অবৈধ আকাশ
সামশুল আরেফিন
ব্যার্থ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আকাশ। আকাশ এক ভিষণ রকমের সীমাহীন, তারপরেও আকাশের কাছে আজকের আকাশ খুবই ক্ষুদ্র, খুবই সিমীত। আকাশ এক প্রচন্ড রকমের উদার, তারপরেও আকাশের কাছে আজকের আকাশের মন হীনতায় আর দৈন্যতায় পরিপূর্ণ। আকাশ আজ খুবই বিষন্ন। আকাশ আজ মেঘে ঢাকা কারন মেঘকে সরিয়ে দেবার ক্ষমতা আকাশের নেই। তাই আকাশের কাছে আজকের আকাশ চরম ভাবে ব্যার্থ যেমন ব্যার্থ সে নিজে। আজ সারারাত আকাশের দিকে চেয়ে রবে আকাশ। আজ সারারাত ঘন কালো আকাশের সাথে বাসর যাপন করবে আকাশ। বাসরযাপনের পরে একজন মানুষের জীবনে যেমনি নতুন জীবনের সুর্য উঠে, ঠিক তেমনি আগামীকাল সকাল থেকে তার নতুন জীবন শুরু। নতুন জীবন, নতুন নাম, নতুন অস্তিত্ব, নতুনত্ব নিয়ে বেঁচে থাকা আর প্রতিসেকেন্ডে নতুন ধরনের সংগ্রাম।
আগামীকাল থেকে তার নতুন পরিচয়, নতুন খেতাব, নতুন পদবী। ছোটবেলায় দেশে থাকতে শুনতো, যারা গুন্ডা বদমাইশ হয়, খুন খারাবি করে তাদের বাহারী নাম হয়, যেমনঃ মুরগী মিলন,ল্যাংড়া শফিক, ঘাড় বেকা মজিদ এই টাইপ। আকাশ যদিও খুন খারাবি কিছুই করেনি তারপরেও আগামীকাল থেকে তার নাম হবে রিফুজি আকাশ আর পদবী হবে unlawful non- citizen. অর্থাৎ আজ রাত বারোটার পর তার বর্তমান ভিসাটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। এবং এই দেশে বৈধভাবে থাকার আর কোন ভিসা তার আর নেই। তার মানে হচ্ছে আজ রাত বারোটার পর অফিশিয়ালি সে একজন অবৈধ, সে একজন রিফুজি, সে একজন অবৈধ আকাশ।
আচ্ছা unlawful non citizen শব্দটার বাংলা অর্থ কি হতে পারে? Unlawful না হয় অবৈধ, কিন্তু non citizen? বেনাগরিক, অনাগরিক এই ধরনের কোন শব্দতো বাংলা ভাষায় নেই। পুর্ন অনুবাদ করতে গেলে হবে ‘যিনি নাগরিক নন’ তারমানে, পুরো শব্দের বাংলা হবে ‘অবৈধ, যিনি নাগরিক নন’ অথবা ‘নাগরিক নন এমন কেউ অবৈধভাবে আছেন’। কিন্তু কথাটা বেশ বেমানান। অন্যভাবে করলে হবে ‘অবৈধ ভিনদেশী’ বা ‘অবৈধ বিদেশি’। কিন্তু তাতে করেও শব্দটা কানে লাগছে, বেশ আটকে যাচ্ছে, শ্রুতিমধুর হচ্ছেনা। কি এক আজিব দুনিয়া, আগামীকাল থেকে আকাশ এমন এক ভ্রান্ত দুনিয়ার বাসিন্দা হতে যাচ্ছে যে সেই দুনিয়ার বাংলা নামটাও বিভ্রান্তিতে ভরা মানে যার কোন শুদ্ধ বাংলাও নেই। আর এই জন্যই সবাই সোজা সাপটা একটা বাংলা বের কিরে নিয়েছে, unlawful non citizen কে এরা হয় বলে, অবৈধ অথবা বলে রিফুজি। আবার কথাটা কিন্তু রিফুজিও নয়। কারন যিনি বাংলাদেশ থেকে এসে রিফুজি আবেদন করে সফলভাবে এই দেশের বাসিন্দা হয়েছেন তাদেরকে রিফুজি বলা যেতে পারে। অথচ এখানকার বাংলাদেশিদের কাছে ‘রিফুজি’ মানেই হচ্ছে আপনি অবৈধ হয়ে গেছেন, হয়ে গেছেন বেগানা দেশের স্বঘোষিত নাগরিক।
