কথার কথকতা, ভাষা আগে না কি ব্যাকরণ আগে
— মাইন উদ্দিন আহমেদ
ভাষা আগে না কি ব্যাকরণ আগে? ছন্দ আগে না কি কবিতা আগে? এ দুটো প্রশ্নই গুরুত্ত্বপূর্ণ, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ স্বাভাবিক থাকলে এ প্রশ্নগুলো তুলতেই হতোনা। কিন্তু এ বিষয়ে আজকাল যত মানুষ কথা বলেন সবাই এ বিষয়ে যখন তখন কথা বলার কথা নয়। প্রশ্ন উচ্চারিত হবে, তাহলে বলে কেনো? এটাও একটা জটিল প্রশ্ন। যিনি যে বিষয়ের বিজ্ঞ ব্যক্তি নন তিনি সে বিষয়ে বেশি কথা বলা উচিত নয়, আপনারাই বলবেন একথা। আমি বলবো, বেশি কথা বলা নয়, তিনি মোটেই সে বিষয়ে কথা বলা উচিত নয়।
যা-ই হোক, আসুন আমরা ভাষা ও কাব্যের বিষয়টি একটু সহজ ও সরল ভাবে দেখার চেষ্টা করি।
একটা শিশু পৃথিবীতে আসার পর তার প্রথম ভাষা ও কবিতা হচ্ছে ক্রন্দন। এসেই কেনো সে হাসেনা, শুধুই কাঁদে, এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা, পর্যালোচনা, গবেষণা ও বক্তৃতামালা হয়ে যেতে পারে। আমরা ক্রন্দন হেতু আবিস্কারের তরে জ্ঞানের গভীর সমুদ্রে ডুবাডুবি না করে সাধারন করে ব্যাপারটা দেখার চেষ্টা করি।
মায়ের পেটে শিশুটি একটি অতি উচ্চ মানের শীত ও তাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে এমন এক ব্যবস্হাপনায় বড় হয়েছে যেখানে পরিমিত পরিমান বাতাস, শক্তি এবং প্রয়োজনীয় সব উপাদান নাড়ির মাধ্যমে পেতো এবং দৈহিক নিরাপত্ত্বাও বলা যায় নিশ্চিত করা-ই থাকতো। পৃথিবীতে আসার পর শত-সহস্র উপাদান বায়ুমন্ডল থেকে স্পর্শ করে শিশুটিকে। মাতৃজঠরের নিরাপদ আশ্রয় থেকে বেরিয়ে প্রতিকূলতাকে জয় করতে গিয়ে তাকে চিৎকার দিয়ে জানান দিতে হয়, শক্তি আহরণ করতে হয়। এটাই ভাষা।
একটা শিশু বড় হবে, বড় হয়ে ব্যাকরণ শিখবে। তারপর সে ভাষা শিখবে। এটাকি সম্ভব! না সম্ভব নয়। সে পৃথিবীতে এসেই যে ধ্বনি সৃষ্টি করে এটাই ভাষা।
এবার কাব্য বা ছন্দ সম্পর্কে বলি। একটা শিশু কি বড় হয়ে কবিতার ছন্দ শিখে নিয়ে ছড়া বা কবিতা এগুলো লিখবে? তা কি হয়? সে পৃথিবীতে পদার্পণ করে শতসহস্র ধ্বনি শুনতে পায়, বেশি পায় মায়ের কন্ঠনিঃসৃত বিভিন্ন ছন্দায়িত আওয়াজ। তার মধ্যে প্রোথিত হয় ছন্দ। ছন্দে দোলায়িত হতে হতেই সে বড় হয়। সুতরাং আগে ছন্দ সম্পর্কে পড়ালেখা করে তাকে ছড়া বা কবিতা পড়তে বা লিখতে হয় না। কবি লিখে ফেলার পর প্রয়োজনে পন্ডিত ব্যক্তি এগুলো ব্যবচ্ছেদ বা পর্যালোচনা করে দেখেন।
