ধুলিধুসর
সৈয়দা রুখসানা জামান শানু
হ্যালো হ্যালো–শুনতে পারছিস, কান্না জড়ানো কন্ঠে কলার বলছে, আমি ভীষণ বিপদে আছি। কথা শেষ না হতেই ঢাকা শহরে যা হয় মোবাইল ছিনতাইকারীর কেউ একজন তাঁর দখলে নীলার মোবাইলটি নিয়ে দ্রুত আশ-পাশের গলির ভেতর ঢুকে পড়ে। নিরুপায়, নীলা নিরুপায়- তাঁর বন্ধু সুমনার কী হলো আর কোথায় বা সে, কী বলতে চেয়েছিল, নানা প্রশ্ন এ ছোট্ট মাথায় ভিড় জমতে থাকে তাঁর। সেদিনের কথা তাঁর খুব ভালো মনে আছে, দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। নীলা ভারত ভিসা আফিসের খুব কাছা-কাছি ছিল। পায়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিল ভারত দূতাবাস কার্যালয়ে, ভিসার সীল লাগানো পাসর্পোট সংগ্রহ করতে। বিকেলে পাসপোর্টসহ ঢাকার বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নেমে আসে। বাড়ি ফিরে কিছুতেই তাঁর ভাল লাগছিল না বার বার বন্ধুর কান্না জড়ানো কন্ঠটি কানে বাঁজতে থাকে। রাত কাটে তার ভীষণ কষ্টে! পরের দিন প্রথম প্রহরেই জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটো কপি দিয়ে হারিয়ে যাওয়া সিমটি নতুনভাবে কাষ্টমার কেয়ার থেকে ১’শ টাকার বিনিময়ে নীলা তুলে নেয়। সেই সাথে একটি নোকিয়া মোবাইল সেটও কিনল। কিন্তু বিধিবাম! হারিয়ে যাওয়া সেটেই ছিল তাঁর বন্ধুটির সেল নম্বর। নতুন সিম ও সেটে কারোর নম্বর না থাকায় অনেকের সঙ্গে নীলার যোগাযোগ দীর্ঘ দিন বন্ধ ছিল। যে যার প্রয়োজনে তাঁকে যখন কল করে তখন সেই ব্যক্তির নম্বর নীলা সেভ করে রাখে। কিন্তু তাঁর সেই বন্ধুটির আর ফোন কল এলো না! এভাবে কেটে গেল কয়েক মাস। নানা কাজের ঝামেলায় নীলাও ধীরে ধীরে বন্ধুটিকে ভুলে গেল। এরি মধ্যে চারটি বছর পার হয়ে গেলো। হঠাৎ বন্ধু দিবসে রাত ১২টার পর নীলার ইনবক্সে ২০১৩সালের হারিয়ে যাওয়া সেই বন্ধুটি একটি ম্যাসেজ দিয়েছে। সুমনার ম্যাসেজ পড়ে খুশিতে আত্নহারা নীলা। দু’জনের সাথে চ্যাটিং হলো দীর্ঘ সময় ধরে দু:খ, ব্যথা-বেদনার অনেক কথা সুমনা শেয়ার করে নীলার সাথে। দুই বান্ধবীর চ্যাটিং এর এক পর্যায়ে সেল নম্বর বিনিময়ের মাধ্যমে সময়ও নির্ধারণ হলো ৭’আগস্ট ২০১৬খ্রিস্টাব্দে সকাল ৭টার মধ্যে সুমনা নীলার কাছে তার গাড়িটি পাঠাবে তাঁকে নেয়ার জন্য। কথানূযায়ী একটি সাদা প্রাইভেট কার তাঁর বাড়ির সামনে এসে থেমে গেলো এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সুমনার কলও চলে এল। বল্ল তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আয়। নীলা আগে হতেই তৈরি ছিল। মোবাইল ও টাকার ব্যাগটি হাতে নিয়েই দোতালার সিঁড়ি হতে নিচে নেমে প্রাইভেট কারের সাটার খুলতেই দেখে, তাঁর বন্ধু সুমনার কোলে নাদুস-নুদুস সাড়ে তিন বছরের একটি ফুটফুটে কন্যা শিশু। শিশুটিকে দেখেই নীলার বুঝতে বাকি রইল না যে কন্যাটি তাঁর নাতনি। কেননা নীলারও বয়স হয়েছে। আর সুমনা তাঁর বিয়ের পাঁচ বছর আগে বিয়ে করেছে।