এই প্রবাস যাপনের দীর্ঘ ১১ বছর ধরে আকাশ এই শব্দটা চেনে। অথচ এই শব্দটাকে এত কাছ থেকে চেনার কোন তাগিদ সে এর আগে অনুভব করেনি। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই মাটির খাতায় সে তার নাম লেখায়। তারপর বাঙালী অধ্যুষিত একটা এলাকার বাঙালী বসতিপুর্ন এক বাসার একটি কামরায় শেয়ারে থাকতে এসে এই শব্দের সাথে তার পরিচয়। সেই বিশাল বাসায় ছয়টি রুম আর একটা বিশাল লাউঞ্জ ছিলো। ছয় ঘরের পাঁচটিতে মোট দশজন থাকতো। আর একটিতে খাটভাড়া, মানে হচ্ছে সেই রুমে থাকতো চারজন আর খাট দুটি। আর সেই রুমের চারজনই সপ্তাহে সাতদিন কাজ করতেন তাও আবার শিফট ডিউটি। দিনের বেলায় সেই খাটদুটিতে ঘুমাতেন রাতের শিফট শেষ করে আসা দুই রিফুজি আর রাতেরবেলায় ঘুমাতেন দিনের শিফট শেষ করে আসা অন্য দুই রিফুজি। এতে করে ভাড়া দিতে হত অনেক কম। মুল উদ্দেশ্য পয়সা বাঁচানো। আর এখানে এক ডলার বাঁচানো মানে দেশে মা, বাবা, ভাই, বোন, স্ত্রী, কন্যা পুত্রদের মুখে আরো একটু বেশী হাসির যোগান। অন্যদিকে লাউঞ্জটা বিশাল বড় সেখানে ঘুমাতো আরো ছয়জন। মোট বিশজনের মধ্যে একমাত্র আকাশ আর সঞ্জয় ছিলো ছাত্র আর বাকি সবাই ছিল রিফুজি। আকাশ আর সঞ্জয় বাদে বাকি আঠারোজন এতটাই ব্যস্ত যে তাদের মুখ দেখা যেত মাসে দু একবার কারন সবাই নিদেনপক্ষে দুটা কাজ করতো,কেউ কেউ তিনটা। কারন সবার উদ্দেশ্য একটাই। এইদেশে যেহেতু ভবিষ্যত নেই তাই এই দেশের বর্তমানকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে নিজের ভবিষ্যৎ গড়া। সেদিন আকাশের খুব কষ্ট হয়েছিলো এই ভেবে যে, কি অমানবিক ভাবে বেঁচে থাকে এই দেশে মানবিক কারনে আশ্রয় চাওয়া এই শরনার্থীগুলো। অথচ বিধির বিধান, কে জানতো যে একদিন এই রাস্তায় তাকেও হাঁটতে হবে।
সেই বাড়িতে তার খুব কাছের মানুষ ছিলেন মামুন ভাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা রিতীমত শিক্ষিত ছেলে। দেশে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে তার চাকুরি বাকরি সবই ছিলো। হঠাৎ করেই কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যায়। হারান চাকরি, যা আর ফিরে পাওয়া হয়না অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও । নব্বইটা ইন্টারভিউ দিয়েও দেশে বেকার ছিলেন নয় মাস। এবং সেই নয় মাসে জন্ম নিয়েছে বিশাল এক ঋণের বোঝা। উনার পরিচিত গন্ডির হেন কোন লোক নেই যার কাছ থেকে টাকা ধার নেননি। শেষ অবধি কোনভাবে এই দেশে ট্যুরিস্ট হিসেবে ঢোকার ভিসা পেয়ে যান। নিজের ও পরিবারের পেট পরে, অন্তত ধারের টাকাগুলো শোধ দেবার নিয়তে পারি জমান এই দেশে। আর সেই যে আসা তার আর কোন ফিরে যাওয়া নেই। সেই ২০০৯ সালেই মামুন ভাইয়ের সাথে এই দেশের সম্পর্ক ১৩ বছরের। আর সেই থেকেই তিনিও রিফুজি। আজ মামুন ভাইকে খুব মনে পড়ছে আকাশের। কোথায় আছেন উনি? কি করছেন? তিনি কি এখনো রিফুজি? নাকি পাকা বন্দবস্ত হয়ে গেছে? নাকি সেইযে ধরা খেলেন এখনো জেল হাজতে নাকি ধরে বেঁধে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কে জানে?
