স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর এবং একজন ভুলু
(নারগিস দোজা)
পঞ্চাশ বছরের বঞ্চনা বয়ে বেড়ানো মানুষটা শেষমেষ চলেই গেল জীবনের ওপারে। অভাবে অনটনে কেটে গেছে জীবন। একজন মুক্তিযোদ্ধার কেউ খোঁজ রাখেনি। লাখ লাখ লোকের ভুয়া লোকের মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট জোগাড় হলেও একজন জেনুইন মুক্তিযোদ্ধার হাতের নাগালের বাইরেই থেকে গেছে সেটা।
পঞ্চাশ বছর আগে সতেরো বছরের গহর রাতের আঁধারিতে বাড়ি ছেড়েছিল মুক্তযুদ্ধে যোগদিতে। সিমান্ত পাড়িদিয়ে বহু কষ্টে পৌছেছিল ওপরে। সেখান থেকে যুদ্ধে যোগদান। প্রথমে মুক্তিযোদ্ধাদের ফাই ফরমাশ খাটা তারপর সরাসরি যুদ্ধে। সতেরো বছরের ভুলু তার বয়সি আরও কয়েকজন সহ বাংলাদেশের ভিতরের ঢুকে পাকিস্তানি আর্মি অবস্থানের খোঁজ খবর জোগাড় করে আনে। পরে সেখানে সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালায়। কিছু দিন যাবার পর ভুলু জেদ ধরলো এভাবে না সে সরসরি যুদ্ধ করবে। একজন সাবকমান্ডারকে ধরে ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দিল। সারাদিন ট্রেনিং চলে। রাতে নিজে নিজেই প্র্যাকটিস করে। একসময় ভুলুসহ আরও কয়েকজনকে পাকবাহিনির ক্যাম্পে আক্রমণ করতে পাঠানো হোল সাবকমান্ডারের অধিনে। সদ্য ট্রেনিং শেষকরা কয়েকজনকে এবং কিছু অভিজ্ঞ যোদ্ধাকে পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ করলেন তিনি।পাক আর্মির লোকেরা মারা গেল।
মুক্তিযোদ্ধাদের একজন আহত হোলে তাকে একট মাচার মত বানিয়ে তাতে কর কাঁধে বহন করে ক্যাম্পে ফিরলো ভুলুরা। এরমধ্যে আরও ছোট ছোট যুদ্ধে ভুলু অংশ গ্রহন করেছে। এরপর কমান্ডার তাদেরকে একটা বড় দলকে আক্রমণ করতে পাঠাল। ভুলু সহ আর কয়েকজন আহত হোল এবং সাবকমান্ডার মারা মারা গেলেন।
আহত ভুলু কিছুটা সুস্থ হয়ে অন্য দলের সাথে যুদ্ধ অংশ নিয়ে ফেরার পথে রাজাকারের হাতে ধরা পড়ল। দেশ স্বাধীন নহওয়া পর্যন্ত তাদের হাতে নির্মম অত্যাচার ভোগ করতে লাগল। স্বাধীন দেশে ভুল মুক্ত হয়ে মা-বাবা সাথে দেখা করতে গেল। ভুলু মুক্তিযুদ্ধে গেছে জানার পর গ্রামের রাজাকাররা তার মা – বাবাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। পনের বছরের বোনটাকে তুলেনিয়ে গেছে। পরে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে উদ্ধার করে। নুতন জীবন শুরু হোল ভুলুর। নির্মমভাবে অত্যাচারিত বিদ্ধস্ত ভুল ধর্ষিতা বোনকে নিয়ে শুরু করলো নুতন যুদ্ধ। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ নিজেকে সামলানোর কাজে ব্যাস্ত ভুলুকে সামলাবে কি। আর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন কেন্দ্রেও যাওয়া সম্ভব না বোনটাকে একারেখে। আস্তে আস্তে সময় কেটে যেতে লাগল। হাজারো মুক্তিযোদ্ধা হাজার রকম সুযোগ সুবিধা পেলেও একজন ভুলুর কোন ব্যাবস্থা হোল না। ভুলু যে তিমিরে ছিল সেই অন্ধকারের মধ্যেই রয়ে গেল।বোনটাও মরে গেছে শোকে দুঃখে গলায় দড়ি দিয়ে।
ভুল ধিরে ধিরে বিকৃতমস্তিষ্ক একজনে পরিণত হয়ে গেছে। গায়ে ছালা জড়িয়ে এখানে সেখান পড়ে থাকে সার্টিফিকেটহীন মুক্তিযোদ্ধা ভুলু। একদিন সেযে যুদ্ধ করেছিল দেশের জন্যে গ্রামের লোকেরা ভুলে গিয়েছে। এমন কি ভুলুর আর মনে নেই সে যে একজন মুক্তিযোদ্ধা । কখনো যুদ্ধে গিয়েছিল দেশের জন্যে।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পুর্তী দিবসে ভুলু মারা গেল।গ্রামবাসা তাকে কবর দিয়ে দিল। তার মৃত্যুতে কোন তোপদ্ধনী হোল না কোন গার্ড অফ অনার দেয়া হোলনা তার লাশ জাতীয় পাতাকা দিয়ে ঢেকে দেয়া হোল না। অথচ এর সবকিছুই প্রাপ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধা ভুলুর।
২ Comments
অসাধারণ গল্পটা । সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধারা পায়নি প্রকৃত সম্মান এভাবেই চলে গেছেন অনেকেই ।
আসলেই এমনটা হওয়ার কথা ছিল না