নীলা বন্ধুটিকে দেখে তাঁর স্বর্নালী দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। তাদের ছোট্ট বেলার গল্প থেকে শুরু করে স্কুল জীবনের নানা আনন্দভরা স্মৃতির এ্যালবাম চোখে ভাসতে লাগলো আর দুই বান্ধবী নাতনীসহ লং ড্রাইভে চল্ল। এরি মধ্যে নীলা জানতে চাইল সেই চার বছর আগের কান্না জড়ানো কন্ঠের কথা। সুমনা প্রথমে তাঁকে জড়িয়ে ধরে মন ভরে কাঁদলো। যেন মনে হল কত শত বছরের শত দু:খ বেদনা বুকেতে ধারণ করে একাই সামলে রেখেছে। আজ নীলাকে পেয়ে তাঁর চোখ দিয়ে বাঁধ ভাঙা অশ্রু গড়িয়ে যেত লাগলো, কিছুতেই থামে না। কান্নার সাথে নাক দিয়েও অবিরাম সর্দি ঝরতে লাগলো । কাজল কালো চোখও ঘোলাটে রঙ ধারণ করল। নীলাও নিজেকে সামাল দিতে পারছিল না। তাঁকেই বা কি সান্তনা দিবে। যাইহোক, সুমনা টিস্যু দিয়ে চোখ, নাক, মুখ মুছে ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আগে তোকে নিয়ে একটি জায়গা থেকে ঘুরে আসি, তারপর না হয় সেদিনের কথা বলব সব। নীলাও বেশ খুশি মনে বল্ল চল তবে ঘুরে আসি। এরই মধ্যে সময়ের কাঁটা বলছে ৯’টা বেজে এল। প্রাইভেট কারটি কিছুদুর গিয়ে ডানে টার্ন নিতেই নীলার চোখে পড়ল, একটি বড় গেট আর গেটটির উপরে স্পষ্টাক্ষরে লেখা কাশিমপুর কেন্দ্রিয় কারাগার, গাজিপুর।
সে সুমনার দিকে তাকিয়ে বল্ল এখানে কেন ?
সুমনা নিরুত্তর।
কিন্তু সুমনার চোখ-মুখ দিব্য কথা বলছে। তার চোখের ভাষা নীলা পড়তে পারলেও সবটুকু সম্ভব হচ্ছিল না।
সুমনা নিরত্তর থাকাতে নীলার মনে অজস্র প্রশ্নের ডালি এসে ভিড় করছে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে তারা দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে দু’কদম সামনে এগুলেই দেখা মিলে দুটি কাউন্টারের। একটি কাউন্টারের মাথার ওপর লেখা নারী কাউন্টার অন্যটির পুরুষ কাউন্টার। যথারীতি নিয়ম অনূযায়ী পুরুষ কাউন্টারে পুরুষ জেল পুলিশ ও নারী কাউন্টারে নারী জেল পুলিশ প্রবেশকারীদের ব্যাগ চেক করে আসামী দশর্নাথিদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিল। ততক্ষণে নীলা কিছুটা আঁচ করতে পারল বন্ধুটির খুব কাছের কেউ এ জেলখানায় বন্দি জীবন কাটাচ্ছে। জেল পুলিশ তাঁদের অনেক সম্মান দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে বলেন। বন্ধুটি নীলাকে নিয়ে আসামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ এর উদ্দেশ্যে অনুমতি টিকিট নেয়ার জন্য সোজা জেল ক্যাম্পাসের টিকিট ঘরের দিকে চলে আসে। নীলাও এই প্রথম এত বড় জেল ক্যাম্পাসে এসেছে। তাঁরা টিকিট কাউন্টারে অপেক্ষা করছে টিকিটের জন্য। কিন্তু ততক্ষণে টিকিট দেয়ার অনুমতির সময় হয় নাই। তাই সুমনা নীলাকে নিয়ে বিশাল জেল ক্যাম্পাস হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখাতে লাগলো। ভেতরে ৭একর জায়গা জুড়ে এবং বর্হিবিভাগে ৪৮.