সেই বছরই আগষ্ট মাসের এক রাতে সেই বাসায় ইমিগ্রেশনের রেইড হয়। আকাশ আর সঞ্জয় আর রাতের সময় ডিউটিতে থাকা সেই দুই রিফুজি ছাড়া বাকি সব রিফুজিকে সেই রাতেই ডিটেনশন সেন্টার মানে হাজতে চালান করে দেওয়া হয়। মামুন ভাইয়ের সাথে সেদিনই শেষ দেখা। এরপরে ডিটেনশন সেন্টারে থাকা অবস্থায় দু এক মাস উনার সাথে কথা বার্তা হয়। পরে তিনি আর যোগাযোগ করেননি।
আকাশ এই দেশে এসেছিলো পড়াশোনা করতে। চার বছরের ব্যাচেলর ডিগ্রি করে দেশে ফেরার পরিকল্পনা থাকলেও এক অদৃশ্য চুম্বকের টানে আজ এই দেশে ১১ বছর। আজও মনে আছে সেই দিনের কথা। আকাশ যাবে তার ইউনিভার্সিটিতে।
আকাশ এই দেশে এসেছিলো পড়াশোনা করতে। চার বছরের ব্যাচেলর ডিগ্রি করে দেশে ফেরার পরিকল্পনা থাকলেও এক অদৃশ্য চুম্বকের টানে আজ এই দেশে ১১ বছর। আজও মনে আছে সেই দিনের কথা। আকাশ যাবে তার ইউনিভার্সিটিতে। এই দেশে বাংলাদেশের মত হুটহাট রিকশা মেলেনা তাই একমাত্র ভরসা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অথবা দুপা। আর ভাগ্য ভাল হলে নিজের চারচাকা। আকাশের তখন গাড়ি নেই। বাস থেকে নেমে ট্রেন ধরবে। হাটছে হাটছে, অথচ পথ শেষ হয়না। যাকেই জিজ্ঞেস করে বলে The station is just another two minutes walk. শালার টু মিনিট ও আর শেষ হয়না। শেষমেশ রেগে গিয়ে আকাশ একটা ট্যাক্সি নিলো। গন্তব্য ম্যাকোয়ারি ইউনিভার্সিটি। ট্যাক্সিতে উঠতেই ড্রাইভার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, Where are you from? আকাশ বললো ফ্রম বাংলাদেশ। ও আপনি বাংলাদেশী? আকাশের আজও অক্ষরে অক্ষরে মনে আছে সেই কথপোকথনঃ – হ্যা আমি বাংলাদেশী – আপনি? – ও হ্যা, আপনিও তো, কি বোকার মত প্রশ্ন করলাম – সমস্যা নেই। তা, কি ভিসায়? – স্টুডেন্ট – কি সাবজেক্ট? – একাউন্টিং – ও তার মানে পড়াশুনা শেষ করেইতো পি আর – ভাই পি আর? এর মানে কি? – আরে ভাই কি বলেন পি আর মানে জানেননা? পি আর মানে হচ্ছে সোনার হরিণ। অর্থাৎ এই দেশে চিরস্থায়ীভাবে বসবাস করার ভিসা – ও আচ্ছা আজ ভাবতে অবাক লাগে, যেই আকাশ পি আর মানে জানতোনা, যে আকাশ এই দেশে থাকতে আসেনি অথচ কি এক অদৃশ্য চুম্বকের টানে তার আর ফেরা হলোনা। আর ফেরা হলোনা ধানসিঁড়িটির তীরে। অথচ দেশে কি ছিলোনা তার? মা বাবার দুই সন্তানের মধ্যে সেই একমাত্র ছেলে। মা, বাবা আর বড় বোন নিয়ে সুন্দর সংসার। বাবার সুপ্রিতিষ্ঠিত ইম্পোর্ট এক্সপার্ট ব্যবসা। ঢাকায় গোটা কয়েক বাড়ি, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, দামি গাড়ি। অথচ সেই আকাশ আর আজকের আকাশের মাঝেও আকাশ পাতাল ফারাক। বাবা বলেছিলেন, শোন তোকে কোন কাজ করতে হবে না। তোর টিউশন ফি থাকা খাওয়া হাত খরচ সব আমি দেশ থেকে পাঠাবো। প্রথম এক বছর বাবার খরচে চললেও পরে সময় কাটানোর জন্য শখের বশে একটা চেইন ক্যাফে বিজনেসে বারিস্তার কাজ নেয়। বারিস্তা হিসেবে তার কাজ ছিল শুধুই কফি বানানো। দিনে অন্তত আটশ সার্ভ কফি বানাতো। পড়াশুনা শেষ করে পি আরের জন্য এপ্লাই করবে তৈরী হচ্ছে। ঠিক সেই সময় এখানে মাইগ্রেশনের সমস্ত নিয়ম কানুনে বিশাল পরিবর্তন এলো। প্রথমত, একাউন্টিং এর পয়েন্ট ৮০ থেকে বেড়ে হয়ে গেল ১১০ আর সরাসরি আবেদনের সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হলো। নিয়ম হলো সরকারের কাছে এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট অর্থাৎ আমি পি আর নিতে ইচ্ছুক ও আমি পি আর পাবার সব শর্ত সমুহ পুরনে সক্ষম এই মর্মে আবেদন করে তীর্থের কাক হয়ে বসে থাকা। এরপর সরকার যাকে ইচ্ছা ডাক দেবেন। আর এই এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট জমা দিয়ে এদেশে থাকার জন্য অন্য ভিসার ব্যবস্থা করা। আকাশও তাই করলো। এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট জমা দিয়ে ৪৮৫ ভিসা নিয়ে নিলো যার মেয়াদ ছিলো দেড় বছর। প্ল্যান ছিলো দেড় বছরে ডাক না আসলে মাষ্টার ডিগ্রির জন্য আরেকটা স্টুডেন্ট ভিসার আবেদন করবে।
১ Comment
congratulations.