একটা মানুষের ভাষাকে মাতৃভাষা কেনো বলা হয়? দেশকে মাতৃভূমি কেনো বলা হয়? আবেগায়িত কন্ঠে বলা হয়, দেশ আমার মা। এতে অনেক আবেগ মিশ্রিত থাকে। বস্তুতঃ এটি আমার মায়ের ভূমি, এক কথায় মাতৃভূমি; ধ্বনিগুলো উচ্চারিত হতে থাকে মায়ের কন্ঠ থেকে যেটা আমার মাতৃভাষা। জ্ঞান এবং আবেগের মধ্যে যদি সমন্বয় সাধিত না হয় তাহলে ভাষা, ছন্দ এবং চেতনা সবটাই অনেক বড় রকমের ভুলের সাগরে নিমজ্জিত হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
একটা মানুষ জ্ঞান অর্জনের জন্য নির্ভর করে তার মা, সংশ্লিষ্ট সমাজ, শিক্ষক ও পুস্তকের উপর। এই কারণে ঐতিহ্যসমূহ ধরে রাখা একটি জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
এই যে আমরা ভাষা ও ছন্দ নিয়ে কাঁৎরাচ্ছি, এটা ঘটতোনা যদি আমরা ঐতিহ্যসমূহ সচেতনভাবে লালন এবং সংরক্ষণ করতাম। বিষয়টি খুবই সহজ করে দেয়ার জন্য একটি সমৃদ্ধ প্রসঙ্গের রেশ ধরে টান দেবো আমরা। আসুন, একটু ধৈর্য ধরে শুনুন। বিষয়টি টেনেহিঁচড়ে লম্বা করবো না, সংক্ষেপে সহজ করে বলবো।
আমাদের বাংলা ভাষাভাষি সমাজে ঠিক এই সময়ে যে কজন প্রবীণ মানুষ বেঁচে আছেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা সাহিত্যের স্পর্শে ছিলেন, তাঁরা অবশ্যই স্মরণ করবেন পল্লীকবি জসীম উদ্দীন সাহেবের শিশুবিষয়ক লেখাসমূহ। এ সম্পর্কিত ছড়া ও কবিতা উচ্চারণের সময় মা, শিশু, আশেপাশের লোক এবং গোটা সমাজ ছন্দায়িত হয়ে উঠতো, দুলে উঠতো। এ প্রক্রিয়ায় ভাষা ও ছন্দ জসীমীয় মেধায় হতো উপলব্ধ। কিন্তু পল্লীকবির বইগুলো এখন খুব কমই পাওয়া যায়। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পড়ার সময় এটা লক্ষ্য করেছি এবং অনেককে বলেছিও। ঠিক এ মূহুর্তে কবি জসীম উদ্দীন-এর কাব্য সমগ্র পাওয়া যায় কিনা আমার জানা নেই। পাওয়া না গেলে মুদ্রণ, সংরক্ষণ ও প্রচারনার ব্যবস্হা করুন।
মায়ের কন্ঠে উচ্চারিত ধ্বনি ও ছন্দই হচ্ছে মায়ের ভাষা ও কবিতা। ছন্দ ও ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নয়, এগুলো সৃষ্টি হয় মায়ের কন্ঠে। তাই এর নাম মাতৃভাষা আর ছন্দের দোলায় আন্দোলিত বিজ্ঞ মানুষ বলে ওঠেন, কবিতা আমার মাতৃভাষা। মানুষের কন্ঠে উচ্চারিত হয় ভাষা, পন্ডিত তার ব্যাকরণ সূত্রায়িত করার চেষ্টা করেন পরে; কবি শ্রুতির দোলায় লেখেন, পন্ডিত তা ব্যখ্যা করেন পরে। সুতরাং ভাষা ও ছন্দ আগে আর ব্যাকরণ ও ছন্দের উপর গবেষণা হবে সেগুলো সৃষ্টির পরে। প্রিয় পাঠক, চলুনতো বইয়ের দোকানে যাই। “এই যে ভাই, কবি জসীম উদ্দীন সাহেবের কাব্যসমগ্র আছেকি?”
লেখক: আমেরিকান প্রবাসী কবি ও কলামিস্ট, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
১ Comment
স্যারের জন্য একরাশ ভালো লাগার ভালোবাসা