৫০ একর জায়গার ওপর ৪টি কেন্দ্রিয় কারাগারের আবাসিক গড়ে উঠেছে। জেল ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য দেখে নীলা মূর্হূতেই ভুলে গেল যে সে কাউকে দেখতে এসেছে। বিশাল জেল চত্বরের চারপাশের খোলা হওয়া সবুজ বনায়ন ও মাঝে মধ্যেই ফুটন্ত ফুলের বাগান। সারি সারি পেয়ারা গাছ তাতে অসংখ্য পেয়ারা ধরেছে। ফরমালিন ও কার্বাইডমুক্ত তাজা পেয়ারার দিকে তাকিয়ে কার না লোভ হয়। তবুও নিজেকে অনেকটা সামলিয়ে রেখেছে নীলা। বড় বড় ঘন সবুজ ঘাসের ভেতরে বেড়ে উঠেছে অসংখ্য গুল্মলতা লজ্জাবতী গাছ। কোনো কোনো লজ্জাবতীতে ফুটে আছে হাওয়াই মিঠাইয়ের ন্যায় গোলাপী রঙের ফুল। আবার কোনো কোনো গাছে ফুটে আছে সাদা ফুল, কোনোটাতে হাল্কা বেগুণী রঙের। এ গুল্মলতার পাতা দেখতে অনেকটাই তেঁতুল পাতার মত। বড় উপকারী ও ঔষধী গাছ। মানুষের হাত ও পায়ের স্পর্শে লজ্জাবতীর পাতা বুঁজে এসে বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে কেউ কেউ এ লতাকে বলে থাকেন লাজুক লতা। ছোট্ট বেলার জ্বলন্ত স্মৃতি এ বুড়ো বয়সে আর একবার জেগেই ওঠল না শুধু বেমালুম বয়সের কথা ভুলে নেমে পড়ল দুই বন্ধু সেই লজ্জাবতী পাতাকে লজ্জা দিতে। আনন্দ উচ্ছ্বাসে দুই বন্ধু নাতনি নিয়ে লাজুক লতার সাথে লুকোচুরি খেলায় মেতে ওঠল। বিশাল এ জেল ক্যাম্পাসে ফুরফুরে খোলা ও সতেজ হাওয়ায় নি:ম্বাস নিতে ভীষন ভাল লাগছিল তাঁদের। চারিদিক পাহারারত জেল পুলিশও তাঁদের এ স্বাধীন চলা-ফেরাকে কোনো বাঁধাই প্রদাণ করেন নাই। কোলাহল মুক্ত, সবুজে ঘেরা প্রকৃতির নিরলস সু-বাতাস বেষ্ঠিত এ জেল চত্তর যে কোনো মানুষকে মুগ্ধ করে তুলবে। নীলা জেল ক্যাম্পাসে আসার আগে কখনও ভাবে নাই যে, জেলের পরিবেশ এতোটাই নির্মল হবে। তার ধারণা ছিল, সূর্যের আলোর নিচে কিছু মানুষ সব সময় বিলাপহীন, অসহায় আর পরাভূত আলোহীন হয়ে দিন যাপন করছে। যাঁদের জীবনে কখনও সূর্য উঠে না। যাঁরা সস্তা নাগরিকের ন্যায়ও ভালোবাসার ছোঁয়া পায় না। যাঁদের জীবনের অনুরাগের স্বপ্নের সব রঙ ধূসর হয়ে যায়। যাঁদের শ্বাশত ভালোবাসা কিছু বানোয়াট বাণিজ্যিক মিথাচারের আঁচলে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় সীমাহীন স্বার্থপরতার চাহিদায় স্পর্ধিত উস্কানিতে ঠেলে দেয় আলোহীন ধুলিধুসোর ঘরে।
