গল্পও। অনেককে অনুরোধ করেও তিনি লেখা পাননি। আবার যাঁরা লিখেছেন, তারা খুব আগ্রহ সহকারে ভালোবেসে লিখেছেন, বললেন সুব্রত কুমার দাস। তিনি তাঁর বক্তব্যে জানালেন, কীভাবে মিডিয়া পার্টনার হিসেবে ‘সাপ্তাহিক বাংলা মেইল’ তাঁকে সহযোগিতা করেছে। পত্রিকার কর্ণধার কানাডার স্বনামধন্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শহিদুল ইসলাম মিন্টু যে এই গ্রন্থটির পেছনে থেকে বিরাট প্রেরণা যুগিয়েছেন, তা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন বইটির সম্পাদক।
গ্রন্থটির ওপর আলোচনা করেছেন বিশিষ্ট গবেষক ড. ফজলুল হক সৈকত। তিনি নানা বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করলেন। বইটিতে কি কি আছে বলার পাশাপাশি এখানে আর কী যোগ করা যেত, তাও উল্লেখ করেন তিনি। তিনি গ্রন্থ থেকে কয়েকজনের লেখার উদ্ধৃতি দেন। আলোচনার শুরুতেই ড. সৈকত গ্রন্থের সকল লেখককে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানান। বইটি তৈরি হওয়ার পেছনে চারটি পক্ষ কাজ করেছে বলে আলোচক মন্তব্য করেন। চারটি পক্ষ হলো লেখক, সম্পাদক, প্রমোটার ও প্রকাশক। তিনি সম্পাদককে বিরল সংগঠক বলেও উল্লেখ করেন। তাঁর এই আলোচনা বেশ মনোমুগ্ধকর ছিল। সুব্রত কুমার দাস যে তাঁর দীর্ঘদিনের পরিচিত এবং এর আগেও তিনি সুব্রতর একাধিক বই বিষয়ে সমালোচনা লিখেছেন, তাও জানা গেল বক্তব্য থেকে। সৈকতের আলোচনা খুব ভালো লেগেছে।
এই আয়োজনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন টরন্টোর প্রখ্যাত ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ও রাজনীতিবিদ ড. নুরুল্লাহ তরুণ। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ফেডারেল ইলেকশনে তিনি কনজারভেটিভ পার্টির হয়ে স্কারবরো-সাউথওয়েস্ট রাইডিং থেকে এমপি পদে লড়েছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে তিনি এই দূর প্রবাসে বাঙালির রাজনীতির যাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন বলে সর্বত্র আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। ডা. তরুণ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের সকল লেখক ও সম্পাদককে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানান। বইটির গুরুত্ব অনুধাবন করে এর প্রচারে সকল মহলকে এগিয়ে আসার অনুরোধ করেন তিনি। বাঙালি কমিউনিটির যেকোনো কল্যাণকর উদ্যোগে পাশে থাকার তাঁর স্বভাবসুলত আশ^াসের কথা শুনে মনটা ভরে গেছে আমার।
প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন টরন্টোর পরিচিত মুখ বাংলা মেইলের সম্পাদক ও এনআরবি টিভির সিইও শহিদুল ইসলাম মিন্টু। তাঁর বক্তব্য ছিল অত্যন্ত প্রাণবন্ত। সুব্রত কুমারের এই উদ্যোগের মতো আরো শত আয়োজনকে তিনি বিনাবাক্যব্যয়ে সমর্থন করেন বলে জানালেন। সুব্রত যে কানাডায় বাঙালি সাহিত্য-সংস্কৃতির একটা বিরাট শক্তি, তা বলতে ভোলেননি মিন্টু। এই ধরনের সকল আয়োজন অনুষ্ঠানে তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি তিনি কানাডার সফল ও বিত্তশালী বাঙালিদেরকে সহযোগিতা হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে সমবেত সকলে তাঁর এই প্রস্তাবকে করতালি দিয়ে সমর্থন জানায়। ভালো কাজের প্রতি বিশেষ করে শিল্প-সাহিত্যের প্রতি টরন্টোবাসীর এমন আগ্রহ দেখে একজন লেখক হিসেবে আমি ভীষণ গর্বিত হয়েছি। আমার মনে হয়েছে, এই টরন্টো শহর যেন ধীরে ধীরে কানাডায় বসবাসকারী বাঙালির সাহিত্যচর্চার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কথাসাহিত্যিক আকবর হোসেন। তিনি এই মিলনমেলায় সমাগত সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। বইটির ব্যাপক প্রচার ও প্রসার কামনা করেন তিনি। সভাপতির শান্ত-¯িœগ্ধ ভাষণ ছিল মনে রাখার মতো।
আলোচনার শেষে ডিনারে অংশগ্রহণ করে সকলে। বসে-দাঁড়িয়ে খেতে খেতে অনেকে পুরনো বন্ধুত্ব ঝালিয়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ পরিচিত হয়েছেন অপরিচিত কারো সাথে। নতুন-পুরনো অভিবাসীরা যেন মিলিত হয়েছিল সত্যিকারের এক আনন্দমেলায়। বিভিন্ন বয়সের মানুষের এই উৎসব আমার স্মৃতির অ্যালবামে যোগ করেছে নতুন অভিজ্ঞতা। ভিন্ন রকমের আনন্দ নিয়ে ঘরে ফিরেছি। এখন অবসরে এই বইয়ের লেখাগুলো পড়বো। ছুটির বাকি দিনগুলো ভালো কাটবে; বইটা সাথে আছে বলে।
টরন্টো
১৪/ ৫/২৫