সুন্দরীতে কার নজর
[তাহ্ মিনা নিশা]
ভাবছি, আজ একটা রহস্য জীবন গল্প বলবো। রহস্য এই জন্যে যে— এই কাহিনীর পাত্র পাত্রীর সাথে ঘটে যাওয়া রহস্যের আজ পর্যন্ত কোনো সমাধানের কূল কিনারা পাওয়া যায়নি। প্রথম থেকেই শুরু করা যাক—
দশ গ্রাম খুঁজে মোকামিয়া অবশেষে একজন সুন্দরীর দেখা পায়। সুন্দরীর নাম চন্দনা । চন্দনার রূপে পাগল হয়ে মোকামিয়া তার মুরব্বীদের দিয়ে সেই বাড়ীতে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।
ছেলে শিক্ষিত স্কুল মাষ্টার, বাপদাদার উচ্চবংশ, ধানি জমি আছে পঞ্চাশ বিঘা, পুকুর আছে দুইটা, ফল বাগান আছে, আছে পাকা দালান।এই সব দেখেশুনে চন্দনার বাপ এক মুহূর্ত চিন্তা না করে মেয়ের বিবাহে মত দেয়।
বিবাহের দিন বৌসাজে চন্দনাকে যেন আসমানের পরীর মতো লাগে! এক গ্রামের প্রায় সব পুরুষ মানুষ মিলে সুন্দরী চন্দনাকে ঢাকঢোল বাজিয়ে আনতে যায়।বরযাত্রী তেমাথায় (তিন রাস্তার মিলনস্থল) পৌঁছলে চন্দনা পালকী থেকে মুখ বের করে স্বামী মোকামিয়ার কাছে পানি পান করতে চায়।
মোড়ের দোকান থেকে একটা বিস্কুট ও একগ্লাস পানি হাতে নতুন বৌয়ের কাছে এগিয়ে আসে একটা ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়ে।নতুন বৌকে দেখে মেয়েটি বলে উঠে
— কত্তো সোন্দর!
সাথে সাথে উত্তর দিক থেকে একনিমিষেই একটা প্রবল বাতাস বয়ে যায়।তৎক্ষণাৎ আবার শান্ত হয় প্রকৃতি।
পানিটা মুখে দিতে না দিতেই অজ্ঞান হয়ে যায় চন্দনা। কিন্তু পালকীর পর্দার আড়ালে কেউ তা টের পায় না।
পালকী যখন মোকামিয়ার বাইরবাড়ীতে তখন সন্ধ্যা হয়েছে। হ্যাজাক বাত্তীর আলোতে নতুন বৌয়ের মুখ দেখতে আসে বাড়ীর ও গ্রামের সব মেয়েরা।নতুন বৌ ঘুমাচ্ছে দেখে সবাই কতো হাসি তামাশা করে। কিন্তু হায়! কেউ বুঝতেই পারে না নতুন বৌ এতক্ষণ জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিল পালকীর মাঝে।বৌকে ধরাধরি করে পালকী থেকে নামিয়ে মিষ্টি ও সরবত দিয়ে বরণ করে ঘরে তোলা হয়।
তিনমাস খুবই মধুর সময় পার করে মোকামিয়া ও চন্দনা।মোকামিয়ার চেহারা দেখলেই বোঝা যায় সে কতটা সুখী পুরুষ! চন্দনাও ঘোমটার আড়াল থেকে সারাদিন মিটমিট করে হাসে। তার পায়ের রুপার মল রুনুঝুনু করে বাজে পুরো বাড়ীময়। সুন্দরী বৌয়ের কারণে মকামিয়ার বন্ধুরা তাকে মনে মনে হিংসা করে । সেটা সে ঠিকই টের পায়। গ্রামের সবাই সুন্দরীর তুলনা দিতে গিয়ে চন্দনার কথা বলে। গর্বে মোকামিয়ার মাটিতে পা যেন আর পড়তে চায় না।
কিন্তু বিপত্তি ঘটে ঠিক তিনমাস একদিনের মাথায়। রাতের খাবার খাওয়ার পর সবাই যে যার ঘরে ঘুমোতে যায়।মোকামিয়া অভ্যাসবশত শোয়ার আগে সুন্দরী বৌয়ের হাতের পান খেতে চাইল। অমনি চন্দনা অগ্নিমূর্তী ধারণ করল। কেমন যেন না পুরুষ না নারী কন্ঠে বলে উঠল ,
— তিনমাস তোকে সুযোগ দিছি, আর বেশী কিছু আশা করবি তো তোর বৌকে গলায় দড়ি দিয়ে এইভাবে ঝুলায় রাখবো।
এই কথা বলাও শেষ, “সাথে সাথে ফ্যানের সাথে দড়িতে চন্দনার দেহ ঝুলতে দেখে”মোকামিয়া।এক চিৎকার দিয়ে ভয়ে দরজা খুলে পড়ি কী মরি করে ঘর থেকে উঠানের মাঝে এসে ঠাস করে আঁছাড় খেয়ে পড়ে যায় মোকামিয়া। শব্দ শুনে অন্য সব ঘর থেকে সবাই বেরিয়ে আসে।মোকামিয়ার ঘরে ঢুকে তারা সত্যি সত্যি দেখে— চন্দনা ফ্যানের সাথে ঝুলছে।
দড়ি কেটে চন্দনাকে নামানো হয়। মাথায় পানি দিয়ে তাকে ঠিক করা হয়। কিন্তু চন্দনার সেই ঘটনার কিছুই মনে নাই।পরের রাত্রে আবারো মোকামিয়া যখন পান চাইল, তখন চন্দনার হাতের মাঝে লুকিয়ে রাখা কীটনাশক ঢকঢক করে সে গিলে ফেলল।সেদিনও সবাই ছুটে এলো। এসে ধরাধরি করে পাশের স্বাস্হ্য সেবা কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে স্টোমাকওয়াস করানো হলো। পরের দিন বিকেলে তারা বাড়ি ফিরল।
মোকামিয়া সিদ্ধান্ত নিল, সে আর বৌয়ের কাছে পান চাইবে না। চার পাঁচ দিন পর সে যখন রাত্রে তার বৌকে ভালোবেসে কাছে টানল, তক্ষুণি এক ধাক্কায় বিছানা থেকে নীচে ফেলে দিল। এমনি করে একমাস- একবছর – দুইবছর – পাঁচবছর – দশবছর চলে গেল। কত ডাক্তার ,বৈদ্য, ওঝা, ফকির, পীর, দরবেশের চিকিৎসা নেয়া হলো। কিন্তু চন্দনা আর তার স্বামীর সান্নিধ্যে এলো না।
মোকামিয়ার চেহারার দিকে আর তাকানো যায় না । সারাদিন সুন্দরী বৌয়ের সেবা করে তার সময় যায়। গ্রামের সবাই মোকামিয়াকে আবার বিয়ে করে সন্তানের পিতা হতে বললো। চন্দনার বাবা বিয়ের দশবছর পরেও চন্দনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইল।কিন্তু মোকামিয়া তার সুন্দরী বৌকে ছাড়লো না। নিঃসন্তান মোকামিয়ার বিবাহের বয়স বর্তমানে চল্লিশ বছর।অথচ মাত্র তিনমাসের ভালোবাসাকে সম্বল করে এখনো মোকামিয়া বিশ্বাস করে—-
“চন্দনা আবারো একদিন সুস্থ হয়ে তাকে ভালোবাসবে।”
সমাপ্ত
৬/৬/২০২২