সাদা-কালো রঙের জুতো পায়ে নীলা জেল চত্ত্বরে হাঁটছে আর অন্তহীন এসব ভাবনার সাগরে ডুবে শুধুই জেলের ভেতর আটকে থাকা সেসব মানুষদের কথা ভাবছে। কীভাবে তাঁরা হৃদয়ের মানবিক জায়গা থেকে বেরিয়ে, সামাজিক বন্ধন ছিঁড়ে লোহার শিকলে আবদ্ধ হয়ে লাল সূর্যের নিচে আলোহীন হয়ে বেঁচে আছে। সূর্য প্রতিদিন একই রঙের আলো নিয়ে উদিত হয় আর অস্তমিত যায়। প্রভাত হয়, গোধূলি আসে কিন্তু আলোবিহীন এ মানুষগুলোর জীবনের সব বর্ণিল রঙ যেভাবে ধূসর হয়ে যায়, তাঁদের সেই আঁধার কোনো অমেয় আলোয় ঘোঁচে না।
নীলা এসব ভাবছে, এরই মধ্যে সময় হয়ে এলো টিকিট কাউন্টারে যাওয়ার। সুমনা আসামি দেখার জন্য টিকিট কাটলো এবং তাঁর ও নীলার মোবাইল দুটি কাউন্টারে জমা দিল। তারপর দু’জন সোজা জেলখানার সঙ্গে লাগানো আসামি দেখার রুমে প্রবেশ করল। সঙ্গে ফুটফুটে নাতনিটিও ছিল সুমনার কোলে। সেখানেও অপেক্ষা। তখনও বন্ধুটি বলছে না যে, সে কাকে দেখতে এসেছে। কৌতুহল বেড়েই চলছে নীলার।
পাঁচ/সাত মিনিট অপেক্ষার পর দেখতে পেল সে, টকটকে লাল ফর্সা, এলোমেলোভাবে দুই কাঁধে কোঁকড়ানো চুল আর মেরুন কালারের থ্রিপিছ পরিহিতা এক যুবতি নারীকে। লোহার তিনটি ফ্রেমের ওপারে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নীলা ঠিকভাবে চিনে ওঠার আগেই নারীটি সুমনার দিকে তাকিয়ে বলছে মা’ তুমি ক্যামন আছো? নীলা নির্বাক হয়ে একবার সেই নারীটির দিকে তাকায় আর একবার বন্ধুটির দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রশ্ন করে কে এই নারী? কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নারীটি নীলার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠল, আন্টি, মা ছাড়া এই প্রথম আমাকে কেউ দেখতে এসেছে। আর সেজন আপনি। একথা বলে তাঁর কান্না আর থামে না। কাদঁছে আর বলছে আন্টি চার বছর ধরে আমি বিনা জামিনে এখানে পড়ে আছি। নীলা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘড়ির উল্টোকাঁটার দিকে গিয়ে হিসাব কষছে কেন তাঁর বন্ধুর মেয়ের জীবন এমন ছারখার হলো? বিনা অপরাধে জামিন ছাড়াই চার বছর ধরে কারাগারে! কন্যাটি কাঁদছে আর বলছে আন্টি আমাকে একটা জামিনের ব্যবস্থা করুন! প্লিজ! আমি যে দু’ কন্যা সন্তানের মা, প্লিজ আন্টি আমাকে একটা জামিনের ব্যবস্থা করুন!
নীলার সান্তনা দেবার ভাষা যে নাই। সে নির্বাক হয়ে তাঁর কথাগুলো শুনছিল! আর সুমনার কথা ভাবছে, সেইবা কীভাবে চারটি বছর এ জ্বালা বুকে নিয়ে বইছে। প্রায় ৪০মিনিট কথা হওয়ার পর কন্যাটিকে নিয়ে ভেতরে চলে যায় নারী জেল পুলিশ। চোখের পানি মুছতে মুছতে সুমনার মেয়ে অনিন্দিতা তাঁর ছোট শিশু কন্যাটির দিকে টল টল অশ্রু জলে তাকাতে তাকাতে চলে গেল।
এদিকে নীলার বন্ধুটিরও চোখের পানি থামছে না। কত বসন্ত, কত হেমন্ত আর কত জোছনা পেরিয়েছে কিন্তু নীলার বন্ধুর জীবনের মৌনতা ভাঙতে পারছে না কেউ। বাবা হারানো তাঁর আদুরের কন্যাটি আজ আর নরম তোষক বিছান খাটে ঘুমায় না। বন্ধুটির আঁধার কাটবে কীভাবে? সুমনা এসব কথাগুলো নীলাকে বলছে আর অঝোরে কাদঁছে!
