ছাত্র
মুহাম্মদ কামাল হোসেন (কুড়ি)
ছাত্র! হায়রে আধুনিক ছাত্র! মুখে বাংলিশ চলনে ইংলিশ গানে হিন্দি! জ্ঞানে অজ্ঞ কথাবার্তায় সাজে তবু বিজ্ঞ! বাঙালির প্রকৃত ছাপ হারিয়ে যাচ্ছেরে বাপ! ওরা ইচরে পাকা! ওদের হৃদয় তাই ফাঁকা! জাতিকে দিবে ধোকা! আমরা শিক্ষকরা নাকি বোকা! ওরে ভাতিজা-নাতিরা সরেক বাতাস আসতে দে। অপি ভাই কোথায় গেছে? তারে কেউ ডাক তো এবং বল তো এক কাপ চা চাই। চায়ে যেন কাঁচা পাতি পাই ; বেশি কথা বলছি তো মাথা ধরছে তাই।
সোনাহাট স্থলবন্দর সদর হাইস্কুল সংলগ্ন ‘ভাই ভাই হোটেলে’ বসেই বজলু স্যার এসব কথা বলছিল। একটু দূরেই বসা শের আলী ভিড় ঠেলে বজলু স্যারকে সালাম দিয়ে বললো-“স্যার, অ্যাতো আগ করছেন ক্যা? কহন থাইক্যা খ্যায়াল করছি ছাত্রগোরে নিয়া কী যেন কইতাছেন । কুন ছাত্র বেয়াদবি করছে কন দেহি। এহনি ওরে আচ্ছামতন ঠেলাডা দিতাছি। মানুষ চেনে নাই। কারে কিবা কইরা কতা কওন লাগবো বুজে না। স্যার গো আপনে মাথা ঠান্ডা করেন।”
এতক্ষণে অপি কাচা পাতিওয়ালা চা দিয়েছে। চায়ে চুমুক দিয়ে বজলু স্যারের উচ্চ কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসে। ঠান্ডা মাথায় শান্ত গলায় শের আলীকে ধন্যবাদ দিয়ে বলে শাসন করার দরকার নেই। আমরা শিক্ষকরাই উপযুক্ত শাসন করতে পারি না। আর আপনি আমাকে ভালোবেসে এত বড় দুঃসাহসের পরিচয় দিয়ে আইনের অবমাননা করা যাবে না। তাছাড়া দশ-বিশজন নয় যে, শাসন করে ঠিক করবেন। ইতিমধ্যে ‘ভাই ভাই হোটেলে’ অনেক লোক সমবেত হয়।
চা পান করে বজলু স্যার হোটেলের বাইরে এসে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বলে-“এখনকার ছাত্রদের শুধু দোষ দিলেই চলবে না। আমাদের সময় বিনোদনের জন্য নাটক, ছায়াছবি, যাত্রা, গান,কৌতুক, খেলাধুলা,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি ছিল। আর এসব একাকী উপভোগ করা সম্ভব ছিল না। বন্ধু-বান্ধব,আত্মীয়-স্বজন,প্রতিবেশী, পরিবার-পরিজন তথা দূরদূরান্তরের লোকজনের সমাগমে মেলবন্ধনের আলোকে পরিবেশিত হত। আর এখন মোবাইল, কম্পিউটার ইত্যাদি দিয়ে ইউটিউব, টুইটার, ফেইসবুক, গুগুল ইত্যাদির মাধ্যমে পৃথিবীর সবকিছু হাতের মুঠোয় পাচ্ছে !
বিজ্ঞানের যুগে তথা আধুনিক যুগে প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যতিত সুন্দর জীবন কষ্টকর। তাই ছাত্র-ছাত্রীদের অবশ্যই প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তবে অভিভাবক আত্মীয়-স্বজনসহ চারপাশের সব মানুষের দায়িত্ব ছাত্র- ছাত্রীদের প্রতি খেয়াল রাখা। কেননা একজন ছাত্র যদি বখাটে হয় তার দ্বারা সমাজ তথা জাতির বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। প্রত্যেককে নিজের সুস্থ ধারার জীবনযাপন করার জন্য হলেও খেয়াল রাখতে হবে। শুধুমাত্র শিক্ষকের উপর সমস্ত দোষ চাপালে হবে না। ”
বজলু স্যারের সমস্ত কথাকে উপস্থিত সবাই সমর্থন জানাল। সবাই বলাবলি করতে লাগলো আসলে আমরাও তো ছোটবেলায় কত দুষ্টু ছিলাম। কত শাসন-বারণে নষ্ট হইনি। আর এখন তো বিনোদনের ছড়াছড়ি ছাত্রদের বেয়ারা হওয়া স্বাভাবিক তার জন্য চাই সম্মিলিত আদর সোহাগ ও শাসন-বারণ। মুক্তিযোদ্ধা জলিল সমস্ত কথাবার্তা শুনছিল অবশেষে বলল-” অনেক কষ্ট কইরা দেশ স্বাধীন করছি, এহন এই দেশকে বাঙালির পরিচয়ে পরিচিত করতে হবো বুজলা.! তুমাগোরে কথায় খুব খুশি হইছি। ওই অপি উপস্থিত সবাইকে মিষ্টি খিল্যা,টেহা আমি দিমু। আমগোরে পোলাপাইনেরা উচ্চ শিক্ষিত হবো বাংলা, ইংলিশ, আরবি, হিন্দি সবই পারবো। ”
বজলু স্যারের চোখে জল! সবার অজান্তেই চোখের জল মুছলেও শের আলীর নজরকে এড়াতে পারেনি। শের আলী একটি মিষ্টি জোর করে স্যারের মুখে পুরে দিয়ে বললো-“আর কান্দন লাগবো না আমরা এহন আপনার হাথেই আছি ইনশাআল্লাহ।”