কোনোভাবে সামলিয়ে বেলা ১২টার দিকে পূনরায় প্রাইভেট কারে উঠল দু’বন্ধু। এবার নীলা শক্ত করে সুমনার হাত চেপে ধরে তাঁকে বল্ল, বন্ধু দোহাই লাগে, আমায় সব খুলে বল। আবেগ সামলিয়ে ধীরে ধীরে সে বলতে শুরু করল- আমার আদুরের কন্যাটির ঘরে যখন পর পর দুটি কন্যা সন্তান জন্মালো, তখন হতেই আমার একমাত্র জামাই আমার মেয়েকে প্রায়শই মানষিক নির্যাতন করত। বাবা হারা কন্যাটির কোনো ভাই না থাকায় এ নির্যাতন সে নীরবে সহ্য করত। এমনকি মাকেও বলত না। ধীরে ধীরে নির্যাতনের মাত্রা যখন বেড়ে যায় এবং আমার চোখের সামনে প্রায়শই ধড়া পড়ে, তখন আমি বিষয়টিকে আমলে নিয়ে কন্যা এবং জামাইকে বুঝিয়ে মিলে-মিশে সংসারে থাকার পরামর্শ দেই। এ বিষয়টিও আমার জামাই ভালভাবে গ্রহণ করতে পারে নাই। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমার বাড়ির কাজের মেয়ের অভিভাবককে দিয়ে আমার এবং আমার মেয়ের নামে স্থানীয় থানায় নির্যাতনের একটি মামলা দায়ের করে। এ অভিযোগে থানা-পুলিশ আমাকে এবং আমার মেয়েকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়। কারাগারে বন্দি হওয়ার কয়েকমাসের মধ্যেই আমার আদুরের কন্যাটিকে আমার জামাই ডির্ভোস লেটার পাঠিয়ে সে সূদূর মালেসিয়ায় পাড়ি জমায়। আমার একমাত্র কন্যা তার কোলে পাঁচ বছরের বড় কন্যা এবং এক বছরের ছোট কন্যা সন্তান ছিল। এ অবস্থায় আমরা সবাই কারাগারে বন্দি হয়ে পড়ি। দীর্ঘ দশ মাস আমি কারাগারে বন্দি থাকার পর জামিনে মুক্তি পাই। সাথে আমার নাতনি দুটিকেও মুক্ত করে বাড়ি নিয়ে যাই। কিন্তু আমার নাড়ি ছেঁড়া একমাত্র যক্ষ্যের ধনকে কারাগারেই রেখে যেতে হল। তার আর জামিন হল না। এরপর দীর্ঘ ছুটা-ছুটির পথচলা আমার। আজ এ উকিল তো কাল ওই উকিল, ছুটেই চলেছি উকিল আর আদালতের দ্বারে। তারিখের পর তারিখ পড়ে আদালত আমার নিরাপরাধ মেয়েটিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে চলে দু’পক্ষের উকিলের ঝাঝাঁলো বাহাসের পর বাহাস। রামদা কুড়াল ব্যবহার না হলেও মাঝে মধ্যে লোহার তৈরী হাঁতুড়ি পিটিয়ে অর্ডার অর্ডার বলে একে অন্যকে থামানোর চেষ্টাই চলে মাসের পর মাস। এমাসে বুঝি বেল পাবে, আবার বলে, সামনে মাসে ঠিক বেল পাবে। কিন্তু সব আশা আমার শেষ পর্যন্ত নিস্ফল হয়ে যায়। আমার আদুরের কন্যাটি আজ ৪’বছর ধরে কারাগারে আর আমি মা হয়ে তাঁর জামিনে মুক্তির শত চেষ্টা করেও পারলাম নারে। একজন মায়ের এরচেয়ে বেশি আর কী দু:খ হতে পারে, তুই বলতে পারিস আমাকে? এসব কথা নীলাকে সুমনা বলতে বলতে আবার অঝোরে কান্না শুরু করে দিল!
নীলা ভারাক্রান্ত মনে ভাবছে এ কোন্ আইনের কোন্ শক্তিতে চার্জশিট ছাড়াই সুমনার মেয়ের ঠিকানা এ ধুলিধুসর ঘরে। মধ্যবয়সী সুমনা আজ তার স্কুল-কলেজ পড়ুয়া বান্ধবী নীলাকে পেয়ে কেঁদে কুঁটে বলছে,জানিস আজ ৪’বছর ধরে কান্না ভুলে ছুটেই চলেছি কীভাবে আমার সন্তানকে জামিনে মুক্তি পাইয়ে তাঁর শিশু সন্তানদের কাছে ফিরিয়ে আনার জন্য। আজ বন্ধু দিবসে তোকে পেয়ে কান্নার বাঁধ থামাতে পারছি না। নীলাও তাঁর বন্ধু সুমনাকে মন ভরে কাঁদতে সাহায্য করল।
লেখক পরিচিতি: শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, লিটিলম্যাগ সম্পাদক, গবেষক, সংগঠক এবং কবি।
২ Comments
বিনা দোষে এভাবেই আমাদের দেশে অনেকেই কারাগারে বন্দি। এর দ্রুত অবসান হওয়া উচিত। গল্পের মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরার জন্য লেখককে অশেষ ধন্যবাদ।
very good job; congratulations.